তিন নৌকায় পা
প্রেমিকার বাবা ইউপি চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। এদিকে আমার নিজের বড় চাচাও চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। ওদিকে আবার আমার আপন মামাতো ভাই চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। তারা সবাই পদপ্রার্থী হোক সমস্যা নেই। সমস্যা হলো এই পদপ্রার্থীগুলো সব আমার নিজের এলাকায়।
প্রেমিকা হুমকি দিয়ে বলে, ‘শোনো, আমাকে বিয়ে করতে হলে আমার বাবার পক্ষে ভোট কর। বন্ধু-বান্ধব যা আছে সবাইকে বলবে আমার বাবাকে যেন ভোট দেয়। এ সুযোগে আমাদের বাড়ি আসবা, মাঝে-মধ্যে বাবার সঙ্গে দেখা করবা। সে সুযোগে আমার সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে। আমরা গল্প করব। কেউ কিছু বললে বলবো ভোট নিয়ে আলোচনা করছিলাম।’
প্রেমিকা অবশ্য ভালো বুদ্ধি দিয়েছে। এই মাত্র আমি প্রেমিকার বাবার সঙ্গে দেখা করে এলাম। বললাম, ‘আংকেল, কোনো চিন্তা নাই। সব তো আপনার পক্ষে। আপনি জানেন না গোপনে গোপনে আপনার কত সাপোর্টার। আপনার পাশ কেউ আটকাতে পারবে না। আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধব সবাইকে বলছি আপনার পক্ষে থাকতে।’
প্রেমিকার বাবা একটু গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তা তো বুঝলাম বাবা। কিন্তু তোমার চাচা, মামাতো ভাই...।’
আমি বুঝে ফেললাম উনি কী বলতে চাচ্ছেন। তাই শেষ করতে না দিয়েই বললাম, ‘ওসব নিয়ে আপনি চিন্তা কইরেন না। সব ফালতু! সবার দ্বারা সব কাজ হয় নাকি? তাছাড়া যোগ্যতারও একটা ব্যাপার আছে। আমি সেই সব মানুষদের সাপোর্ট করি যারা পদের জন্য যোগ্য। অযোগ্য হলে আমি আমার আপন বাপকেও সাপোর্ট করব না। চেয়ারম্যান হিসাবে একমাত্র আপনিই যোগ্য লোক।’
হবু শ্বশুর খুশি হয়ে কাঁধ চাপড়ে বললেন, ‘তোমার কথা শুনে মনটা ভরে গেল বাবা। তোমার মতো সৎ ছেলে আমি আমার জীবনে দেখি নাই। প্রত্যেক ঘরে ঘরে তোমার মতো ছেলে হওয়া দরকার।’
আমি মাথা নিচু করে লাজুক ভঙ্গিতে বললাম, ‘জামাই, আংকেল জামাই হওয়া দরকার!’ তিনি একটু অবাক হলেন!
‘মানে ছেলে হলে যেমন বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে। সঙ্গে শ্বশুরের মুখও উজ্জ্বল হবে।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তা ঠিক বলেছ বাবা।’
প্রেমিকার বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাজারে এলাম। মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ভাই বলল, ‘কী রে পাবলু, আজকাল তোর খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না। কই থাকিস?’
‘না ভাই, বাড়িতেই থাকি। আপনি বিজি থাকেন, এজন্য দেখতে পান না।’
‘আচ্ছা শোন, কাজের কথা বলি। চল সিগারেট খেতে খেতে কথা বলি। আর শোন এই দোকান তোর জন্য ফ্রি। তোর যত পরিচিত মানুষ, বন্ধুরা আছে সবাইকে এখান থেকে যা ইচ্ছে খাওয়াবি। জানিসই তো, মানুষের পেট ভরাতে পারলে, মন জয় করা যায়।’
‘হ্যাঁ ভাই, বুঝতে পারছি।’
‘তা তোর চাচা তো উইঠা পইড়া লাগছে চেয়ারম্যান হইব। কিন্তু তুই একটা কথা বুঝ, তোর চাচা তো আর তোগো ভালো জানে না। তোর বাপরে সে আপন ভাই বইল্যা মানেই না। সেরকম মানুষদের জন্য খবরদার ভোট করবি না।’
‘ঠিক বলছেন ভাইজান। আমি যতদূর জানি সব তো আপনার পক্ষে। আপনি জানেন না, গোপনে গোপনে আপনার কত সাপোর্টার। আপনার পাশ কেউ আটকাতে পারবে না। আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধব সবাইকে বলছি আপনার পক্ষে থাকতে। চেয়ারম্যান হিসাবে আপনিই একমাত্র যোগ্য লোক।’
বাড়িতে আসতেই বড় চাচা ডাকলেন। বললেন, ‘শোন পাবলু, তোর ওই মামাতো ভাইটা, সেদিনকার পোলা। ওইটুকু পোলা রাজনীতির কী বুঝে? আর সে নাকি হইব চেয়ারম্যান। হাসি পায় শুইনা। শোন, গত পরশু পার্টির লোকজন আসবো। তারপর নমিনেশন দিব। তুই কিন্তু জান লাগায়া কাজ-কাম করবি।’
‘জি বড় চাচা, কোনো চিন্তা কইরেন না। সব তো আপনার পক্ষে। আপনি জানেন না, গোপনে গোপনে আপনার কত সাপোর্টার। আপনার পাশ কেউ আটকাতে পারবে না। আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধব সবাইকে বলছি আপনার পক্ষে থাকতে। চেয়ারম্যান হিসাবে একমাত্র আপনিই যোগ্য লোক।’
পার্টির লোকজন আসার দিন হলো আরেক ঝামেলা। সবার বাড়িতেই বিশাল খাবার-দাবার আয়োজন। দেখতে চায় কে কার পক্ষে! যে যার বাড়ি উপস্থিত থাকবে সে ওই নেতার পক্ষে। তিন বাড়ি থেকেই আমাকে ইনভাইট করা হয়েছে। আমি কিছু বন্ধুকে পাঠালাম বড় চাচার বাড়ি। কিছু পাঠালাম মামাতো ভাইয়ের বাড়ি। যে যার সাপোর্টারই হোক, খাওয়া মিস দেওয়া যাবে না।’
প্রেমিকার বাড়ি যাওয়ার সময় মামাতো ভাইয়ের লোকজনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তারা আমাকে সেখানে নিয়ে গেল। কারণ তারা জানে আমি আমার মামাতো ভাইয়ের সাপোর্টার। এদিকে প্রেমিকা এবং তার বাবা জানে আমি ওদের পক্ষে। চাচা জানেন তার পক্ষে। কিন্তু আমি কোন পক্ষে তা নিজেই জানি না।
যাই হোক, মামাতো ভাইয়ের বাড়ি যাওয়ার পর প্রেমিকার কাছে সংবাদ চলে গেল আমি এখানে। তাই প্রেমিকার বাবা জানার আগেই প্রেমিকার বাড়ির দিকে দৌড় দিলাম। প্রেমিকার বাবা বললেন, ‘আমার কাছে খবর আছে, তুমি তো তোমার মামাতো ভাইকে সাপোর্ট করো! তুমি আর এদিকে পা বাড়াবে না।’
এদিকে বড় চাচা আমার পাত্তা না পেয়ে আমাকে ত্যাজ্য ভাতিজা করেছে! বলেছে আমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।
ওদিকে মামাতো ভাই আমাকে না পেয়ে সব বন্ধুদের জানিয়ে দিয়েছে। দোকানে যা বাকি হয়েছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা। পাবলু যেন দিয়ে দেয়! ওর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।
অবশেষে নমিনেশন পেলেন পূর্ব পাড়ার তোফায়েল শেখ। আর স্বতন্ত্র থেকে দাঁড়ালেন মাইনুল হক। তিনজনকে সাপোর্ট করার কারণে আমার আমও গেল, বস্তাও গেল, সব গেল। প্রেমিকা অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে গেল। অথচ আমি ইউপি চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হলেও মনে হয় এতো ঝামেলা সহ্য করতে হতো না।
কালীদাসখালী, বাঘা, রাজশাহী।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
তিন নৌকায় পা
প্রেমিকার বাবা ইউপি চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। এদিকে আমার নিজের বড় চাচাও চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। ওদিকে আবার আমার আপন মামাতো ভাই চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। তারা সবাই পদপ্রার্থী হোক সমস্যা নেই। সমস্যা হলো এই পদপ্রার্থীগুলো সব আমার নিজের এলাকায়।
প্রেমিকা হুমকি দিয়ে বলে, ‘শোনো, আমাকে বিয়ে করতে হলে আমার বাবার পক্ষে ভোট কর। বন্ধু-বান্ধব যা আছে সবাইকে বলবে আমার বাবাকে যেন ভোট দেয়। এ সুযোগে আমাদের বাড়ি আসবা, মাঝে-মধ্যে বাবার সঙ্গে দেখা করবা। সে সুযোগে আমার সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে। আমরা গল্প করব। কেউ কিছু বললে বলবো ভোট নিয়ে আলোচনা করছিলাম।’
প্রেমিকা অবশ্য ভালো বুদ্ধি দিয়েছে। এই মাত্র আমি প্রেমিকার বাবার সঙ্গে দেখা করে এলাম। বললাম, ‘আংকেল, কোনো চিন্তা নাই। সব তো আপনার পক্ষে। আপনি জানেন না গোপনে গোপনে আপনার কত সাপোর্টার। আপনার পাশ কেউ আটকাতে পারবে না। আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধব সবাইকে বলছি আপনার পক্ষে থাকতে।’
প্রেমিকার বাবা একটু গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তা তো বুঝলাম বাবা। কিন্তু তোমার চাচা, মামাতো ভাই...।’
আমি বুঝে ফেললাম উনি কী বলতে চাচ্ছেন। তাই শেষ করতে না দিয়েই বললাম, ‘ওসব নিয়ে আপনি চিন্তা কইরেন না। সব ফালতু! সবার দ্বারা সব কাজ হয় নাকি? তাছাড়া যোগ্যতারও একটা ব্যাপার আছে। আমি সেই সব মানুষদের সাপোর্ট করি যারা পদের জন্য যোগ্য। অযোগ্য হলে আমি আমার আপন বাপকেও সাপোর্ট করব না। চেয়ারম্যান হিসাবে একমাত্র আপনিই যোগ্য লোক।’
হবু শ্বশুর খুশি হয়ে কাঁধ চাপড়ে বললেন, ‘তোমার কথা শুনে মনটা ভরে গেল বাবা। তোমার মতো সৎ ছেলে আমি আমার জীবনে দেখি নাই। প্রত্যেক ঘরে ঘরে তোমার মতো ছেলে হওয়া দরকার।’
আমি মাথা নিচু করে লাজুক ভঙ্গিতে বললাম, ‘জামাই, আংকেল জামাই হওয়া দরকার!’ তিনি একটু অবাক হলেন!
‘মানে ছেলে হলে যেমন বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে। সঙ্গে শ্বশুরের মুখও উজ্জ্বল হবে।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তা ঠিক বলেছ বাবা।’
প্রেমিকার বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাজারে এলাম। মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ভাই বলল, ‘কী রে পাবলু, আজকাল তোর খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না। কই থাকিস?’
‘না ভাই, বাড়িতেই থাকি। আপনি বিজি থাকেন, এজন্য দেখতে পান না।’
‘আচ্ছা শোন, কাজের কথা বলি। চল সিগারেট খেতে খেতে কথা বলি। আর শোন এই দোকান তোর জন্য ফ্রি। তোর যত পরিচিত মানুষ, বন্ধুরা আছে সবাইকে এখান থেকে যা ইচ্ছে খাওয়াবি। জানিসই তো, মানুষের পেট ভরাতে পারলে, মন জয় করা যায়।’
‘হ্যাঁ ভাই, বুঝতে পারছি।’
‘তা তোর চাচা তো উইঠা পইড়া লাগছে চেয়ারম্যান হইব। কিন্তু তুই একটা কথা বুঝ, তোর চাচা তো আর তোগো ভালো জানে না। তোর বাপরে সে আপন ভাই বইল্যা মানেই না। সেরকম মানুষদের জন্য খবরদার ভোট করবি না।’
‘ঠিক বলছেন ভাইজান। আমি যতদূর জানি সব তো আপনার পক্ষে। আপনি জানেন না, গোপনে গোপনে আপনার কত সাপোর্টার। আপনার পাশ কেউ আটকাতে পারবে না। আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধব সবাইকে বলছি আপনার পক্ষে থাকতে। চেয়ারম্যান হিসাবে আপনিই একমাত্র যোগ্য লোক।’
বাড়িতে আসতেই বড় চাচা ডাকলেন। বললেন, ‘শোন পাবলু, তোর ওই মামাতো ভাইটা, সেদিনকার পোলা। ওইটুকু পোলা রাজনীতির কী বুঝে? আর সে নাকি হইব চেয়ারম্যান। হাসি পায় শুইনা। শোন, গত পরশু পার্টির লোকজন আসবো। তারপর নমিনেশন দিব। তুই কিন্তু জান লাগায়া কাজ-কাম করবি।’
‘জি বড় চাচা, কোনো চিন্তা কইরেন না। সব তো আপনার পক্ষে। আপনি জানেন না, গোপনে গোপনে আপনার কত সাপোর্টার। আপনার পাশ কেউ আটকাতে পারবে না। আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধব সবাইকে বলছি আপনার পক্ষে থাকতে। চেয়ারম্যান হিসাবে একমাত্র আপনিই যোগ্য লোক।’
পার্টির লোকজন আসার দিন হলো আরেক ঝামেলা। সবার বাড়িতেই বিশাল খাবার-দাবার আয়োজন। দেখতে চায় কে কার পক্ষে! যে যার বাড়ি উপস্থিত থাকবে সে ওই নেতার পক্ষে। তিন বাড়ি থেকেই আমাকে ইনভাইট করা হয়েছে। আমি কিছু বন্ধুকে পাঠালাম বড় চাচার বাড়ি। কিছু পাঠালাম মামাতো ভাইয়ের বাড়ি। যে যার সাপোর্টারই হোক, খাওয়া মিস দেওয়া যাবে না।’
প্রেমিকার বাড়ি যাওয়ার সময় মামাতো ভাইয়ের লোকজনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তারা আমাকে সেখানে নিয়ে গেল। কারণ তারা জানে আমি আমার মামাতো ভাইয়ের সাপোর্টার। এদিকে প্রেমিকা এবং তার বাবা জানে আমি ওদের পক্ষে। চাচা জানেন তার পক্ষে। কিন্তু আমি কোন পক্ষে তা নিজেই জানি না।
যাই হোক, মামাতো ভাইয়ের বাড়ি যাওয়ার পর প্রেমিকার কাছে সংবাদ চলে গেল আমি এখানে। তাই প্রেমিকার বাবা জানার আগেই প্রেমিকার বাড়ির দিকে দৌড় দিলাম। প্রেমিকার বাবা বললেন, ‘আমার কাছে খবর আছে, তুমি তো তোমার মামাতো ভাইকে সাপোর্ট করো! তুমি আর এদিকে পা বাড়াবে না।’
এদিকে বড় চাচা আমার পাত্তা না পেয়ে আমাকে ত্যাজ্য ভাতিজা করেছে! বলেছে আমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।
ওদিকে মামাতো ভাই আমাকে না পেয়ে সব বন্ধুদের জানিয়ে দিয়েছে। দোকানে যা বাকি হয়েছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা। পাবলু যেন দিয়ে দেয়! ওর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।
অবশেষে নমিনেশন পেলেন পূর্ব পাড়ার তোফায়েল শেখ। আর স্বতন্ত্র থেকে দাঁড়ালেন মাইনুল হক। তিনজনকে সাপোর্ট করার কারণে আমার আমও গেল, বস্তাও গেল, সব গেল। প্রেমিকা অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে গেল। অথচ আমি ইউপি চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হলেও মনে হয় এতো ঝামেলা সহ্য করতে হতো না।
কালীদাসখালী, বাঘা, রাজশাহী।