একজন স্বাস্থ্যবান ড্রাইভার
ব্যান্ড সঙ্গীতের সেরা সময় বলা হয়ে থাকে নব্বই দশককে। সেই দশকের জেনারেশন দিন-রাত পার করত ব্যান্ড সঙ্গীত শুনে। এখনকার মতো ‘বাবু খাইছো’ দেখে নয়! সেই জেনারেশনের কিছু বেকার এখনও আছে। তেমনই দুই বন্ধু লাবু আর লস্কর।
তারা মাস্টার্স শেষ করেছে কবে তা এখন আর মনে নেই। চাকরির ভাইভা বোর্ডে জিজ্ঞেস করলে নিজের সিভি দেখে মনে করে নেয়। একদা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে দুই বন্ধু বাসে চেপে ঢাকায় আসছিল। লাবু হেডফোনে শুনছিল সেই নব্বই দশকের গান। আর লস্কর পত্রিকা কিনে ‘নলেজ’ বাড়াচ্ছিল। হঠাৎ লস্কর জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে, কার গান শুনছিস?’
‘আর কার? প্রমিথিউসের বিপ্লবের গান।’
‘বিপ্লবের নতুন গান?’
‘আরে না, বিপ্লবের নতুন গান কোথায় পাব? বিপ্লব তো এখন আমেরিকায় সেটেলড।’
‘তাই নাকি? বিপ্লব কি আমেরিকায় ইংলিশ গান গায়?’
‘না না, বিপ্লব আমেরিকায় ট্যাক্সি চালায়।’
এবার লস্কর হাতের পত্রিকাটা লাবুর হাতে দিয়ে বলল, ‘বিপ্লবের সেটেলড হতে আমেরিকায় গিয়ে ট্যাক্সি না চালালেও হতো। দেশেই এখন ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে অনেক বেশি কামানো যায়, শুধু ড্রাইভিং করে! এখানে কোনো দফতরে যদি ড্রাইভারের চাকরি নিত তাহলে পাহাড় সমান সম্পদও থাকত আবার একই সঙ্গে সঙ্গীতও চালিয়ে যেতে পারত। আমরাও নতুন নতুন গান পেতাম!’
লাবু পত্রিকায় সফেদ জামার সঙ্গে সফেদ দাড়িসমেত এক ‘স্বাস্থ্যবান’ ব্যক্তির ছবির নিচে ক্যাপশন পড়ে বুঝতে পারল ইনি যে সে ড্রাইভার নন, রীতিমতো কোটিপতি ড্রাইভার! লাবু বলল, ‘আমরাই বা কী করলাম! মাস্টার্স পাস করে এসব পেশাকে ছোট ভেবে অন্য চাকরি খুঁজেছি। এখন দেখ, ওনার মতো লোক, আমাদের মতো ১০০ গ্র্যাজুয়েটকে চাকরি দিতে পারবে।’
‘তা ঠিক, কিন্তু সব ড্রাইভার কি কোটিপতি হতে পারে?’
‘সবার ট্যালেন্ট তো এক নয়। একটি ক্লাসের সবাই ফার্স্ট হয় না। উনি দেখিয়ে দিলেন, চালক হলেও আসলে উনিই ছিলেন ওই মন্ত্রণালয়ের অঘোষিত পরিচালক! পত্রিকা পড়ে যা বুঝলাম, মালেক ড্রাইভারকে শুধু ড্রাইভার বললে ভুল হবে, উনি এদেশের ড্রাইভারদের লিজেন্ড! তরুণ ক্রিকেটাররা যেমন তাদের ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারে মাশরাফি, সাকিবদের ছবি ব্যবহার করে, তেমনি তরুণ ড্রাইভাররাও একদিন তাদের প্রোফাইল পিকে হয়তো মালেক ড্রাইভারের ছবি দেবে।’
‘সবই বুঝলাম, কিন্তু এসব তো আর সহি পথে আসেনি যে তাকে সবাই লিজেন্ড মানবে। তার সম্পদের পাহাড় তো হয়েছে দুর্নীতি করে। একজন দুর্নীতিবাজ কি লিজেন্ড হতে পারে?’
‘সবই সম্ভব! আগে শুনেছিলাম, লেখা-পড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে। আর এখন, যারা লেখা-পড়া জানে না তারা ড্রাইভিং লাইসেন্স পায়। একজন তো বলেই দিয়েছেন, গরু-ছাগলের ছবি চিনলেই চলবে! মালেক ড্রাইভাররা মন্ত্রণালয়ের কোটি টাকার গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে। আর তুই আর আমি লেখা-পড়া জেনে রোজ লোকাল বাসের রড ধরে ঝুলি! আজকে যদি মালেক ড্রাইভার ধরা না খেত, হয়তো তুই আর আমিও চাকরির জন্য তার মতো মানুষের কাছে ধরনা দিতাম। এদেরকে লিজেন্ড না বলে উপায় আছে?’
‘হ্যাঁ, সেটা খারাপ বলিসনি। এতদিন মেয়ের বাবারা হয়তো পাত্রের পেশা ড্রাইভার শুনলে মেয়ে বিয়ে দিতে অস্বস্তি বোধ করত। এখন তারা বুঝতে পারবে কোন ড্রাইভারের কেমন দাম? বরং এখন মেয়েকে বিয়ে দিতে মন্ত্রণালয়ে ড্রাইভারের চাকরি করে এমন ছেলে খুঁজলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।’
দুই বন্ধুর আলাপ চলতেই থাকে।
মানুষের অবাক হওয়ার অনুভূতি নষ্ট হয়ে গেছে। প্রতিদিন যদি বিস্মিত হতে হয়, তাহলে স্বাভাবিক থাকবে কখন? সরকারি প্রকল্পে পর্দার দাম কিংবা বালিশ তোলার মজুরি অথবা খিচুড়ির (রান্না কিংবা বিতরণ শিক্ষা) জন্য বিদেশ ভ্রমণÑ এসব শুনতে শুনতে মানুষ আর অবাক হয় না।
তবে লাবু আর লস্করকে এবার সত্যি সত্যিই অবাক হতে হল। গল্পে গল্পে কখন যে ঢাকা চলে এসেছে টেরই পায়নি ওরা। সম্বিত ফিরে পেল বাস ড্রাইভারের ডাকে, তবে এই ড্রাইভার স্বাস্থ্যবান না!
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
একজন স্বাস্থ্যবান ড্রাইভার
ব্যান্ড সঙ্গীতের সেরা সময় বলা হয়ে থাকে নব্বই দশককে। সেই দশকের জেনারেশন দিন-রাত পার করত ব্যান্ড সঙ্গীত শুনে। এখনকার মতো ‘বাবু খাইছো’ দেখে নয়! সেই জেনারেশনের কিছু বেকার এখনও আছে। তেমনই দুই বন্ধু লাবু আর লস্কর।
তারা মাস্টার্স শেষ করেছে কবে তা এখন আর মনে নেই। চাকরির ভাইভা বোর্ডে জিজ্ঞেস করলে নিজের সিভি দেখে মনে করে নেয়। একদা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে দুই বন্ধু বাসে চেপে ঢাকায় আসছিল। লাবু হেডফোনে শুনছিল সেই নব্বই দশকের গান। আর লস্কর পত্রিকা কিনে ‘নলেজ’ বাড়াচ্ছিল। হঠাৎ লস্কর জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে, কার গান শুনছিস?’
‘আর কার? প্রমিথিউসের বিপ্লবের গান।’
‘বিপ্লবের নতুন গান?’
‘আরে না, বিপ্লবের নতুন গান কোথায় পাব? বিপ্লব তো এখন আমেরিকায় সেটেলড।’
‘তাই নাকি? বিপ্লব কি আমেরিকায় ইংলিশ গান গায়?’
‘না না, বিপ্লব আমেরিকায় ট্যাক্সি চালায়।’
এবার লস্কর হাতের পত্রিকাটা লাবুর হাতে দিয়ে বলল, ‘বিপ্লবের সেটেলড হতে আমেরিকায় গিয়ে ট্যাক্সি না চালালেও হতো। দেশেই এখন ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে অনেক বেশি কামানো যায়, শুধু ড্রাইভিং করে! এখানে কোনো দফতরে যদি ড্রাইভারের চাকরি নিত তাহলে পাহাড় সমান সম্পদও থাকত আবার একই সঙ্গে সঙ্গীতও চালিয়ে যেতে পারত। আমরাও নতুন নতুন গান পেতাম!’
লাবু পত্রিকায় সফেদ জামার সঙ্গে সফেদ দাড়িসমেত এক ‘স্বাস্থ্যবান’ ব্যক্তির ছবির নিচে ক্যাপশন পড়ে বুঝতে পারল ইনি যে সে ড্রাইভার নন, রীতিমতো কোটিপতি ড্রাইভার! লাবু বলল, ‘আমরাই বা কী করলাম! মাস্টার্স পাস করে এসব পেশাকে ছোট ভেবে অন্য চাকরি খুঁজেছি। এখন দেখ, ওনার মতো লোক, আমাদের মতো ১০০ গ্র্যাজুয়েটকে চাকরি দিতে পারবে।’
‘তা ঠিক, কিন্তু সব ড্রাইভার কি কোটিপতি হতে পারে?’
‘সবার ট্যালেন্ট তো এক নয়। একটি ক্লাসের সবাই ফার্স্ট হয় না। উনি দেখিয়ে দিলেন, চালক হলেও আসলে উনিই ছিলেন ওই মন্ত্রণালয়ের অঘোষিত পরিচালক! পত্রিকা পড়ে যা বুঝলাম, মালেক ড্রাইভারকে শুধু ড্রাইভার বললে ভুল হবে, উনি এদেশের ড্রাইভারদের লিজেন্ড! তরুণ ক্রিকেটাররা যেমন তাদের ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারে মাশরাফি, সাকিবদের ছবি ব্যবহার করে, তেমনি তরুণ ড্রাইভাররাও একদিন তাদের প্রোফাইল পিকে হয়তো মালেক ড্রাইভারের ছবি দেবে।’
‘সবই বুঝলাম, কিন্তু এসব তো আর সহি পথে আসেনি যে তাকে সবাই লিজেন্ড মানবে। তার সম্পদের পাহাড় তো হয়েছে দুর্নীতি করে। একজন দুর্নীতিবাজ কি লিজেন্ড হতে পারে?’
‘সবই সম্ভব! আগে শুনেছিলাম, লেখা-পড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে। আর এখন, যারা লেখা-পড়া জানে না তারা ড্রাইভিং লাইসেন্স পায়। একজন তো বলেই দিয়েছেন, গরু-ছাগলের ছবি চিনলেই চলবে! মালেক ড্রাইভাররা মন্ত্রণালয়ের কোটি টাকার গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে। আর তুই আর আমি লেখা-পড়া জেনে রোজ লোকাল বাসের রড ধরে ঝুলি! আজকে যদি মালেক ড্রাইভার ধরা না খেত, হয়তো তুই আর আমিও চাকরির জন্য তার মতো মানুষের কাছে ধরনা দিতাম। এদেরকে লিজেন্ড না বলে উপায় আছে?’
‘হ্যাঁ, সেটা খারাপ বলিসনি। এতদিন মেয়ের বাবারা হয়তো পাত্রের পেশা ড্রাইভার শুনলে মেয়ে বিয়ে দিতে অস্বস্তি বোধ করত। এখন তারা বুঝতে পারবে কোন ড্রাইভারের কেমন দাম? বরং এখন মেয়েকে বিয়ে দিতে মন্ত্রণালয়ে ড্রাইভারের চাকরি করে এমন ছেলে খুঁজলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।’
দুই বন্ধুর আলাপ চলতেই থাকে।
মানুষের অবাক হওয়ার অনুভূতি নষ্ট হয়ে গেছে। প্রতিদিন যদি বিস্মিত হতে হয়, তাহলে স্বাভাবিক থাকবে কখন? সরকারি প্রকল্পে পর্দার দাম কিংবা বালিশ তোলার মজুরি অথবা খিচুড়ির (রান্না কিংবা বিতরণ শিক্ষা) জন্য বিদেশ ভ্রমণÑ এসব শুনতে শুনতে মানুষ আর অবাক হয় না।
তবে লাবু আর লস্করকে এবার সত্যি সত্যিই অবাক হতে হল। গল্পে গল্পে কখন যে ঢাকা চলে এসেছে টেরই পায়নি ওরা। সম্বিত ফিরে পেল বাস ড্রাইভারের ডাকে, তবে এই ড্রাইভার স্বাস্থ্যবান না!