জাহাজের ব্যাপারীর আদার খোঁজ

 মো. রায়হান কবির  
২৮ মে ২০২৩, ১১:৪২ এএম  |  অনলাইন সংস্করণ
টুনি
টুনির মা, এই দেখো বিশ্বের সবচেয়ে ছোট পেঁয়াজ আর আদা! ছবি তুলে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিবা নাকি!

আজকাল চায়ের দোকানে নানা ধরনের চা পাওয়া যায়। তবে বৈচিত্র্য যতই থাকুক, এদেশে দুটো ফ্লেভার খুবই জনপ্রিয়, আর তা হলো দুধ-চা এবং আদা-চা। র’চা বলতে আমরা আদা-চাকেই বুঝে থাকি। বলা যায় চা দোকানিরা আমাদের সেভাবে বুঝতেই বাধ্য করেছেন।

কিন্তু আদার দাম চড়তে চড়তে চায়না আদা কেজিপ্রতি ৫০০ টাকা ছুঁয়ে ফেলায় র’চা-এর সংজ্ঞায় লেবুর রাজত্ব বেড়ে গেল। যদিও লেবুও মাত্র কদিন আগেই এলিট শ্রেণি থেকে বেরিয়ে সাধারণ কাতারে এসেছে। ভাগ্যিস এখন শীতকাল না, তা না হলে আমাদের চা দোকানিরা কাঁচা হলুদ খাইয়ে দিতেন আদার পরিবর্তে। দেখতে আদার মতো বলে! তখন হয়তো যুক্তি দিত, ভারতে দুধের সঙ্গে হলুদ খাওয়া হয়, স্বাস্থ্যকর খাবার হিসাবে। আমরা না হয় স্বাস্থ্যকর চা পান করলাম!

আমাদের ব্যাপারীরা প্রায় সব দিক থেকেই স্মার্ট। তারা মুনাফা করায় যেমন স্মার্ট, তেমনি বিকল্প খাওয়ানোর ব্যাপারেও জুড়ি নেই তাদের। এদেশে অনেকের কাছে অর্থনীতির পরিমাপক চাহিদা, সরবরাহ ইত্যাদির দরকার পড়ে না অর্থনৈতিক হিসাবের জন্য। কোনো ব্যবসায়ীর যদি মুনাফায় ঘাটতি হয়, তাহলে তিনি নিজেই এসব চাহিদা, সাপ্লাই ইত্যাদি ইত্যাদি তৈরি করে পণ্যের দাম নির্ধারণ করতে পারেন।

ঘরের বাইরে পা দেওয়ার পর থেকেই আপনি টের পাবেন এদেশের রহস্যময় অর্থনীতির তেজ। আপনি যখন সকালে ঘর থেকে বের হয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য রিকশা খোঁজেন, তখন পিক আওয়ার। তাই ১০ টাকার ভাড়া ২০ টাকা! আবার সকালের পরিবর্তে দুপুরে যাবেন, রোদের জন্য ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ! বিকালে আপনার গন্তব্য থেকে রিকশা নিয়ে খালি ফিরতে হবে, এই অজুহাতে ভাড়া ফের দ্বিগুণ! অর্থাৎ দ্রুত বর্ধনশীল এ অর্থনীতি কীভাবে দ্রুত বাড়ছে তার আঁচ আপনি হাড়ে হাড়ে টের পাবেন।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যে কোনো পণ্যের দাম বাড়ে সরবরাহের ওপর। আর আমাদের চাহিদা, সরবরাহের কোনো বালাই নেই। অন্য বিক্রেতার পণ্যের দাম বেড়েছে তো আমি কি বসে থাকব? এমনকি আমার পণ্যের ভরা মৌসুম হলেও আমি সে পণ্যের দাম বাড়াতে আপ্রাণ চেষ্টা করব। প্রয়োজনে গহনায় ব্যবহৃত সোনা মেখে হলেও আমাদের আকাশ ছোঁয়া দাম নির্ধারণ করতে হবে। তাই স্বাভাবিক দামের জিলেপি হয়ে যায় ২০ হাজার টাকা কেজি! যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের দেশের একজন গ্র্যাজুয়েট পাস ছেলের এক মাসের বেতনের চেয়েও বেশি হয়তো! এখনো এদেশের সদ্য পাস করা গ্র্যাজুয়েটদের চাকরিতে ঢুকতে ১০-১৫ হাজার টাকা বেতন অফার করা হয়। সেখানে ২০ হাজার টাকার জিলেপিও স্টক আউট হয়! সুতরাং দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির ম্যাজিক এখান থেকেই কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।

কথায় আছে সবারই একটা সময় আসে। আমাদের ব্যাপারীরাও সেই সমীকরণ নিয়ে বসে থাকেন। মাছ, মাংস, মুরগি, এমনকি সবজির দামও যখন বেড়ে আকাশ ছুঁয়ে ফেলে তখন আদা, রসুন, পেঁয়াজই বা বসে থাকবে কেন?

গরম মসলা তো নিয়মিতভাবেই গরম হচ্ছে। তাই এবার ঐতিহাসিকভাবে অবহেলিত আদার ব্যাপারীরা তাদের জাত চিনিয়ে দিলেন। বই-পুস্তক, নাটক-সিনেমায় সবাই শুনে এসেছেন, আদার ব্যাপারী জাহাজের খবর নেবে কেন? এবার অত্যন্ত যৌক্তিকভাবেই তারা জাহাজের খবর দিয়ে, আমাদের খবর করে দিয়েছেন। মানে জাহাজে আসা চীনের আদার দাম এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, আদা যে আসলেই জাহাজে আসে, তা যেন পাবলিক হাড়ে হাড়ে টের পায়!

আর যাতে কখনোই এমন অপমানজনক কথা অন্তত আদার ব্যাপারীদের বলা না হয়। তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করা হয়। এখন তারাও জাহাজের খবর নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।

মজার ব্যাপার হলো, করপোরেট হাউজগুলো জিনিসের দাম বাড়ায় সোনা মেখে। আর কাঁচাবাজারের লোকেরা দাম বাড়ায় পণ্য লুকিয়ে রেখে বা মজুত করে। বাজারভরা পণ্য, দামও নাগালের ভেতর, এর ভেতরই একদিন খেয়াল করবেন বাজার থেকে সব উধাও! সবার ভেতর প্যানিক কাজ করে। দাম দ্বিগুণ হলেও আমজনতাও তখন মজুত করতে থাকে আরও দাম বৃদ্ধির আশঙ্কায়। ফলে ব্যবসায়ী দ্য ম্যাজিকম্যান যা চান, ঠিক তাই হয়। বাজারে পণ্য নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। উচ্চবিত্তরা ব্যাগ ভরে সব নিয়ে যান, আর দরিদ্ররা খালি ব্যাগ নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে চিন্তা করেন, মানুষের পকেটে এত টাকা আসে কোত্থেকে? আর এদিকে আদার ব্যাপারীরা শুধু তাদের আদা বোঝাই জাহাজেরই খবর নিচ্ছেন না, এখন তারা খবর নিতে পারেন টাইটানিকের মতো জাহাজেরও। 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন