‘বিশ্বাস করেন, বড়ই কষ্টে আছি’
পবিত্র তালুকদার, চাটমোহর (পাবনা)
১৫ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:০৯:১৫ | অনলাইন সংস্করণ
মুখভর্তি সাদা দাড়ি। পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি। অভাবের তাড়নায় কখনও পেট ভরে খাওয়া হয় না! ভাঙাচোরা টিনের ঘর। ঘুনে ধরা চোকি। এলোমেলো ময়লা বিছানায় রাতযাপন। গায়ের জামা-কাপড়ও মানুষের দেয়া। হতাশায় নিমজ্জিত এই বৃদ্ধের নাম আমির হামজা (৭০)। তবে এলাকার সবাই তাকে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ আমির হামজা নামে চেনেন।
কী ভাগ্যের নির্মম পরিহাস; স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও মেলেনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি! ভারতে প্রশিক্ষণ, পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরে অংশগ্রহণ এবং দেশ স্বাধীনের পর অস্ত্রসর্মপণসহ বিভিন্ন ধরনের সনদপত্র থাকার পরও অজ্ঞাত কারণে তালিকায় নাম নেই পাবনার চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা ইউনিয়নের কাটেঙ্গা হিন্দুপাড়া গ্রামের মৃত জামাল উদ্দিনের ছেলে আমির হামজার।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালেও মানবেতর জীবনযাপন করছেন এ বীর মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি জানান, বিশ্বাস করুন– বড়ই কষ্টে দিনযাপন করছি। মৃত্যুর আগে অন্তত মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে চাই।
জানা যায়, বয়সের ভারে কর্মক্ষমতা হারানোয় সংসারে জেঁকে বসেছে অভাব। সরকারি খাস জায়গার ওপর টিনের দুটি ছাপড়াঘরে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাস করেন তিনি। দিনমজুরের কাজ করেন স্ত্রী সেলিনা খাতুন। ফরম ফিলাপের টাকা দিতে না পারায় অনার্স পড়ুয়া একমাত্র ছেলে আওরঙ্গজেব সেলিম রাগ করে বাড়ি ছেড়েছেন। খোঁজ নেই তার! বড় তিন মেয়ের বিয়ে হলেও তাদের মধ্যে মেজ ও সেজ মেয়ে গার্মেন্টকর্মী।
চতুর্থ মেয়ে মেরিনা খাতুন ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন। ছোট মেয়ে শিরিনা খাতুন এবার এইচএসসি পাস করেছে। আমির হামজা একসময় মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতা পেলেও দীর্ঘ ৫ বছর ধরে সেটি বন্ধ রয়েছে।
বয়সের ভারে ন্যুব্জ আমির হামজার এখন দিন কাটে অর্ধহারে-অনাহারে। পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি। তবে জীবন সায়াহ্নে এসে অন্তত মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি টুকু চান বৃদ্ধ আমির হামজা।
আমির হামজা জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শোনার পর বাড়িতে কাউকে না বলে এলাকার পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে যান। প্রথমে গুরুদাসপুর এবং পরে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ এলাকার পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
এর পর সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় থেকে পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করার সময় ট্রেনিং নিতে পায়ে হেঁটে নভেম্বর মাসে ভারতে যান। প্রশিক্ষণের মাঝামাঝি সময়ে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। এর পর ফিরে আসেন বাংলাদেশে।
তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত নিয়মিত সম্মানী ভাতা পেয়েছি। এ ছাড়া গেজেটে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করেছিলাম। তৎকালীন ইউএনও শফিকুল ইসলাম তদন্ত প্রতিবেদনে আমাকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা উল্লেখ করে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন।
এ ছাড়া যেগুলো সনদপত্র প্রয়োজন তার সবই আমার কাছে আছে। যাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম তারাও প্রত্যয়ন দিয়েছে। তা হলে তালিকায় নাম থাকবে না কেন? বিশ্বাস করুন, বড়ই কষ্টে দিনযাপন করছি। মৃত্যুর আগে অন্তত মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে চাই।
আমির হামজার ব্যাপারে জানতে চাইলে একই গ্রামের সমবয়সী স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) পাবনা জেলা শাখার সভাপতি ডা. গোলজার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আমির হামজা একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। আমরা যুদ্ধকালীন তার নামডাক শুনেছি। কেন তার নাম তালিকায় বাদ পড়ল সেটি বুঝতে পারলাম না! তবে ভাতা বন্ধ হওয়ার পর তিনি মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
আশা করি আমির হামজার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কিছু একটা করবে।
জানতে চাইলে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার এসএম মোজাহারুল হক যুগান্তরকে বলেন, একসময় আমি নিজে চেষ্টা করে আমির হামজাকে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানীর ভাতা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে তালিকায় নাম ওঠানোর জন্য তাকে ঢাকায় মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতেও বলেছিলাম। এখন কোনো তালিকায় তার নাম নেই। আগামীতে যাচাই-বাছাই হলে বিষয়টির ব্যাপারে সহযোগিতা করবেন বলে বলেন তিনি।
জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈকত ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমি সদ্য এ উপজেলায় যোগদান করেছি। বিষয়টি সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। আমি সাবেক কমান্ডার সাহেবের সঙ্গে কথা বলে এবং কাগজপত্র দেখে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৪০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
‘বিশ্বাস করেন, বড়ই কষ্টে আছি’
মুখভর্তি সাদা দাড়ি। পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি। অভাবের তাড়নায় কখনও পেট ভরে খাওয়া হয় না! ভাঙাচোরা টিনের ঘর। ঘুনে ধরা চোকি। এলোমেলো ময়লা বিছানায় রাতযাপন। গায়ের জামা-কাপড়ও মানুষের দেয়া। হতাশায় নিমজ্জিত এই বৃদ্ধের নাম আমির হামজা (৭০)। তবে এলাকার সবাই তাকে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ আমির হামজা নামে চেনেন।
কী ভাগ্যের নির্মম পরিহাস; স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও মেলেনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি! ভারতে প্রশিক্ষণ, পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরে অংশগ্রহণ এবং দেশ স্বাধীনের পর অস্ত্রসর্মপণসহ বিভিন্ন ধরনের সনদপত্র থাকার পরও অজ্ঞাত কারণে তালিকায় নাম নেই পাবনার চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা ইউনিয়নের কাটেঙ্গা হিন্দুপাড়া গ্রামের মৃত জামাল উদ্দিনের ছেলে আমির হামজার।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালেও মানবেতর জীবনযাপন করছেন এ বীর মুক্তিযোদ্ধা।