কক্সবাজারে স্মরণকালের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস ঘটাতে পারে মোখা
অতিপ্রবল রূপ নেওয়া ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে কক্সবাজার উখিয়া-টেকনাফের আশ্রিত রোহিঙ্গা বসতি ও কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকায় ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। মোখা উপকূলীয় এলাকা সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়া, মহেশখালীর সোনাদিয়া, ধলঘাটা, মাতারবাড়ি, কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডী, খুরুশকুল, ঈদগাঁওয়ের গোমাতলী, পোকখালীতে স্মরণকালের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস ঘটাতে পারে বলে আতঙ্কে কাটছে স্থানীয়দের প্রতিটি মূহূর্ত।
শক্তি বাড়িয়ে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় মোখা। শনিবার সন্ধ্যায় বৈরী আবহাওয়ায় জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে সাইক্লোন শেল্টারে ছুটছেন সেন্টমার্টিনদ্বীপসহ উপকূলের মানুষ। বাসিন্দারা সাইক্লোন শেল্টার, উঁচু ভবন, স্কুল ও মাদ্রাসাসহ বহুতল ভবনে আশ্রয়ে যাচ্ছেন। অনেকে গৃহপালিত প্রাণীসহ চলে যান। অনিরাপদ থাকা লোকজনকে দুর্যোগের আগে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসতে তোড়জোড় চালাচ্ছে প্রশাসন। আবার অনেকে যার যার পছন্দসই স্থানে ছুটছেন আতংকিতরা।
ভুক্তভোগীরা জানান, অতীতে পাহাড় ধস ও জলোচ্ছ্বাসে প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের। যারা ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস দেখেছেন তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এদিকে দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রাণহানি ও সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি রক্ষায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন।
বিগত দুর্যোগে টেকনাফসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসে ২০ জনের বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল। আর কক্সবাজারের অন্য জায়গায় মারা যান অর্ধশতাধিক। এবার পাহাড়ধসে মৃত্যুর সংখ্যা শূন্যের কোটায় রাখতে জোর তৎপরতা চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মুহম্মদ শাহীন ইমরান।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানান, শনিবার সন্ধ্যা নাগাদ ৫৭৬ সাইক্লোন শেল্টার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল-মোটেলসহ ৬৩৬টি শেল্টারে এখন পর্যন্ত এক লাখ ৮৬ হাজারের মতো উপকূলবাসীকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসা হয়।
রাতের মধ্যে তিন লাখ মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ছাড়াও নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসা হয়েছে অর্ধলাখের মতো প্রাণী। দুর্যোগকালীন সেবায় গঠন করা হয়েছে ৯৩টি মেডিকেল টিম। কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ১০০টি সিট বরাদ্দ করা হয়েছে ঘূর্ণিঝড় দুর্যোগে চিকিৎসার জন্য।
পর্যটন জোনের ৫৫টি হোটেলকেও আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। হোটেলে আশ্রিতদের ফ্রিতে খাবার সরবরাহ করবে বাংলাদেশ রেস্তোঁরা মালিক সমিতি কক্সবাজার জেলা শাখার রেস্তোঁরাগুলো।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম বলেন, দুর্যোগপূর্ণ সময়ের কথা বিবেচনা করে আমরা ৫৫টি হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউস আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি। এতে অন্তত অর্ধলাখ মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে।
এর আগে সেন্টমার্টিন দ্বীপের সব হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন।
বাংলাদেশ রেস্তোঁরা মালিক সমিতি কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি নইমুল হক টুটুল বলেন, মানবিক কারণে রেস্তোঁরাগুলোর পক্ষ থেকে হোটেলে আশ্রিতদের ফ্রি খবার সরবরাহ করা হবে। ইতোমধ্যে শনিবার বিকালে তিন হাজার প্যাকেট খাবার সরবরাহ করা হয়েছে।
এদিকে শনিবার দুপুর থেকে কক্সবাজারে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এরই মধ্যে ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে টেকনাফসহ সেন্টমার্টিন ও উপকূলীয় এলাকায়।
শুক্রবার রাত থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়। তবে মোখায় সম্ভাব্য ক্ষতি ও পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জেলা এবং উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবু সুফিয়ান ও টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান।
সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা নূর মোহাম্মদ বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে দ্বীপের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে। সাগরে জোয়ারের পানি বেড়েছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে হালকা বাতাস বইছে।
যারা ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস দেখেছেন তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দ্বীপে বড় কোনো দুর্ঘটনা হলে বের হওয়ার রাস্তা নেই। চতুর্দিকে সাগর। এবার স্মরণকালের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস ঘটাতে পারে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা। তবে সাইক্লোন শেল্টার থাকায় আপাতত আমরা নিরাপদ বোধ করছি।
বাহারছড়া উপকূলের বাসিন্দা মো. জুবায়ের বলেন, আমাদের গ্রামে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী বাসিন্দারা পাহাড়ধসের আশঙ্কায় রয়েছেন। উপজেলা প্রশাসন থেকে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
হোয়াইক্যংয়ের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, বিগত ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের এলাকায় পাহাড় ধসে অনেক লোক মারা গেছেন। এবারের ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা শুনে আমরা খুব আতঙ্কে আছি। বিশেষ করে পাহাড়ে থাকা মানুষগুলো অনিরাপদ।
উনচিপ্রাং ক্যাম্পের মাঝি (নেতা) কামাল হোসাইন বলেন, ক্যাম্পের পাহাড়ের পাশে অথবা পাহাড়ের ওপরে থাকা রোহিঙ্গারা আতঙ্কে সময় কাটাচ্ছেন। ভারি বৃষ্টি হলেও পাহাড় ধস হয়। কিন্তু ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় মোখার ভয়াবহতা শুনে আমরা খুব ভয়ে আছি।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় দ্বীপবাসীকে সতর্ক করে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। মানুষকে নিরাপদে রাখতে স্কুল, মাদরাসা ও সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
শনিবার সন্ধ্যা হতে সমুদ্র তীরে বসবাসকারীরা আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসা শুরু করেছে। দূর্যোগ শুরু হলে সাইক্লোন শেল্টারের আশপাশের পরিবারগুলো চলে আসার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। আতঙ্কিত না হয়ে ধৈর্য সহকারে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানান চেয়ারম্যান মুজিব।
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর আহমদ আনোয়ারী বলেন, পাহাড়ি এলাকাসহ সবখানে মাইকিং করে পাহাড় ও ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা থেকে নিরাপদে মানুষদের সরে আসতে অনুরোধ করা হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে।
টেকনাফ ইউএনও মো. কামরুজ্জামান বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় সব প্রস্তুতি নেওয়া আছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপে নৌবাহিনীর পাশাপাশি বিজিবি, পুলিশ, কোস্টগার্ড সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। হটলাইন খোলা হয়েছে ।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (যুগ্মসচিব) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি মোকাবিলায় ক্যাম্পগুলোতে স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ক্যাম্পের স্কুল ও মসজিদ-মাদরাসাসহ মজবুত সেন্টারগুলো আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
ক্যাম্পে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, রেডক্রস, মেডিকেল টিম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, দমকল বাহিনী, বিভিন্ন দাতা সংস্থার কর্মীসহ রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবীরাও দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছেন। দুর্যোগকালীন প্রস্তুত রাখা হয়েছে নগদ অর্থ ও শুকনো খাবার।
এদিকে, শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আবহাওয়ায় তেমন কোনো বৈপরীত্য না দেখায় ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র হালচাল দেখতে সৈকতের বেলাভূমিতে ভিড় জমায় নানা বয়সের মানুষ। শুক্র ও শনিবার সারা দিন কমবেশি মানুষ সৈকত এলাকায় অবস্থান নিয়ে মোখা বিষয়ে নানা আলোচনা করছেন।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবু সুফিয়ান বলেন, শনিবার বিকাল থেকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নিয়ে তীব্রতা শুরু করেছে ঘূর্ণিঝড় মোখা। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি রোধ ও জানমাল নিরাপত্তায় জেলার প্রতিটি উপজেলা মিলিয়ে ৫৭৬টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয় আরও তিনদিন আগে থেকে।
জেলা দুর্যোগ ও ত্রাণ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘূর্ণিঝড় পূর্ব ও পরবর্তী সময় আপাতত ব্যবহারের জন্য নগদ দেড় লাখ করে টাকা, তিন টন করে বিস্কুট, তিন টন ড্রাইকেক, বিশুদ্ধ পানি, বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময় প্রযোজনীয় অর্থ ও অন্যান্য ত্রাণ সামগ্রী মজুদ রয়েছে।
এদিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র প্রভাবে অতিভারি বর্ষণের কারণে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া ১৫ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শনিবার রাত থেকে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় এলাকায় মোখার তাণ্ডব শুরু হতে পারে। এর প্রভাবে চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল বিভাগে ভারি (৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতিভারি (২৮৯ মিলমিটার) বৃষ্টি হতে পারে। অতিভারি বৃষ্টির কারণে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধস হতে পারে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে। ঘূর্ণিঝড়টি শনিবার দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৭০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল। এটি আরও উত্তর-উত্তর–পূর্ব দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হয়ে রোববার ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে কক্সবাজার-উত্তর মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করতে পারে। শনিবার রাত থেকে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় এলাকায় অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগের প্রভাব শুরু হতে পারে।
কক্সবাজারে স্মরণকালের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস ঘটাতে পারে মোখা
জসিম উদ্দিন, কক্সবাজার
১৩ মে ২০২৩, ২২:২৬:৪১ | অনলাইন সংস্করণ
অতিপ্রবল রূপ নেওয়া ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে কক্সবাজার উখিয়া-টেকনাফের আশ্রিত রোহিঙ্গা বসতি ও কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকায় ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। মোখা উপকূলীয় এলাকা সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়া, মহেশখালীর সোনাদিয়া, ধলঘাটা, মাতারবাড়ি, কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডী, খুরুশকুল, ঈদগাঁওয়ের গোমাতলী, পোকখালীতে স্মরণকালের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস ঘটাতে পারে বলে আতঙ্কে কাটছে স্থানীয়দের প্রতিটি মূহূর্ত।
শক্তি বাড়িয়ে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় মোখা। শনিবার সন্ধ্যায় বৈরী আবহাওয়ায় জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে সাইক্লোন শেল্টারে ছুটছেন সেন্টমার্টিনদ্বীপসহ উপকূলের মানুষ। বাসিন্দারা সাইক্লোন শেল্টার, উঁচু ভবন, স্কুল ও মাদ্রাসাসহ বহুতল ভবনে আশ্রয়ে যাচ্ছেন। অনেকে গৃহপালিত প্রাণীসহ চলে যান। অনিরাপদ থাকা লোকজনকে দুর্যোগের আগে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসতে তোড়জোড় চালাচ্ছে প্রশাসন। আবার অনেকে যার যার পছন্দসই স্থানে ছুটছেন আতংকিতরা।
ভুক্তভোগীরা জানান, অতীতে পাহাড় ধস ও জলোচ্ছ্বাসে প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের। যারা ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস দেখেছেন তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এদিকে দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রাণহানি ও সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি রক্ষায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন।
বিগত দুর্যোগে টেকনাফসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসে ২০ জনের বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল। আর কক্সবাজারের অন্য জায়গায় মারা যান অর্ধশতাধিক। এবার পাহাড়ধসে মৃত্যুর সংখ্যা শূন্যের কোটায় রাখতে জোর তৎপরতা চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মুহম্মদ শাহীন ইমরান।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানান, শনিবার সন্ধ্যা নাগাদ ৫৭৬ সাইক্লোন শেল্টার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল-মোটেলসহ ৬৩৬টি শেল্টারে এখন পর্যন্ত এক লাখ ৮৬ হাজারের মতো উপকূলবাসীকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসা হয়।
রাতের মধ্যে তিন লাখ মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ছাড়াও নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসা হয়েছে অর্ধলাখের মতো প্রাণী। দুর্যোগকালীন সেবায় গঠন করা হয়েছে ৯৩টি মেডিকেল টিম। কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ১০০টি সিট বরাদ্দ করা হয়েছে ঘূর্ণিঝড় দুর্যোগে চিকিৎসার জন্য।
পর্যটন জোনের ৫৫টি হোটেলকেও আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। হোটেলে আশ্রিতদের ফ্রিতে খাবার সরবরাহ করবে বাংলাদেশ রেস্তোঁরা মালিক সমিতি কক্সবাজার জেলা শাখার রেস্তোঁরাগুলো।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম বলেন, দুর্যোগপূর্ণ সময়ের কথা বিবেচনা করে আমরা ৫৫টি হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউস আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি। এতে অন্তত অর্ধলাখ মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে।
এর আগে সেন্টমার্টিন দ্বীপের সব হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন।
বাংলাদেশ রেস্তোঁরা মালিক সমিতি কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি নইমুল হক টুটুল বলেন, মানবিক কারণে রেস্তোঁরাগুলোর পক্ষ থেকে হোটেলে আশ্রিতদের ফ্রি খবার সরবরাহ করা হবে। ইতোমধ্যে শনিবার বিকালে তিন হাজার প্যাকেট খাবার সরবরাহ করা হয়েছে।
এদিকে শনিবার দুপুর থেকে কক্সবাজারে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এরই মধ্যে ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে টেকনাফসহ সেন্টমার্টিন ও উপকূলীয় এলাকায়।
শুক্রবার রাত থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়। তবে মোখায় সম্ভাব্য ক্ষতি ও পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জেলা এবং উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবু সুফিয়ান ও টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান।
সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা নূর মোহাম্মদ বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে দ্বীপের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে। সাগরে জোয়ারের পানি বেড়েছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে হালকা বাতাস বইছে।
যারা ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস দেখেছেন তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দ্বীপে বড় কোনো দুর্ঘটনা হলে বের হওয়ার রাস্তা নেই। চতুর্দিকে সাগর। এবার স্মরণকালের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস ঘটাতে পারে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা। তবে সাইক্লোন শেল্টার থাকায় আপাতত আমরা নিরাপদ বোধ করছি।
বাহারছড়া উপকূলের বাসিন্দা মো. জুবায়ের বলেন, আমাদের গ্রামে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী বাসিন্দারা পাহাড়ধসের আশঙ্কায় রয়েছেন। উপজেলা প্রশাসন থেকে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
হোয়াইক্যংয়ের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, বিগত ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের এলাকায় পাহাড় ধসে অনেক লোক মারা গেছেন। এবারের ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা শুনে আমরা খুব আতঙ্কে আছি। বিশেষ করে পাহাড়ে থাকা মানুষগুলো অনিরাপদ।
উনচিপ্রাং ক্যাম্পের মাঝি (নেতা) কামাল হোসাইন বলেন, ক্যাম্পের পাহাড়ের পাশে অথবা পাহাড়ের ওপরে থাকা রোহিঙ্গারা আতঙ্কে সময় কাটাচ্ছেন। ভারি বৃষ্টি হলেও পাহাড় ধস হয়। কিন্তু ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় মোখার ভয়াবহতা শুনে আমরা খুব ভয়ে আছি।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় দ্বীপবাসীকে সতর্ক করে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। মানুষকে নিরাপদে রাখতে স্কুল, মাদরাসা ও সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
শনিবার সন্ধ্যা হতে সমুদ্র তীরে বসবাসকারীরা আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসা শুরু করেছে। দূর্যোগ শুরু হলে সাইক্লোন শেল্টারের আশপাশের পরিবারগুলো চলে আসার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। আতঙ্কিত না হয়ে ধৈর্য সহকারে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানান চেয়ারম্যান মুজিব।
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর আহমদ আনোয়ারী বলেন, পাহাড়ি এলাকাসহ সবখানে মাইকিং করে পাহাড় ও ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা থেকে নিরাপদে মানুষদের সরে আসতে অনুরোধ করা হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে।
টেকনাফ ইউএনও মো. কামরুজ্জামান বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় সব প্রস্তুতি নেওয়া আছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপে নৌবাহিনীর পাশাপাশি বিজিবি, পুলিশ, কোস্টগার্ড সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। হটলাইন খোলা হয়েছে ।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (যুগ্মসচিব) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি মোকাবিলায় ক্যাম্পগুলোতে স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ক্যাম্পের স্কুল ও মসজিদ-মাদরাসাসহ মজবুত সেন্টারগুলো আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
ক্যাম্পে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, রেডক্রস, মেডিকেল টিম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, দমকল বাহিনী, বিভিন্ন দাতা সংস্থার কর্মীসহ রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবীরাও দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছেন। দুর্যোগকালীন প্রস্তুত রাখা হয়েছে নগদ অর্থ ও শুকনো খাবার।
এদিকে, শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আবহাওয়ায় তেমন কোনো বৈপরীত্য না দেখায় ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র হালচাল দেখতে সৈকতের বেলাভূমিতে ভিড় জমায় নানা বয়সের মানুষ। শুক্র ও শনিবার সারা দিন কমবেশি মানুষ সৈকত এলাকায় অবস্থান নিয়ে মোখা বিষয়ে নানা আলোচনা করছেন।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবু সুফিয়ান বলেন, শনিবার বিকাল থেকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নিয়ে তীব্রতা শুরু করেছে ঘূর্ণিঝড় মোখা। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি রোধ ও জানমাল নিরাপত্তায় জেলার প্রতিটি উপজেলা মিলিয়ে ৫৭৬টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয় আরও তিনদিন আগে থেকে।
জেলা দুর্যোগ ও ত্রাণ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘূর্ণিঝড় পূর্ব ও পরবর্তী সময় আপাতত ব্যবহারের জন্য নগদ দেড় লাখ করে টাকা, তিন টন করে বিস্কুট, তিন টন ড্রাইকেক, বিশুদ্ধ পানি, বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময় প্রযোজনীয় অর্থ ও অন্যান্য ত্রাণ সামগ্রী মজুদ রয়েছে।
এদিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র প্রভাবে অতিভারি বর্ষণের কারণে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া ১৫ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শনিবার রাত থেকে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় এলাকায় মোখার তাণ্ডব শুরু হতে পারে। এর প্রভাবে চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল বিভাগে ভারি (৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতিভারি (২৮৯ মিলমিটার) বৃষ্টি হতে পারে। অতিভারি বৃষ্টির কারণে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধস হতে পারে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে। ঘূর্ণিঝড়টি শনিবার দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৭০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল। এটি আরও উত্তর-উত্তর–পূর্ব দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হয়ে রোববার ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে কক্সবাজার-উত্তর মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করতে পারে। শনিবার রাত থেকে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় এলাকায় অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগের প্রভাব শুরু হতে পারে।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2023