ইসলামের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ বীরদের নিয়ে নির্মিত অসাধারণ কয়েকটি সিনেমা

বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২৫, ০৩:২৬ পিএম

ছবি: যুগান্তর
পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ মুসলিম। তারপরেও দীর্ঘদিন ধরে নানা রকম অত্যাচার, নির্যাতন আর বৈষম্যের শিকার তারা। যদিও মুসলমানদের অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি ছিল গোটা পৃথিবীর রোল মডেল।
১৯২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উসমানি খেলাফতের পতনের পর এককভাবে আর দাঁড়াতে পারেনি মুসলমানরা। সেই থেকেই তাদের পিছিয়ে পড়ার অধ্যায়ের শুরু। বর্তমানে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, আবিষ্কার-উদ্ভাবন, মিডিয়া-চলচ্চিত্র কোনোটাতেই মুসলিমদের তেমন কোনো অংশগ্রহণ নেই। যার ফলে মুসলিম তরুণ-যুবকরা বেড়ে উঠছে পাশ্চাত্যের সভ্যতা-সংস্কৃতি, মিডিয়া আর চলচ্চিত্রের প্রভাবে।
যেমন চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে আমাদের এই অঞ্চল থেকে শুরু প্রায় মুসলিম বিশ্বের জেন-জি বা তার আগের প্রজন্ম ‘মিলেনিয়াল’রা প্রায় সবাই বড় হয়েছে হলিউড কিংবা বলিউডের মতো বড় ইন্ডাস্ট্রিগুলোর সিনেমা দেখে।
কেননা, এ ক্ষেত্রে মুসলিমদের পিছিয়ে পড়া সবচেয়ে বেশি তলানিতে। তবে বর্তমান সময়ে তুর্কি এবং ইরানি মিডিয়াগুলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একের পর এক ইসলামিক সিরিজ এবং মুভি তৈরি করছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো ভালো মানের এবং আধুনিক মান সম্পন্ন বিভিন্ন ইসলামিক মুভি আমরা দেখতে পাবো। যদিও এরইমধ্যে অসাধারণ কয়েকটি মুভি তারা তৈরিও করেছে।
চলুন, আজকে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেই এমন কয়েকটি মুভির সঙ্গে। যেগুলো একবার হলেও দেখা উচিত।
দ্য মেসেজ
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘দ্য মেসেজ’ ইসলামিক মুভিটি। ছবিটি ইংরেজি এবং আরবি উভয় ভাষাতে মুক্তি পেয়েছে ১৯৭৬ সালে। মুভিটির পরিচালক মোস্তফা আকাদ। মুভিটিতে আরবি এবং ইংরেজি সংস্করণে ভিন্ন ভিন্ন অভিনেতা অভিনয় করেছেন।
এই সিনেমাটিতে দেখানো হয়, মহানবী (সা.) এর নবুয়াত প্রাপ্তি, ইসলাম প্রচারের শুরু থেকে নিয়ে কাফেরদের অত্যাচার নির্যাতন, সাহাবিদের ধৈর্য, আবিসিনিয়ায় হিজরত, আবিসিনিয়ার বাদশা নাজ্জাশীর সঙ্গে মুসলিম প্রতিনিধি দলের সাক্ষাৎকার, বদর ওহুদের যুদ্ধ, খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) এর ইসলাম গ্রহণ, হুদায়বিয়ার সন্ধি, মক্কা বিজয়, বিদায় হজ ইত্যাদি বিষয়গুলো খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ‘দ্য মেসেজ’ এ।
লিবিয়া, মরক্কো, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য এই চারটি দেশের যৌথ প্রযোজনায় মুভিটি নির্মিত হয়েছে। মুভিটির বাংলা ডাবিং দেখতে চাইলে ইউটিউবে সার্চ দিয়ে দেখতে পারবেন। কয়েকটি জনপ্রিয় ইসলামিক সিনেমার তালিকায় প্রথমেই থাকবে দ্যা ম্যাসেজ।
মোহাম্মদ দ্য মেসেঞ্জার অফ গড
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শৈশব জীবন নিয়ে নির্মিত হয় এই ইসলামিক সিনেমাটি ২০১৫ সালে নির্মিত। এই মুভিটি মুক্তি পায় ইরান থেকে। এর রচয়িতা এবং পরিচালক মাজিদ মাঝিদি। ‘মোহাম্মদ দ্য মেসেঞ্জার অফ গড’ এই মুভিটিতে সুরকার হিসেবে কাজ করেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুরকার এ আর রহমান।
সিনেমাটিতে দেখানো হয়, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর একেবারে জন্ম থেকে শুরু করে নিয়ে, তৎকালীন আরবের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা, মুহাম্মদ (সা.) এর মা, আমিনার মৃত্যু দাদা আব্দুল মুত্তালিব এবং চাচা আবু তালিবের মহানুভবতা। ইয়েমেনের বাদশা আব্রাহার কাবা ঘর ধ্বংসের জন্য আক্রমণ এবং তার কঠিন পরাজয় ইত্যাদি সকল বিষয় সহ বিভিন্ন ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।
‘মোহাম্মদ দ্য মেসেঞ্জার অফ গড’ সিনেমাটি ফারসি, আরবি এবং ইংরেজি ভাষায় মুক্তি পেয়েছে। ইরানি এই মুভিটির বাংলা ডাবিং দেখতে চাইলে ইউটিউবে সার্চ দিয়ে দেখতে পারবেন।
কিংডম অফ হেভেন
‘কিডম অফ হেভেন’ জেরুজালেম বিজয়ী বীর মুসলিম সেনাপতি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর জীবনী নিয়ে নির্মিত কয়েকটি জনপ্রিয় ইসলামিক সিনেমা। সালাউদ্দিন আইয়ুবী ১১৮৭ সালে জেরুজালেম বিজয় করেন। ‘কিংডম অফ হেভেন’ সিনেমাটিতে সালাউদ্দিন আইয়ূবী এর বীরত্ব মহানুভবতা ইসলামের সৌন্দর্য, ক্রুসেডারদের নির্মমতা, সালাউদ্দিন আইয়ূবী রণকৌশল ইত্যাদি বিষয় খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
২০০৫ সালে নির্মিত মুভিটির নির্মাতা রিডলি এসকট। মুভিটি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, এবং জার্মানিতে নির্মিত হয়েছে এবং ইংরেজি, আরবি, লাতিন এবং ইতালীয় ভাষায় মুক্তি পেয়েছে। এই মুভিটিতে সালাউদ্দিন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সিরিয়া নির্মাতা এবং পরিচালক হাসান মাসুদ।
সালাউদ্দিন আইয়ূবী ক্রুসেডারদের কীভাবে পরাজিত করেন এবং জেরুজালেম নগরী বিজয়ের বিজয়ের পর যে মহানুভবতা দেখান যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তিনি সেখানকার খ্রিষ্টান এবং ইহুদিদের জান এবং মালের নিরাপত্তা প্রদান করেন, মুভিটি পরিবেশনা করে বিখ্যাত মুভি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স।
লায়ন অব দ্য ডেজার্ট
১৯৮১ সালে মুক্তি প্রাপ্ত লিবিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা ওমর মুক্তারের জীবনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি সিনেমাটির পরিচালক মুস্তফা আকাদ। লায়ন অফ ডিজার্ট মুভিটিতে দেখানো হয়েছে ওমর আল-মুক্তার নামের একজন সাধারণ লিবিয়ান নাগরিক কীভাবে বিশাল ইতালীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে নিজের দেশকে রক্ষা করেন।
ছবিটিতে তৎকালীন ইতালির এক নায়ক বেনিত মুসলিনির সেনাবাহিনীর জুলুম নির্যাতন নিপীড়ন ইত্যাদি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পাশাপাশি অল্প সৈন্য, স্বল্প গোলাবারুদ নিয়ে সাহসী একজন বৃদ্ধ সমরনায়ক কীভাবে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সজ্জিত সুপ্রশিক্ষিত একটি সেনাবাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন তা তুলে ধরা হয়েছে ‘লায়ন অফ দ্য ডেজার্ট’ সিনেমাটিতে। ওমর আল মুক্তারের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ খুঁটিনাটি বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে ।
ফেতিহ ১৪৫৩
১৪৫৩ সালে ওসমানীয় সপ্তম সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ কর্তৃক কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের ঘটনা নিয়ে নির্মিত ফেতিহ ১৪৫৩ মুভিটি। এই মুভিটিতে সুলতান মুহাম্মদের নেতৃত্বে তুর্কিরা কীভাবে তৎকালীন সুপার পাওয়ার বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে তাদের রাজধানীর কনস্টান্টিনোপল বিজয় করেছিল, সেই ঘটনাটি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
কয়েকটি জনপ্রিয় ইসলামিক সিনেমার তালিকার শীর্ষে থাকা এই মুভিটি মুক্তি পায় ২০১২ সালে। সিনেমাটিতে কনস্টান্টিনোপল যুদ্ধে মুসলিমদের সমর দক্ষতা, সাহসিকতা, রণকৌশল, হার না মানার মন-মানসিকতা, নেতার আনুগত্য, আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস ইত্যাদি বিষয়গুলো দেখানো হয়েছে। মুভিটির পরিচালক ফারুক অকসয়। ফেতিহ ১৪৫৩ মুভিটিতে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ চরিত্রে অভিনয় করেছেন দাভরিম এভিন।
দ্য কিংডম অব সোলাইমান
দ্যা কিংডম অফ সোলাইমান মূলত ইরানি ইসলামিক মুভি। মালিক সুলাইমান এর ইংরেজি ভার্সন। এই সিনেমাটিতে আল্লাহর প্রেরিত নবী হজরত সুলাইমান (আ.) এর রাজত্বকালীন বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
এই সিনেমাটি দেখলে খুব সহজেই আপনি ওই সময়ের অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাবেন। সুলাইমান (আ.)-এর বিভিন্ন ঘটনা এবং দাউদ (আ.) এর বিভিন্ন ঘটনা এখানে খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
২০১০ সালে মুক্তি পাই মুভিটি ইরানে। ফারসি ভাষায় নির্মিত মুভিটির পরিচালক শাহরিয়ার বাহারানি। মুভিটিতে সুলাইমান আলাই সালাম এর চরিত্রে অভিনয় করেছেন আমিন জিন্দেগানি।
বিলাল: এ নিউ ব্রিড অব হিরো
এটি একটি অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রটি মূলত মুক্তির পর থেকে দর্শকদের কাছে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
এই সিনেমাটির মূল গল্পটি হজরত বেলাল ইবনে রাবাহ (রা.)-এর জীবন কাহিনি নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। হজরত বেলাল (রা.) ছিলেন একজন ক্রীতদাস, যিনি ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন। এই সিনেমাটিতে তার সাহসিকতা, দৃঢ়তা এবং বিশ্বাসের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
এটি একটি অসাধারণ অ্যানিমেটেড মুভি, যা সুন্দরভাবে ইসলামের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরেছে। এই সিনেমাটিতে ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট এবং অ্যানিমেশন খুব উন্নত মানের, যা দর্শকদের মুগ্ধ করে। একজন মানুষের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করার এবং নিজের বিশ্বাসের প্রতি অবিচল থাকার এক শক্তিশালী বার্তা রয়েছে এই সিনেমাটিতে।