ফুল চাষ শিখতে চান ২০ কর্মকর্তা, ব্যয় সাড়ে ৭ কোটি!
হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ২৬ মে ২০২৩, ১০:১১ এএম
এবার ফুলের চাষ শিখতে বিদেশ যেতে চান ২০ কর্মকর্তা। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এতে গড়ে প্রত্যেক কর্মকর্তার পেছনে ব্যয় হওয়ার কথা সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। ‘ফুল গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পে এমন প্রস্তাব দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এতে আপত্তি দিতে যাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন।
এর আগে ঘাস চাষ এবং খিচুড়ি রান্না শেখাসহ নানা ছুতোয় বিদেশ সফর কিংবা প্রশিক্ষণের প্রস্তাবে ব্যাপক সমালোচনা হয়। চলমান অর্থনৈতিক সংকট এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই এবার প্রস্তাব এসেছে ফুল চাষ শিখতে বিশেষ সফরের বিষয়ে। প্রকল্পটির ওপর অনুষ্ঠেয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এই ব্যয় বাদ দেওয়া বা যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনার পক্ষে মত দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পকিল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘বর্তমান কৃচ্ছ সাধনের সময় যেকোনো অহেতুক ব্যয় প্রতিরোধ করা হবে। গত ১১ মে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অহেতুক বিদেশ সফর ও বিদেশ প্রশিক্ষণ বাদ দিতে হবে। আমরা সেই নির্দেশনা মেনে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছি।
ফুল চাষ শিখতে বিদেশ সফরের প্রস্তাব বিষয়ে এখনো আমার কাছে প্রকল্পটি আসেনি। এটি সেক্টরে থাকতে পারে। কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) ফজলুল হক বিদেশ থেকে দেশে ফিরলে বিষয়টি নিয়ে কথা বলব।’
পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, ‘বর্তমান সংকটময় সময়ে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কাম্য নয়। তবে দেখতে হবে সত্যিই ফুল চাষ শিখতে বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন আছে কি না। এক্ষেত্রে এত টাকা ব্যয় না করে সীমিত আকারে যেসব কর্মকর্তা সরাসরি এ কাজের সঙ্গে যুক্ত তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এ প্রকল্পের আওতায় মন্ত্রণালয়ের সচিব বা পিয়নের বিদেশ সফরের কোনো প্রয়োজন নেই।’
সূত্র জানায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য দুই ব্যাচে ১০ কর্মকর্তার ব্যয় ধরা হয় চার কোটি ৮১ লাখ ৬২ হাজার টাকা। সেই হিসাবে প্রত্যেকের জন্য ব্যয় হওয়ার কথা প্রায় ৪৮ লাখ টাকা। পাশাপাশি দুই ব্যাচে আলাদা ১০ কর্মকর্তার বিদেশে শিক্ষা সফরের জন্য প্রস্তাব আছে দুই কোটি ৭১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এতে প্রত্যেকের জন্য ব্যয় ধরা হয় প্রায় ২৭ লাখ টাকা। গত ২৪ মে প্রকল্পটি নিয়ে পিইসি সভা হওয়ার কথা থাকলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগের সদস্য দেশের বাইরে থাকায় তা হয়নি। তবে শিগগিরই স্থগিত সভাটি অনুষ্ঠিত হবে। পিইসি সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) বৈদেশিক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা সফর বাবদ যে টাকা ধরা হয়েছে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি বাদ দেওয়া যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি,পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মো. ছায়েদুজ্জামানের সঙ্গে। বৃহস্পতিবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্প প্রস্তাবটি তৈরি হয়েছে অনেক আগে। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আসেনি। তবে থাইল্যান্ড বা বিশ্বের অনেক দেশ ফুল চাষ, গবেষণা ও রপ্তানিতে ভালো করছে। সেখানে কর্মকর্তারা গেলে অনেক সমৃদ্ধ হবেন। সেই বিবেচনায় হয়তো এমন প্রস্তাব করা হয়েছে। পিইসি সভায় প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা যদি এর সপক্ষে যুক্তি দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারে তাহলে অল্প হলেও হয়তো এই সুযোগ রাখা হতে পারে। আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। কোনোভাবেই অহেতুক বিদেশ সফর যেন না হয়।
পরিকল্পনা কমিশনে দেওয়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে ফুল ও শোভাবর্ধনকারী উদ্ভিদের গবেষণা জোরদারের জন্য ২০২৭ সালের মধ্যে একটি আধুনিক গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। দেশীয় ফুল ও শোভাবর্ধনকারী উদ্ভিদের উন্নত জাত, আধুনিক চাষ ও বংশ বিস্তার পদ্ধতি উদ্ভাবন এবং বিদেশি ফুল উৎপাদন ১০ শতাংশ বৃদ্ধির লক্ষ্য রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় প্রকল্প প্রস্তাব তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন) ড. দিলোয়ার আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে। বৃহস্পতিবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘থাইল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসসহ যেসব দেশ ফুল চাষে সাফল্য লাভ করেছে সেসব দেশে সরাসরি যেতে পারলে ভালো হয়। তারা কীভাবে গ্রিন হাউজ পদ্ধতিতে ফুল চাষ করে এসব হাতে-কলমে শেখার জন্যই এমন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্নের মুখে বিভিন্ন ব্যয় প্রস্তাব : প্রকল্পের আওতায় সেমিনার ও কর্মশালায় ৭১ লাখ ৮০ হাজার টাকা, প্রচার ও বিজ্ঞাপনে ১২ লাখ, সাইনবোর্ড ও ট্যাগের জন্য আট লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এছাড়া অডিও-ভিডিও এবং চলচ্চিত্র নির্মাণে পাঁচ লাখ টাকা, বইপত্র ও সাময়িকী পাঁচ লাখ টাকা, অভ্যন্তরীণ ভ্রমণে ৩০ লাখ টাকা এবং পেট্রোল, ওয়েল লুব্রিকেন্টে ২০ লাখ টাকার প্রস্তাব আছে। পাশাপাশি গ্যাস ও জ্বালানি ৩৫ লাখ টাকা, প্রদর্শন খামার এক কোটি টাকা, মুদ্রণ ও বাঁধাই পাঁচ লাখ টাকা রাখা হয়েছে। এসব ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে ধরা হয়নি বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন। এছাড়া অন্যান্য ব্যয় বরাদ্দ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হবে।