ভাষা ভাসে বেনোজলে
সম্মান তৃতীয় বর্ষ এমন কোনো ‘অসম্মানজনক’ বয়স নয়, শাম্মী জাহান আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারত কিন্তু বাবা-মায়ের তর সইল না। প্রতিযোগিতার বাজারে পিছিয়ে থাকা কারওরই স্বভাবে নেই। বুদ্ধি করে অভিভাবকরা শাম্মীকে ভর্তি করিয়ে দিলেন হায়াজট সংস্কৃতি সাধন কেন্দ্রে। মেয়ে যদি একটু নাচ জানে, গান বোঝে, অভিনয় ও ছলাকলায় পারদর্শী হয়- ভালো জায়গায় বিয়ে দেওয়া যাবে। কপাল ভালো হলে বিদেশি পাত্রও জুটতে পারে।
আজকাল ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারের ভিডিওকলে সহজেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারা যায়। পাত্র-পাত্রী মোবাইল ফোনে একে অপরকে পুষ্পমাল্য পরাতে পারে না, তাকে কী! দিন-ভর তাদের মধ্যে যেসব কথার সূচনা হয় তা কি কোনো অংশে কম!
হায়াজটে ভর্তির তৃতীয় দিনের মাথায় শাম্মী বাবা-মাকে ডেকে বলল, স্মার্টফোনে হিন্দি গান প্লে কর, তোমাদের নাচ দেখাব। মুম্বাইয়ের নায়িকাদের অনুকরণে শাম্মী খ্যামটা নাচ দেখিয়ে চলল; এমন প্রত্যয়ও ব্যক্ত করল চাইলে সে যে কোনো হিন্দি, তামিল, তেলেগু নায়িকাকে ওপেন চ্যালেঞ্জ দিয়ে অভিনয় করতে পারে। গায়ের রংটা একটু চাপা- তাতে কী!
ভালো মেকআপম্যানের হাতে পড়লে তিলোত্তমা হতে কতক্ষণ! কাজল আগরওয়াল, বিপাশা বসুর মতো সুন্দরীরা যদি খ্যাতির শীর্ষে উঠতে পারে, শাম্মীর পিছিয়ে থাকার কোনো যুক্তি নেই। বাবা-মা গানসহযোগে নৃত্য দেখার পর এমন সব আত্মবিশ্বাসী বাক্যও শ্রবণ করলেন। শেষে বাবা মাথা চুলকে বললেন, ‘এখন আমাদের কী করতে বলিস?’
শাম্মী মিষ্টি হেসে বলল, ‘বোকার মতো কথা বল কেন! বুঝতে পারছ না- এখন আমার হিন্দি ভাষা কোর্সে ভর্তি হওয়া জরুরি। নইলে শাহরুখ, আমির, সালমান খানদের সঙ্গে কথা বলব কীভাবে? ঋত্বিক রোশন, প্রভাসের সঙ্গে না হয় ইংরেজিতে বললাম! তারা আমার বাংলার আদলে ইংরেজি বুঝবে হয়তো।’
মা আহত ভঙ্গিতে বললেন, ‘তোকে হায়াজটে ভর্তি করাতে দুই লাখ টাকা খরচ হলো, এখন আবার হিন্দি-উর্দুর কোর্স!’
শাম্মী মুখ ঝামটে বলল, ‘থাক মা, আমার কিছুই লাগবে না। পড়ে থাক তোমাদের ওই পুতুপুতু বাঙালিয়ানা সেন্টিমেন্ট নিয়ে!’
বাবা প্রবোধ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘রাগ করছিস কেন! উত্তরাচলে পুস্তক সমাবেশ হচ্ছে। ওখান থেকে হিন্দি-তামিল যেসব ভাষা শিখতে চাস- বই নিয়ে আয়।’
এমন প্রস্তাবে ঝলমল করে উঠল শাম্মীর মুখ। হাত বাড়িয়ে বলল, ‘গিভ মি সাম মানি’।
ভ্যানিটি ব্যাগে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে শাম্মী পুস্তক সমাবেশস্থলে পৌঁছাল। দেখল তিনশ টাকায় টিকিট কিনে লোকজন পিলপিল করে পুস্তক সমাবেশের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে গেল ওর। এদ্দিন জানত পুস্তক সমাবেশে প্রবেশ মূল্য নেই। ভেতরে ঢুকে আরও অবাক হলো শাম্মী। পুস্তক কোথায়, এখানে তো সব খাবারের দোকান!
চারপাশে দেখা যাচ্ছে চমকপ্রদ নামের আন্তর্জাতিক মানের সব হোটেল- মেলবোর্ন বিরিয়ারি, নয়াদিল্লি লাচ্ছি, নিউইয়র্ক তেহারি, সিডনি ফুচকা হাউজ, লন্ডনি মিষ্টি পান, প্যারিস কাচ্চি...। কিছুক্ষণের মধ্যে ওর ভুল ভাঙল। লোকজন নাকি আজকাল পড়তে চায় না, তাই সংস্কৃতি উদ্ধারবিষয়ক কর্মকর্তারা বুদ্ধি করে প্রত্যেক খাবারের দোকানে বই ফ্রি দেওয়া বাধ্যতামূলক করেছেন।
শাম্মী ঘুরে দেখল চারপাশ। লোভনীয় ঘ্রানে ভরে যাচ্ছে ওর বুক। বিজ্ঞাপনভাষ্য বলছে-এক প্লেট বিরিয়ানি খেলে দুইটা বই ফ্রি! কোনো কোনো দোকানে দিচ্ছে তিনটা/চারটা করেও। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ গবেষণা-খাদকের চাহিদা অনুযায়ী বই মিলছে। সেলিব্রেটি সব ইউটিউবার ও ফেসবুকাররা এখন লেখক। সংবাদপত্রের পত্রলেখকরা প্রকাশ করছে গবেষণামূলক প্রবন্ধগ্রন্থ। লেখকরা সব বড় বড় ডেকচির সামনে বসে হাঁকডাক দিচ্ছেন- আসুন, বিরিয়ানি খান, বই নিয়ে যান। অটোগ্রাফ ফ্রি!
শাম্মীর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া একজন ভদ্রলোক বিড়বিড় করে বললেন, ‘কোনো ভর্তা-ভাজি নেই, ডাল-সবজি নেই-যেদিকেই তাকাই বিরানি হাউজ! আবার ভুলভাল বাক্যে অশুদ্ধ ভাবনার মাগনা বইও দিচ্ছে।’
শাম্মী ভেবে পেল না, এমন চমৎকার অফারটা লুফে না নিয়ে উনি বিরক্ত হচ্ছেন কেন! চারপাশে হাজার হাজার মানুষ ঠিকই হাপুসহুপুস করে বিরিয়ানি খাচ্ছে আর ফ্রি বই নিয়ে বেরিয়ে আসছে। শাম্মী বলল, ‘হাই আঙ্কেল, কোনো প্রবলেম?’
‘না, মা। তোমার পরিচয়?’
‘আমার নাম Some-মি World। হায়াজটে অধ্যয়ন করি। তুম কৌন হ্যায়?’
‘আমি যে কে, আত্মপরিচয় আবিষ্কারের জন্যই পুস্তক সমাবেশে এসেছি। কিন্তু এখানে দেখছি তোমরা বিরানির দোকান খুলে রেখেছ!’
‘বিরিয়ানি ইজ অ্যা টেস্টি ফুড। আপনি কি গান শুনতে চান? আমি ভালো গাইতে পারি!’
‘আচ্ছা, মা। গাও দিকিনি একখান Gun!’
শাম্মী শুরু করল ‘আধুনিক’ রবীন্দ্রগান-ভরিষ দড়া-মাছে ছান্তিরও ভারি...!
ভাষা ভাসে বেনোজলে
শফিক হাসান
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৬:৪১:৫৪ | অনলাইন সংস্করণ
সম্মান তৃতীয় বর্ষ এমন কোনো ‘অসম্মানজনক’ বয়স নয়, শাম্মী জাহান আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারত কিন্তু বাবা-মায়ের তর সইল না। প্রতিযোগিতার বাজারে পিছিয়ে থাকা কারওরই স্বভাবে নেই। বুদ্ধি করে অভিভাবকরা শাম্মীকে ভর্তি করিয়ে দিলেন হায়াজট সংস্কৃতি সাধন কেন্দ্রে। মেয়ে যদি একটু নাচ জানে, গান বোঝে, অভিনয় ও ছলাকলায় পারদর্শী হয়- ভালো জায়গায় বিয়ে দেওয়া যাবে। কপাল ভালো হলে বিদেশি পাত্রও জুটতে পারে।
আজকাল ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারের ভিডিওকলে সহজেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারা যায়। পাত্র-পাত্রী মোবাইল ফোনে একে অপরকে পুষ্পমাল্য পরাতে পারে না, তাকে কী! দিন-ভর তাদের মধ্যে যেসব কথার সূচনা হয় তা কি কোনো অংশে কম!
হায়াজটে ভর্তির তৃতীয় দিনের মাথায় শাম্মী বাবা-মাকে ডেকে বলল, স্মার্টফোনে হিন্দি গান প্লে কর, তোমাদের নাচ দেখাব। মুম্বাইয়ের নায়িকাদের অনুকরণে শাম্মী খ্যামটা নাচ দেখিয়ে চলল; এমন প্রত্যয়ও ব্যক্ত করল চাইলে সে যে কোনো হিন্দি, তামিল, তেলেগু নায়িকাকে ওপেন চ্যালেঞ্জ দিয়ে অভিনয় করতে পারে। গায়ের রংটা একটু চাপা- তাতে কী!
ভালো মেকআপম্যানের হাতে পড়লে তিলোত্তমা হতে কতক্ষণ! কাজল আগরওয়াল, বিপাশা বসুর মতো সুন্দরীরা যদি খ্যাতির শীর্ষে উঠতে পারে, শাম্মীর পিছিয়ে থাকার কোনো যুক্তি নেই। বাবা-মা গানসহযোগে নৃত্য দেখার পর এমন সব আত্মবিশ্বাসী বাক্যও শ্রবণ করলেন। শেষে বাবা মাথা চুলকে বললেন, ‘এখন আমাদের কী করতে বলিস?’
শাম্মী মিষ্টি হেসে বলল, ‘বোকার মতো কথা বল কেন! বুঝতে পারছ না- এখন আমার হিন্দি ভাষা কোর্সে ভর্তি হওয়া জরুরি। নইলে শাহরুখ, আমির, সালমান খানদের সঙ্গে কথা বলব কীভাবে? ঋত্বিক রোশন, প্রভাসের সঙ্গে না হয় ইংরেজিতে বললাম! তারা আমার বাংলার আদলে ইংরেজি বুঝবে হয়তো।’
মা আহত ভঙ্গিতে বললেন, ‘তোকে হায়াজটে ভর্তি করাতে দুই লাখ টাকা খরচ হলো, এখন আবার হিন্দি-উর্দুর কোর্স!’
শাম্মী মুখ ঝামটে বলল, ‘থাক মা, আমার কিছুই লাগবে না। পড়ে থাক তোমাদের ওই পুতুপুতু বাঙালিয়ানা সেন্টিমেন্ট নিয়ে!’
বাবা প্রবোধ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘রাগ করছিস কেন! উত্তরাচলে পুস্তক সমাবেশ হচ্ছে। ওখান থেকে হিন্দি-তামিল যেসব ভাষা শিখতে চাস- বই নিয়ে আয়।’
এমন প্রস্তাবে ঝলমল করে উঠল শাম্মীর মুখ। হাত বাড়িয়ে বলল, ‘গিভ মি সাম মানি’।
ভ্যানিটি ব্যাগে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে শাম্মী পুস্তক সমাবেশস্থলে পৌঁছাল। দেখল তিনশ টাকায় টিকিট কিনে লোকজন পিলপিল করে পুস্তক সমাবেশের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে গেল ওর। এদ্দিন জানত পুস্তক সমাবেশে প্রবেশ মূল্য নেই। ভেতরে ঢুকে আরও অবাক হলো শাম্মী। পুস্তক কোথায়, এখানে তো সব খাবারের দোকান!
চারপাশে দেখা যাচ্ছে চমকপ্রদ নামের আন্তর্জাতিক মানের সব হোটেল- মেলবোর্ন বিরিয়ারি, নয়াদিল্লি লাচ্ছি, নিউইয়র্ক তেহারি, সিডনি ফুচকা হাউজ, লন্ডনি মিষ্টি পান, প্যারিস কাচ্চি...। কিছুক্ষণের মধ্যে ওর ভুল ভাঙল। লোকজন নাকি আজকাল পড়তে চায় না, তাই সংস্কৃতি উদ্ধারবিষয়ক কর্মকর্তারা বুদ্ধি করে প্রত্যেক খাবারের দোকানে বই ফ্রি দেওয়া বাধ্যতামূলক করেছেন।
শাম্মী ঘুরে দেখল চারপাশ। লোভনীয় ঘ্রানে ভরে যাচ্ছে ওর বুক। বিজ্ঞাপনভাষ্য বলছে-এক প্লেট বিরিয়ানি খেলে দুইটা বই ফ্রি! কোনো কোনো দোকানে দিচ্ছে তিনটা/চারটা করেও। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ গবেষণা-খাদকের চাহিদা অনুযায়ী বই মিলছে। সেলিব্রেটি সব ইউটিউবার ও ফেসবুকাররা এখন লেখক। সংবাদপত্রের পত্রলেখকরা প্রকাশ করছে গবেষণামূলক প্রবন্ধগ্রন্থ। লেখকরা সব বড় বড় ডেকচির সামনে বসে হাঁকডাক দিচ্ছেন- আসুন, বিরিয়ানি খান, বই নিয়ে যান। অটোগ্রাফ ফ্রি!
শাম্মীর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া একজন ভদ্রলোক বিড়বিড় করে বললেন, ‘কোনো ভর্তা-ভাজি নেই, ডাল-সবজি নেই-যেদিকেই তাকাই বিরানি হাউজ! আবার ভুলভাল বাক্যে অশুদ্ধ ভাবনার মাগনা বইও দিচ্ছে।’
শাম্মী ভেবে পেল না, এমন চমৎকার অফারটা লুফে না নিয়ে উনি বিরক্ত হচ্ছেন কেন! চারপাশে হাজার হাজার মানুষ ঠিকই হাপুসহুপুস করে বিরিয়ানি খাচ্ছে আর ফ্রি বই নিয়ে বেরিয়ে আসছে। শাম্মী বলল, ‘হাই আঙ্কেল, কোনো প্রবলেম?’
‘না, মা। তোমার পরিচয়?’
‘আমার নাম Some-মি World। হায়াজটে অধ্যয়ন করি। তুম কৌন হ্যায়?’
‘আমি যে কে, আত্মপরিচয় আবিষ্কারের জন্যই পুস্তক সমাবেশে এসেছি। কিন্তু এখানে দেখছি তোমরা বিরানির দোকান খুলে রেখেছ!’
‘বিরিয়ানি ইজ অ্যা টেস্টি ফুড। আপনি কি গান শুনতে চান? আমি ভালো গাইতে পারি!’
‘আচ্ছা, মা। গাও দিকিনি একখান Gun!’
শাম্মী শুরু করল ‘আধুনিক’ রবীন্দ্রগান-ভরিষ দড়া-মাছে ছান্তিরও ভারি...!
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2023