মলাট বৃত্তান্ত
আমি ডিম (দ্য এগ) বলছি
ক্ষুদ্র ডিম হইয়া সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠিব, টেলিভিশনেও উচ্চারিত হইতে থাকিব বারবার-বিশ্বাস করিতে পারি না, এতটা সম্মানও ছিল কপালে! চিকিৎসকরা বলিয়াছেন ‘ডিম পুষ্টিকর খাবার’, ইহা আপনারা শুনিয়াছেন কিন্তু কখনো আমলে নেন নাই। অনূর্ধ্ব ১০ টাকা যাহার দাম তাহার আবার পুষ্টি কী, মানিবারই কী আছে-এইসব মনে করিয়া এতদিন আমাকে দাবাইয়া রাখিতেন। আপনাদের বঙ্গ সংস্কৃতি তো অর্থ দিয়াই সকল কিছু পরিমাপ করিয়া থাকে। সাত-আট টাকার ডিম হইয়া আপনাদের কাছ হইতে কদর পাইব, প্রত্যাশাও করিনি। ছিলাম তো জাল নোটের মতো ঘরের এককোণে পড়িয়া। অবশেষে দেখিলাম রঙ্গমঞ্চের আলো!
মনুষ্য প্রজাতি হিসাবে আপনারা বড়ই নিষ্ঠুর। কী লইয়া রসিকতা করিবেন আর কোথায় সম্ভ্রম প্রদর্শন করিতে হয়-এইসব লইয়া বরাবরই তালগোল পাকাইয়া ফেলেন। আপনারা দোকান হইতে ডিম কিনিবার সময় তাগাদা দেন, বড় দেখিয়া বাছিয়া দিতে। রসিক দোকানি কিংবা ওই দোকান হইতে বাকি নেওয়ার মতলবে থাকা কোনো বেল্লিক তখন মশকরা করে-আপনে কন ছোড, অথচ ডিমডা পাড়তে কেমন খবর অইছে এইডা মুরগিই জানে! দাগি আসামিদের মুখ হইতে কথা বাহিরকরণের নিমিত্তে পুলিশ কর্তৃক ‘ডিম থেরাপি’ বহুত পুরোনো বিষয়। আপনাদিগের এই পোড়া দেশে অনেক সময়ই দাগিরা থাকে বালাখানায় কত্ত দেখিলাম। সেই আপনারাই যে জিনিস খাইবেন, ওইটা দিয়া আবার শাস্তির আয়োজনও করিবেন-ইহাই স্বাভাবিক। নইলে কালেভদ্রে কোনো খারাপ লোক গ্রেফতার হইলে কেন বলিয়া বসেন-ওরে ডিম দিতাছে! ডিম দেয় নাকি ওমলেট খাওয়ায় তাহা কি প্রত্যক্ষ করিবার পারেন!
স্থানভেদে আমার নামও পালটাইয়া যায়। গরিব লোকরা তাচ্ছিল্য করিয়া আন্ডা ডাকে। সেই আমি ধনাঢ্য লোকের পাতে মামলেট, ওমলেট, এগ ফ্রাই, ডিম কারি ইত্যাদি নামে পরিচয় লাভ করিয়া থাকি। দুই ধরনের ডিম বাজারে রহিয়াছে। কেনার সময় আপনারা দোকানিকে বলেন-হাঁসের ডিম দেন, মোরগের ডিম দেন। ইহা সুস্পষ্ট লিঙ্গ বৈষম্য; হাঁস-মোরগ কি কখনো ডিম পাড়িয়াছে-নাকি সেইটা সম্ভব! হোটেলে বা বাসা-বাড়িতে খাইতে বসিয়াও আপনারা অবলীলায় বলিয়া বসেন মোরগের মাংস, হাঁসের মাংস! কিন্তু এত লিঙ্গ বৈষম্য, এমন অসততা কেন! মাংসটা কি মুরগির বা হাঁসির হইতে পারে না! বরাবরই আপনারা নারী জাতিকে নিগ্রহ দিয়া আসিয়াছেন। এই কমার্স ওয়ার্ল্ডে আসিয়াও খাসলত পালটাইতে পারেন নাই।
কম মেধার ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় কম নম্বর পাইলে বেফাঁস মন্তব্য করিয়া উঠিতেনÑআন্ডা পাইছে! সেই আন্ডা এখন উচ্চমূল্যের, প্রায় দ্বিগুণ দাম। এখন আপনারা সেই ‘গাধা’ ছেলেমেয়েদের সম্মান জানাইবার নিমিত্তে খুঁজিতেছেন। যুক্তি দেখাইতেছেন-তারা এখন অনেক ধনী; ডিমের মালিক! গালমন্দের মানুষ নহে! সময় থাকিতে কেন আপনাদের হুঁশ ফিরিল না। এই বাংলায় একসময় দরিদ্র-নিুবিত্তরা টাকার সংস্থান করিতে না পারিয়া চালের বদলে আটা কিনিত। গম ভাজিয়া খাইত। আটার রুটি, আটার জাউ ছিল নিত্যসঙ্গী। সেই আটাও ছিনতাই হইয়া গিয়াছে। ধনী লোকরা শখ করিয়া কিংবা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করিবার নিমিত্তে আটাকে খাদ্যতালিকায় স্থায়ী করিয়া লইয়াছে। আটার দাম আর চালের দামে এখন বড় কোনো তফাত নাই। মাঝখানে আটা ৫৫ টাকা কেজি পর্যন্ত দর হাঁকিয়াছে। বর্তমান দাম জানিতে চাহি না। তুঘলকি কাণ্ড ঘটিয়া যাইতেছে বারবার! নিজের কথাই বলি না কেন, আমিই এখন উচ্চ দ্রব্যমূল্যের বাজারে নায়ক দ্য হিরো (হিরোইন হইতে পারি না কেন)!
বঙ্গবাসী এখন আমাকে অতিমূল্যে খরিদ করিয়া থাকেন-এভাবে চাল-ডাল-তেল-চিনিকে সঙ্গী করিয়া অর্থনীতির গ্রাফকে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়াছি। কেউই জানেন না, আমি কোথায় পৌঁছাইব। আমরা কোথায় দাঁড়াইব। আপনারা যে বাজার সিন্ডিকেট, অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি ইত্যাদির কথা বলেন, বলিতে থাকুন। শোরগোল করিলে দাম কমিবে নাকি! আমরা জাতে উঠিয়াছি, দামে বাড়িয়াছি। এদ্দিন আমাকে লইয়া খেলিতেন, এখন আমার দিন। খারাপ কিংবা অপছন্দের মানুষকে আপনারা ডিম ছুড়িয়া দিয়া বিমল আনন্দ অনুভব করেন। কেন, ছোড়ার মতো আর কিছু পান না! আমি আপনাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করি, সেই আমিই কেন ‘পচা ডিম’ হইয়া অন্যের গায়ে উড়িয়া পড়িব; মঞ্চে উঠিব! এখন পারলে ছুড়িয়া মারুন তো দেখি! দুই মিনিটে নুডুলস রান্না করিয়াও আমাকে অপমান করেন। ভুলিয়া যান, ডিম দুই মিনিটের নয়, একজীবনের!
আর কিছু বলিতে রাজি নই। বাজারে আসেন, দেখা হইবে! ক্রেতা হিসাবে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকাইয়া থাকিবেন, আমি অট্টহাসি দিব। আমি ডিম, ডরাই না কিম (জং উন)রেও!
আমি ডিম (দ্য এগ) বলছি
মলাট বৃত্তান্ত
শফিক হাসান
২৪ আগস্ট ২০২২, ২১:৩৮:৫৬ | অনলাইন সংস্করণ
ক্ষুদ্র ডিম হইয়া সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠিব, টেলিভিশনেও উচ্চারিত হইতে থাকিব বারবার-বিশ্বাস করিতে পারি না, এতটা সম্মানও ছিল কপালে! চিকিৎসকরা বলিয়াছেন ‘ডিম পুষ্টিকর খাবার’, ইহা আপনারা শুনিয়াছেন কিন্তু কখনো আমলে নেন নাই। অনূর্ধ্ব ১০ টাকা যাহার দাম তাহার আবার পুষ্টি কী, মানিবারই কী আছে-এইসব মনে করিয়া এতদিন আমাকে দাবাইয়া রাখিতেন। আপনাদের বঙ্গ সংস্কৃতি তো অর্থ দিয়াই সকল কিছু পরিমাপ করিয়া থাকে। সাত-আট টাকার ডিম হইয়া আপনাদের কাছ হইতে কদর পাইব, প্রত্যাশাও করিনি। ছিলাম তো জাল নোটের মতো ঘরের এককোণে পড়িয়া। অবশেষে দেখিলাম রঙ্গমঞ্চের আলো!
মনুষ্য প্রজাতি হিসাবে আপনারা বড়ই নিষ্ঠুর। কী লইয়া রসিকতা করিবেন আর কোথায় সম্ভ্রম প্রদর্শন করিতে হয়-এইসব লইয়া বরাবরই তালগোল পাকাইয়া ফেলেন। আপনারা দোকান হইতে ডিম কিনিবার সময় তাগাদা দেন, বড় দেখিয়া বাছিয়া দিতে। রসিক দোকানি কিংবা ওই দোকান হইতে বাকি নেওয়ার মতলবে থাকা কোনো বেল্লিক তখন মশকরা করে-আপনে কন ছোড, অথচ ডিমডা পাড়তে কেমন খবর অইছে এইডা মুরগিই জানে! দাগি আসামিদের মুখ হইতে কথা বাহিরকরণের নিমিত্তে পুলিশ কর্তৃক ‘ডিম থেরাপি’ বহুত পুরোনো বিষয়। আপনাদিগের এই পোড়া দেশে অনেক সময়ই দাগিরা থাকে বালাখানায় কত্ত দেখিলাম। সেই আপনারাই যে জিনিস খাইবেন, ওইটা দিয়া আবার শাস্তির আয়োজনও করিবেন-ইহাই স্বাভাবিক। নইলে কালেভদ্রে কোনো খারাপ লোক গ্রেফতার হইলে কেন বলিয়া বসেন-ওরে ডিম দিতাছে! ডিম দেয় নাকি ওমলেট খাওয়ায় তাহা কি প্রত্যক্ষ করিবার পারেন!
স্থানভেদে আমার নামও পালটাইয়া যায়। গরিব লোকরা তাচ্ছিল্য করিয়া আন্ডা ডাকে। সেই আমি ধনাঢ্য লোকের পাতে মামলেট, ওমলেট, এগ ফ্রাই, ডিম কারি ইত্যাদি নামে পরিচয় লাভ করিয়া থাকি। দুই ধরনের ডিম বাজারে রহিয়াছে। কেনার সময় আপনারা দোকানিকে বলেন-হাঁসের ডিম দেন, মোরগের ডিম দেন। ইহা সুস্পষ্ট লিঙ্গ বৈষম্য; হাঁস-মোরগ কি কখনো ডিম পাড়িয়াছে-নাকি সেইটা সম্ভব! হোটেলে বা বাসা-বাড়িতে খাইতে বসিয়াও আপনারা অবলীলায় বলিয়া বসেন মোরগের মাংস, হাঁসের মাংস! কিন্তু এত লিঙ্গ বৈষম্য, এমন অসততা কেন! মাংসটা কি মুরগির বা হাঁসির হইতে পারে না! বরাবরই আপনারা নারী জাতিকে নিগ্রহ দিয়া আসিয়াছেন। এই কমার্স ওয়ার্ল্ডে আসিয়াও খাসলত পালটাইতে পারেন নাই।
কম মেধার ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় কম নম্বর পাইলে বেফাঁস মন্তব্য করিয়া উঠিতেনÑআন্ডা পাইছে! সেই আন্ডা এখন উচ্চমূল্যের, প্রায় দ্বিগুণ দাম। এখন আপনারা সেই ‘গাধা’ ছেলেমেয়েদের সম্মান জানাইবার নিমিত্তে খুঁজিতেছেন। যুক্তি দেখাইতেছেন-তারা এখন অনেক ধনী; ডিমের মালিক! গালমন্দের মানুষ নহে! সময় থাকিতে কেন আপনাদের হুঁশ ফিরিল না। এই বাংলায় একসময় দরিদ্র-নিুবিত্তরা টাকার সংস্থান করিতে না পারিয়া চালের বদলে আটা কিনিত। গম ভাজিয়া খাইত। আটার রুটি, আটার জাউ ছিল নিত্যসঙ্গী। সেই আটাও ছিনতাই হইয়া গিয়াছে। ধনী লোকরা শখ করিয়া কিংবা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করিবার নিমিত্তে আটাকে খাদ্যতালিকায় স্থায়ী করিয়া লইয়াছে। আটার দাম আর চালের দামে এখন বড় কোনো তফাত নাই। মাঝখানে আটা ৫৫ টাকা কেজি পর্যন্ত দর হাঁকিয়াছে। বর্তমান দাম জানিতে চাহি না। তুঘলকি কাণ্ড ঘটিয়া যাইতেছে বারবার! নিজের কথাই বলি না কেন, আমিই এখন উচ্চ দ্রব্যমূল্যের বাজারে নায়ক দ্য হিরো (হিরোইন হইতে পারি না কেন)!
বঙ্গবাসী এখন আমাকে অতিমূল্যে খরিদ করিয়া থাকেন-এভাবে চাল-ডাল-তেল-চিনিকে সঙ্গী করিয়া অর্থনীতির গ্রাফকে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়াছি। কেউই জানেন না, আমি কোথায় পৌঁছাইব। আমরা কোথায় দাঁড়াইব। আপনারা যে বাজার সিন্ডিকেট, অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি ইত্যাদির কথা বলেন, বলিতে থাকুন। শোরগোল করিলে দাম কমিবে নাকি! আমরা জাতে উঠিয়াছি, দামে বাড়িয়াছি। এদ্দিন আমাকে লইয়া খেলিতেন, এখন আমার দিন। খারাপ কিংবা অপছন্দের মানুষকে আপনারা ডিম ছুড়িয়া দিয়া বিমল আনন্দ অনুভব করেন। কেন, ছোড়ার মতো আর কিছু পান না! আমি আপনাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করি, সেই আমিই কেন ‘পচা ডিম’ হইয়া অন্যের গায়ে উড়িয়া পড়িব; মঞ্চে উঠিব! এখন পারলে ছুড়িয়া মারুন তো দেখি! দুই মিনিটে নুডুলস রান্না করিয়াও আমাকে অপমান করেন। ভুলিয়া যান, ডিম দুই মিনিটের নয়, একজীবনের!
আর কিছু বলিতে রাজি নই। বাজারে আসেন, দেখা হইবে! ক্রেতা হিসাবে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকাইয়া থাকিবেন, আমি অট্টহাসি দিব। আমি ডিম, ডরাই না কিম (জং উন)রেও!
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2023