করোনাকালে জলঢাকায় বেড়ে গেছে বাল্যবিয়ে
সফিকুল ইসলাম, জলঢাকা (নীলফামারী)
০৪ জুলাই ২০২১, ১৯:৫৩:৪৮ | অনলাইন সংস্করণ
নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলায় করোনাকালে আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে গেছে বাল্যবিয়ের প্রবণতা। এ হার এখন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
বাল্যবিয়ের মূল কারণ হিসেবে দরিদ্রতা এবং করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাকেই দায়ী করছেন বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটির নেতাকর্মীরা।
এ নিয়ে তেমন তথ্য নেই সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। যদিও তারা দাবি করছেন, বাল্যবিয়ে বন্ধে তৎপর রয়েছেন তারা।
উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি হয়ে যাওয়ার প্রবণতা। এক্ষেত্রে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন তাদের কন্যা সন্তানরাই বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে বেশি- এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে উপজেলাজুড়ে।
বাল্যবিয়ের শিকার জলঢাকা উপজেলার বালাগ্রাম ইউনিয়নের ১৩ বছর বয়সী সোনিয়া। সংসারের কাজে ব্যস্ত এখন সে। সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরে তার জীবনের ঘটে যাওয়া কষ্টের ঘটনাগুলো।
সোনিয়া জানায়, মাসখানেক আগে বিয়ে হয়েছে তার। স্থানীয় একটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়তো সে। অভাবের সংসার বাবা নেই, এছাড়া স্কুলও করোনাকালে অনেক দিন থেকে বন্ধ। তাই ধারদেনা করে আমার বিয়ে দিয়েছে পরিবার।
পড়াশুনা করতে চেয়েছিল কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে জানালো- স্বপ্ন ছিল পড়াশুনা করব, নিজের পায়ে দাঁড়াব; কিন্তু তা আর হলো না।
সোনিয়ার মতো আরও এক কিশোরীর দেখা মিলল। তার বয়স ১৬-১৭ হবে। কোলে আড়াই বছরের শিশু নিয়ে সেও জানালো তার জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। ১৪ বছর বয়সে তার বিয়ে দেয়া হয়। শ্বশুরবাড়িতে এসে সব কাজের দায়িত্ব তার ওপর পড়ে। সংসারের অনেক কিছুই সে তখন বুঝত না। পদে পদে বিড়ম্বনা এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজনের লাঞ্ছনার শিকার হতে হয় তাকে প্রতিনিয়ত।
এছাড়াও বাল্যবিয়ের কবলে পড়ে সংসারের ঘানি টানছে রিক্তা-পাপড়ির মতো অনেক কিশোরী। জলঢাকা উপজেলার চাঁদমনি অনাথ আশ্রমে দীর্ঘ দিন ধরে অসহায়, অভাবে থাকা ও সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরীরা বিনা পয়সায় লেখাপড়া করে। বর্তমানে মহামারি পরিস্থিতিতেও ৩৫ জনের মতো কিশোরী রয়েছে।
আশ্রমটির প্রতিষ্ঠাতা পিজিরুল আলম দুলাল জানান, করোনার প্রাদুর্ভাবে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল তখন অভিভাবকরা তাদের বাচ্চাদের নিয়ে যেতে শুরু করলেন। পরে খোঁজ নিয়ে দেখলাম অধিকাংশরাই তাদের মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন। যাদের বেশির ভাগেরই বয়স ১৩ থেকে ১৪ বছর।
তিনি আরও জানান, দরিদ্রতাই মূলত বাল্যবিয়ের কারণ, আর এ সময় যৌতুকের চাহিদা কম। এছাড়া করোনাকালীন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকা এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মনিটরিংয়ের অভাবেই বাল্যবিয়ে বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে।
কথা হয় কয়েকজন অভিভাবকদের সঙ্গে। তারা জানান, স্কুল বন্ধ, করোনার কারণে আয়-রোজগার বন্ধ। মেয়েকে বাড়িতে বেশি দিন রাখতে চান না। মেয়েকে সংসারি করতে এমন সিদ্ধান্ত তাদের।
অধিকাংশ অভিভাবকদেরই মতামত একই পাওয়া গেল।
উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএসের তথ্যমতে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন ৬৮ জন। আর করোনাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এ হার বেড়েছে দ্বিগুণ। তবে স্কুল বন্ধ থাকায় এ তথ্য হালনাগাদ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এএইচএম রেজওয়ানুল কবীর বলেন, শারীরিক অপরিপক্বতার কারণে গর্ভধারণসহ নানা জটিলতায় পড়তে পারেন বাল্যবিয়ের শিকার এসব কিশোরী। এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও রয়েছে।
তিনি বলেন, এ সময়টাতেই মূলত কিশোরীর শারীরিক গঠন পরিপক্ব হয়। এ সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জলঢাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব হাসান বলেন, বাল্যবিয়ে বন্ধে আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। আমরা যখনই খোঁজ পাই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
করোনাকালে জলঢাকায় বেড়ে গেছে বাল্যবিয়ে
নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলায় করোনাকালে আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে গেছে বাল্যবিয়ের প্রবণতা। এ হার এখন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
বাল্যবিয়ের মূল কারণ হিসেবে দরিদ্রতা এবং করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাকেই দায়ী করছেন বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটির নেতাকর্মীরা।
এ নিয়ে তেমন তথ্য নেই সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। যদিও তারা দাবি করছেন, বাল্যবিয়ে বন্ধে তৎপর রয়েছেন তারা।
উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি হয়ে যাওয়ার প্রবণতা। এক্ষেত্রে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন তাদের কন্যা সন্তানরাই বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে বেশি- এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে উপজেলাজুড়ে।
বাল্যবিয়ের শিকার জলঢাকা উপজেলার বালাগ্রাম ইউনিয়নের ১৩ বছর বয়সী সোনিয়া। সংসারের কাজে ব্যস্ত এখন সে। সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরে তার জীবনের ঘটে যাওয়া কষ্টের ঘটনাগুলো।
সোনিয়া জানায়, মাসখানেক আগে বিয়ে হয়েছে তার। স্থানীয় একটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়তো সে। অভাবের সংসার বাবা নেই, এছাড়া স্কুলও করোনাকালে অনেক দিন থেকে বন্ধ। তাই ধারদেনা করে আমার বিয়ে দিয়েছে পরিবার।
পড়াশুনা করতে চেয়েছিল কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে জানালো- স্বপ্ন ছিল পড়াশুনা করব, নিজের পায়ে দাঁড়াব; কিন্তু তা আর হলো না।
সোনিয়ার মতো আরও এক কিশোরীর দেখা মিলল। তার বয়স ১৬-১৭ হবে। কোলে আড়াই বছরের শিশু নিয়ে সেও জানালো তার জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। ১৪ বছর বয়সে তার বিয়ে দেয়া হয়। শ্বশুরবাড়িতে এসে সব কাজের দায়িত্ব তার ওপর পড়ে। সংসারের অনেক কিছুই সে তখন বুঝত না। পদে পদে বিড়ম্বনা এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজনের লাঞ্ছনার শিকার হতে হয় তাকে প্রতিনিয়ত।
এছাড়াও বাল্যবিয়ের কবলে পড়ে সংসারের ঘানি টানছে রিক্তা-পাপড়ির মতো অনেক কিশোরী। জলঢাকা উপজেলার চাঁদমনি অনাথ আশ্রমে দীর্ঘ দিন ধরে অসহায়, অভাবে থাকা ও সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরীরা বিনা পয়সায় লেখাপড়া করে। বর্তমানে মহামারি পরিস্থিতিতেও ৩৫ জনের মতো কিশোরী রয়েছে।
আশ্রমটির প্রতিষ্ঠাতা পিজিরুল আলম দুলাল জানান, করোনার প্রাদুর্ভাবে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল তখন অভিভাবকরা তাদের বাচ্চাদের নিয়ে যেতে শুরু করলেন। পরে খোঁজ নিয়ে দেখলাম অধিকাংশরাই তাদের মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন। যাদের বেশির ভাগেরই বয়স ১৩ থেকে ১৪ বছর।
তিনি আরও জানান, দরিদ্রতাই মূলত বাল্যবিয়ের কারণ, আর এ সময় যৌতুকের চাহিদা কম। এছাড়া করোনাকালীন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকা এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মনিটরিংয়ের অভাবেই বাল্যবিয়ে বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে।
কথা হয় কয়েকজন অভিভাবকদের সঙ্গে। তারা জানান, স্কুল বন্ধ, করোনার কারণে আয়-রোজগার বন্ধ। মেয়েকে বাড়িতে বেশি দিন রাখতে চান না। মেয়েকে সংসারি করতে এমন সিদ্ধান্ত তাদের।
অধিকাংশ অভিভাবকদেরই মতামত একই পাওয়া গেল।
উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএসের তথ্যমতে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন ৬৮ জন। আর করোনাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এ হার বেড়েছে দ্বিগুণ। তবে স্কুল বন্ধ থাকায় এ তথ্য হালনাগাদ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এএইচএম রেজওয়ানুল কবীর বলেন, শারীরিক অপরিপক্বতার কারণে গর্ভধারণসহ নানা জটিলতায় পড়তে পারেন বাল্যবিয়ের শিকার এসব কিশোরী। এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও রয়েছে।
তিনি বলেন, এ সময়টাতেই মূলত কিশোরীর শারীরিক গঠন পরিপক্ব হয়। এ সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জলঢাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব হাসান বলেন, বাল্যবিয়ে বন্ধে আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। আমরা যখনই খোঁজ পাই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করি।