মূল্যবৃদ্ধিতে ডিম আগে না মুরগি?
বিতর্কটা সেই প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে-ডিম আগে না মুরগি আগে? কেউ যদি বলে মুরগি আগেই ছিল, তখন প্রশ্ন আসে ডিম ছাড়া মুরগি জন্ম নিল কীভাবে?
আবার উলটো পথেও বিপদ, যদি বলেন ডিম আগে, তখন প্রশ্ন আসে ডিমটা পাড়ল কে? কী মুসিবত! তারচেয়ে এ বিতর্কের মাঝে আমরা না যাই।
বরং দেশের বাজারব্যবস্থায় ডিম এবং মুরগির এগিয়ে যাওয়ার যে প্রতিযোগিতা চলছে, আমরা সেদিকে কিছুটা আলোকপাত করতে পারি। কিছুদিন আগে মুরগির ডিমের হালি হাফ সেঞ্চুরি হাঁকানোয় চারদিকে গেল গেল রব উঠেছিল। ফেসবুকে বলিউডের বিভিন্ন ছবি মুক্তির আগে যে বয়কট রব ওঠে, সেরকম ডিম বয়কটের রব উঠল।
কয়েকদিন ফেসবুকসহ নানা মিডিয়া ব্যস্ত থাকল ডিমের এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির টপিক নিয়ে। তারপর অবশ্য সেটা একসময় সহনীয় দামে চলে এসেছিল। এখন আবারও বাড়তির দিকে দাম। তবু ডিম নিয়ে মাতামাতি কম। কিন্তু এসব দেখে তো নিশ্চিতভাবে মুরগি বেচারা বসে থাকতে পারে না।
পেলে-ম্যারাডোনা কিংবা হালের মেসি-কে সর্বকালের সেরা এ বিতর্ক যেমন অমীমাংসিত, তেমনি ডিম আগে না মুরগি আগে সেটাও তো অমীমাংসিতই একটা ব্যাপার ছিল।
তাই বলে দাম বাড়ার বিতর্কে মুরগিকে পেছনে ফেলে ডিম এগিয়ে যাবে তা তো আর ঘটতে দেওয়া যায় না। তাই এবার মুরগির পালা। সেও দেখিয়ে দিল বাজারে সে তথাকথিত ‘মুরগি’ হয়ে থাকতে আসেনি!
এ দেশে নিরীহ লোকদের অনেক সময় মুরগির সঙ্গে তুলনা করা হয়। তাতে মুরগিরও যে মাইন্ড করে না তা বলা যাবে না। যেমন মাইন্ড করে গরু। তার প্রমাণ আমরা প্রতিনিয়ত পাই। কেউ একটু ভুলভাল বললেই আমরা ‘গরু’র সঙ্গে তুলনা করে অবলীলায় বলে দিই, তার মাথায় গোবর আছে! ফলে গরুও এসব অবহেলা মুখ বুজে সহ্য করে দীর্ঘদিনের সাধনায় এখন নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে এবং প্রতি রমজান মাস এলে সে উচ্চতা একটু একটু করে বাড়ে, যা ঈদের আগের দিন পাহাড় সমান হয়ে ওঠে।
এক সময় এ দেশে এত বড় বড় আকাশচুম্বী ইমারত ছিল না। তখনকার বাড়িঘরগুলো এখনকার মতো ওপরের দিকে না বেড়ে আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। সবার বাড়িতেই ছোট-বড় উঠান ছিল, আর সেসব উঠানে থাকত হাঁস-মুরগির খোপ। গ্রাম-বাংলার প্রায় প্রতিটা ঘরেই খামার ছিল বলা যায়। তবে এত এত হাঁস-মুরগি পালনের পরও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো মুরগি খাওয়ার ক্ষেত্রে দুটো প্রধান নীতি অনুসরণ করতেন। বাড়ির কেউ অসুস্থ হলে তবে তাকে মুরগির ঝোল রান্না করে খাওয়ানো হতো। অথবা যদি কোনো মুরগি অসুস্থ হয়ে যেত তখন সেটাকেই জবাই করে খাওয়া হতো।
এটা ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারে মুরগি খাওয়ার তরিকা। তবে আসল কথা হলো এসব মুরগি ছিল ‘অতিথি’দের জন্য সংরক্ষিত। তখন তো আর পাড়ায়-মহল্লায় এমন ব্রয়লার কিংবা অন্যান্য মুরগির দোকান ছিল না যে, মেহমান এলেই দৌড়ে গিয়ে মুরগি এনে রান্না করা যাবে। তাই সেসব মুরগি মধ্যবিত্তের মেহমানদারির জন্যই পালন হতো। যখন ফার্মের মুরগি বা ব্রয়লার মুরগির আগমন ঘটল, তখন দেশের মধ্যবিত্ত তো বটেই, নিম্নবিত্তের পাতেও মুরগির দেখা মিলত, তা সেটার স্বাদ যেমনই হোক না কেন। সস্তায় মুরগির স্বাদ কিন্তু এ ব্রয়লার মুরগিই দিয়েছিল।
অথচ ডিমের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে আমজনতার সেই সস্তা মুরগিও এখন আগের তুলনায় প্রায় ডবল দামের হয়ে গেছে। ফলে মুরগি খেতে আবার আগের তরিকা বা নীতিতে ফিরতে হচ্ছে। মানে এখন আর নিয়মিত তরকারির পদ হিসাবে মুরগি খাওয়া যাবে না। তার জন্য দরকার হবে উপলক্ষের।
উপলক্ষের কথায় মনে পড়ল মুরগির সঙ্গে ইদানীং খাসির সম্পর্কের কথা! কী, অবাক হচ্ছেন? না, খাসির দাম এত কমে যায়নি যে মুরগির জায়গা সেটা দখল করবে। খাসি আগেও যেমন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল এখনো তাই আছে। মুরগির অবস্থাও তাই। উপলক্ষ ছাড়া এখন আর পাতে ওঠে না।
সিন্ডিকেট নামের অদৃশ্য শক্তি সুতায় টান দিলেই যেন দাম বাড়ে তরতর করে। কিন্তু সিন্ডিকেটের সুতায় টান দেওয়ার যেন কেউ নেই! আফসোস!
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
মূল্যবৃদ্ধিতে ডিম আগে না মুরগি?
বিতর্কটা সেই প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে-ডিম আগে না মুরগি আগে? কেউ যদি বলে মুরগি আগেই ছিল, তখন প্রশ্ন আসে ডিম ছাড়া মুরগি জন্ম নিল কীভাবে?
আবার উলটো পথেও বিপদ, যদি বলেন ডিম আগে, তখন প্রশ্ন আসে ডিমটা পাড়ল কে? কী মুসিবত! তারচেয়ে এ বিতর্কের মাঝে আমরা না যাই।
বরং দেশের বাজারব্যবস্থায় ডিম এবং মুরগির এগিয়ে যাওয়ার যে প্রতিযোগিতা চলছে, আমরা সেদিকে কিছুটা আলোকপাত করতে পারি। কিছুদিন আগে মুরগির ডিমের হালি হাফ সেঞ্চুরি হাঁকানোয় চারদিকে গেল গেল রব উঠেছিল। ফেসবুকে বলিউডের বিভিন্ন ছবি মুক্তির আগে যে বয়কট রব ওঠে, সেরকম ডিম বয়কটের রব উঠল।
কয়েকদিন ফেসবুকসহ নানা মিডিয়া ব্যস্ত থাকল ডিমের এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির টপিক নিয়ে। তারপর অবশ্য সেটা একসময় সহনীয় দামে চলে এসেছিল। এখন আবারও বাড়তির দিকে দাম। তবু ডিম নিয়ে মাতামাতি কম। কিন্তু এসব দেখে তো নিশ্চিতভাবে মুরগি বেচারা বসে থাকতে পারে না।
পেলে-ম্যারাডোনা কিংবা হালের মেসি-কে সর্বকালের সেরা এ বিতর্ক যেমন অমীমাংসিত, তেমনি ডিম আগে না মুরগি আগে সেটাও তো অমীমাংসিতই একটা ব্যাপার ছিল।
তাই বলে দাম বাড়ার বিতর্কে মুরগিকে পেছনে ফেলে ডিম এগিয়ে যাবে তা তো আর ঘটতে দেওয়া যায় না। তাই এবার মুরগির পালা। সেও দেখিয়ে দিল বাজারে সে তথাকথিত ‘মুরগি’ হয়ে থাকতে আসেনি!
এ দেশে নিরীহ লোকদের অনেক সময় মুরগির সঙ্গে তুলনা করা হয়। তাতে মুরগিরও যে মাইন্ড করে না তা বলা যাবে না। যেমন মাইন্ড করে গরু। তার প্রমাণ আমরা প্রতিনিয়ত পাই। কেউ একটু ভুলভাল বললেই আমরা ‘গরু’র সঙ্গে তুলনা করে অবলীলায় বলে দিই, তার মাথায় গোবর আছে! ফলে গরুও এসব অবহেলা মুখ বুজে সহ্য করে দীর্ঘদিনের সাধনায় এখন নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে এবং প্রতি রমজান মাস এলে সে উচ্চতা একটু একটু করে বাড়ে, যা ঈদের আগের দিন পাহাড় সমান হয়ে ওঠে।
এক সময় এ দেশে এত বড় বড় আকাশচুম্বী ইমারত ছিল না। তখনকার বাড়িঘরগুলো এখনকার মতো ওপরের দিকে না বেড়ে আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। সবার বাড়িতেই ছোট-বড় উঠান ছিল, আর সেসব উঠানে থাকত হাঁস-মুরগির খোপ। গ্রাম-বাংলার প্রায় প্রতিটা ঘরেই খামার ছিল বলা যায়। তবে এত এত হাঁস-মুরগি পালনের পরও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো মুরগি খাওয়ার ক্ষেত্রে দুটো প্রধান নীতি অনুসরণ করতেন। বাড়ির কেউ অসুস্থ হলে তবে তাকে মুরগির ঝোল রান্না করে খাওয়ানো হতো। অথবা যদি কোনো মুরগি অসুস্থ হয়ে যেত তখন সেটাকেই জবাই করে খাওয়া হতো।
এটা ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারে মুরগি খাওয়ার তরিকা। তবে আসল কথা হলো এসব মুরগি ছিল ‘অতিথি’দের জন্য সংরক্ষিত। তখন তো আর পাড়ায়-মহল্লায় এমন ব্রয়লার কিংবা অন্যান্য মুরগির দোকান ছিল না যে, মেহমান এলেই দৌড়ে গিয়ে মুরগি এনে রান্না করা যাবে। তাই সেসব মুরগি মধ্যবিত্তের মেহমানদারির জন্যই পালন হতো। যখন ফার্মের মুরগি বা ব্রয়লার মুরগির আগমন ঘটল, তখন দেশের মধ্যবিত্ত তো বটেই, নিম্নবিত্তের পাতেও মুরগির দেখা মিলত, তা সেটার স্বাদ যেমনই হোক না কেন। সস্তায় মুরগির স্বাদ কিন্তু এ ব্রয়লার মুরগিই দিয়েছিল।
অথচ ডিমের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে আমজনতার সেই সস্তা মুরগিও এখন আগের তুলনায় প্রায় ডবল দামের হয়ে গেছে। ফলে মুরগি খেতে আবার আগের তরিকা বা নীতিতে ফিরতে হচ্ছে। মানে এখন আর নিয়মিত তরকারির পদ হিসাবে মুরগি খাওয়া যাবে না। তার জন্য দরকার হবে উপলক্ষের।
উপলক্ষের কথায় মনে পড়ল মুরগির সঙ্গে ইদানীং খাসির সম্পর্কের কথা! কী, অবাক হচ্ছেন? না, খাসির দাম এত কমে যায়নি যে মুরগির জায়গা সেটা দখল করবে। খাসি আগেও যেমন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল এখনো তাই আছে। মুরগির অবস্থাও তাই। উপলক্ষ ছাড়া এখন আর পাতে ওঠে না।
সিন্ডিকেট নামের অদৃশ্য শক্তি সুতায় টান দিলেই যেন দাম বাড়ে তরতর করে। কিন্তু সিন্ডিকেটের সুতায় টান দেওয়ার যেন কেউ নেই! আফসোস!