মনোহরগঞ্জে ৮০০ বছরের ঐতিহ্য ‘রাখাল রাজা’ স্মৃতিচিহ্ন
এমএ মান্নান, লাকসাম-মনোহরগঞ্জ (কুমিল্লা)
প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ১০:০৮ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ব্রিটিশ শাসনামলে এ দেশে জমিদারি প্রথা ছিল। সেই সময় জমিদারদের ছিল প্রচণ্ড প্রতাপ। এখন সেই প্রথা নেই, কিন্তু আছে জমিদারদের রেখে যাওয়া পরিত্যক্ত স্মৃতিচিহ্ন। ইট-সুরকির ভগ্নস্তূপের দিকে তাকালে অতীত টের পাওয়া যায়। একসময় জৌলুশ ছিল, প্রাণের স্ফুরণ ছিল, আজ কিছুই নেই। জমিদার বাড়ির সামনে দাঁড়ালে এমন অনুভূতি হতে পারে আপনার।
কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় মনোহরগঞ্জ উপজেলার হাসনাবাদ ইউনিয়নে কমলপুর গ্রামে রয়েছে ৮০০ বছরের এমন একটি স্মৃতিচিহ্ন। যা ‘রাখাল রাজা জমিদার বাড়ি’ নামে পরিচিত। অত্যাচারী জমিদার রাখাল রাজার নির্মিত এ বাড়িটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক ইতিহাস।
জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে বাড়িটি। সংস্কারের অভাবে এটি একটি ভুতুড়ে এলাকায় পরিণত হয়েছে। সেই প্রতাপশালী জমিদার রাখাল রাজার রাজত্বের শেষ চিহ্ন এ বাড়িটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
ঐতিহাসিক প্রাচীন এ স্থাপনাটি অযত্ন, অবহেলা আর সংরক্ষণের অভাবে জৌলুস হারিয়েছে অনেক আগেই। কারুকার্য খচিত জরাজীর্ণ বাসভবন, বৈঠকখানা ও শিব মন্দিরের দেওয়ালজুড়ে বেয়ে উঠছে লতাপাতা।
তবুও দর্শনীয় স্থান হিসেবে প্রাচীন এ বাড়িটি একনজর দেখতে এখনও বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসেন বিভিন্ন পেশার লোকজন। কেউ টিকটক ভিডিও করছেন, কেউবা প্রিয়জনদের সঙ্গে ছবি তুলছেন। আবার কেউবা মাদকসেবনের জন্য এ বাড়িটি বেছে নিয়েছে।
১৭০০ শতাব্দীর শেষের দিকে জমিদার রাখাল রাজা কমলপুর নামক এলাকায় অর্ধশতাধিক একর জায়গাজুড়ে এই জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন। জমিদার রাখাল রাজা ছিলেন অত্যাচারী জমিদার। তিনি এলাকার মুসলিম সুন্দরী নারীদের পাইক-পেয়াদা দিয়ে ধরে নিয়ে নির্যাতন করতেন। পরবর্তীতে তাদের মেরে ফেলতেন। এসব অত্যাচারের ফলে অনেক মুসলিম পরিবার এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। একপর্যায়ে এলাকার সব মুসলমান একত্রিত হয়ে জমিদার রাখাল রাজার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে শুরু করেন। এ আন্দোলনের মুখে জমিদার রাখাল রাজা তার পরিবার নিয়ে অন্যত্র পালিয়ে যান।
স্থানীয়রা জানান, জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর বাড়িটি জমিদার রাখাল রাজার বংশধরদের মালিকানাধীন এখন আর নেই। তৎকালীন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন রাখাল রাজার সব সম্পত্তি দখলে নিয়ে বসবাস শুরু করে। জমিদার বাড়ি, কয়েকটি পুকুর ও দীঘি হিন্দু পরিবারের গিরিশ চন্দ্র মজুমদার ও কালা মনা মজুমদার নামে দুই ব্যক্তি দখলে নিয়ে গেলেও বসবাস করতে পারেননি বেশি দিন।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে এ অঞ্চলের চইয়ান বাড়ির বাসিন্দা (মুসলিম পরিবারের সন্তান) মজিদ পণ্ডিতের কাছে প্রায় ৩২ একর সম্পত্তি বিক্রি করে ভারতে চলে যান গিরিশ চন্দ্র মজুমদার ও কালা মনা মজুমদারসহ হিন্দু পরিবারের লোকজন।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের আগে মজিদ পণ্ডিতের মৃত্যু হয়। তার বংশধর তিন ছেলের মধ্যে ১৯৭৪ সালে ডা. জয়নাল আবেদীনের মৃত্যু হয়। আবদুল বারেক ও আবদুল মুনাফের মৃত্যুর সঠিক সময় জানা যায়নি। তবে যুদ্ধের পরে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।
মজিদ পণ্ডিতের বংশধরের মধ্যে জয়নাল আবেদীনের ছেলে ডা. ফারুক এ বাড়িতে থাকেন না। বর্তমানে তিনি পরিবার নিয়ে আমেরিকায় বসবাস করছেন। এ বাড়িতে ডা. ফারুকের আত্মীয়স্বজন থাকেন বলে জানান স্থানীয়রা।
সম্প্রতি সরেজমিন বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, প্রবেশ মুখে দুটি সুন্দর কারুকার্য খচিত বৈঠকখানা, শিব মন্দিরের দেওয়ালজুড়ে বেয়ে উঠেছে লতাপাতা। বাড়ির পশ্চিমে দেখা মিলে দরজা-জানালাবিহীন একটি দোতলা ভবন।
ভবনের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে ময়লা আবর্জনার স্তূপ। যেখানে-সেখানে মলমূত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতেও দেখা দেখা যায়। প্রতিটি কক্ষে খসে পড়ছে ছাদ ও দেওয়ালের পলেস্তারা। দেওয়ালজুড়ে বেয়ে উঠেছে লতাপাতা। ভবনের দরজা-জানালা খুলে নিয়ে গেছে সংঘবদ্ধ চোরের দল। ভবনের ইট-পাথরও খুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নিচতলায় পশ্চিম দিকের কক্ষে দেখা গেছে বড় বড় মাটির গর্ত, সেগুলোর উপর টিন দিয়ে ঢাকনা দেওয়া রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এক মাস আগে রাতের বেলায় কে বা কারা মাটি গর্ত করে হয়তো জমিদারের গুপ্ত সম্পদ নিয়ে গেছে।
ভবনের সামনে উঠানে দেখা মিলে দুই ব্যক্তির। তারা হলেন মৃত ডা. জয়নাল আবেদীনের আত্মীয়। এ বাড়িতে বসবাস করেন আবদুল বাতেন (৬০) ও পাশের ঘরের বাসিন্দা আলমগীর হোসেনের স্ত্রী।
তারা জানান, জয়নাল আবেদীনের ছেলে ডা. ফারুক সাহেব তার পরিবার নিয়ে আমেরিকা থাকেন, মাঝে মধ্যে দেশে আসেন। তার অনুরোধে তিনি এ বাড়িতে থাকেন। পরিত্যক্ত প্রাচীন এ ভবনগুলো একনজর দেখতে বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসেন লোকজন। কাউকে কিছু বলতেও পারি না আমরা। সন্ধ্যার পর ভবনের ভেতরে ঢুকে আড্ডা দেয়। ওরা ভবনের ভেতরে গিয়ে কি করে তাও ভয়ে দেখতে যাই না।
আবদুল বাতেন বলেন, ২০০৬ সালে দেশে এসে ডা. ফারুক সাহেব তার বাবা-মায়ের নামে একটি হাসপাতাল করার জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। জমিদারদের রেখে যাওয়া যেসব ভবন রয়েছে সেগুলো সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। এজন্য এলাকার লোকজন ও সরকারিভাবে সহযোগিতা না পাওয়ার কারণে তিনি কিছুই করতে পারেননি। ২০১২ সালে এ বাড়িতে ডাকাতরা হামলা চালায়। ডাকাতের হামলায় বাতেন গুরুতর আহত হন বলে তিনি জানান।
স্থানীয় জনতা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আইয়ুব আলী যুগান্তরকে বলেন, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন নানা ধরনের ফল খাওয়ার জন্য জমিদার বাড়িতে যাওয়া হতো। এখন আর সেখানে কোনো ফলের গাছ দেখি না। বাড়ির মালিক ডা. ফারুক সাহেব একসময় উদ্যোগ নিয়েছিলেন এ জায়গায় তিনি একটি হাসপাতাল করবেন। পরিত্যক্ত ভবনও সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। সরকারিভাবে কোনো সহোযোগিতা না পাওয়ায় তা আর হয়নি।
তিনি বলেন, প্রাচীন এ বাড়িটি একনজর দেখতে এখনও বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসেন পর্যটকরা। সরকারি-বেসরকারি কোনো ধরনের তদারকি না করায় এটি জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া জমিদার বাড়ি ও পুকুর-দীঘিরপাড়ে বহিরাগত মাদকসেবীদের আড্ডার কারণে এলাকার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আড্ডার হাত থেকে বাড়িটি রক্ষা করার জন্য প্রশাসনের কাছে আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।
