পৃথিবী মানেই কি আমেরিকা?
গোটা বিশ্ব তাকিয়ে আছে একটি দেশের দিকে। মনে হচ্ছে পৃথিবী মানেই আমেরিকা। আসলেই কি তাই? অরাজকতা, অন্যায়, অত্যাচার থেকে শুরু করে ভালো-মন্দ সব কিছুরই প্রভাব রয়েছে সেখানে। সেখানেও মানুষ রাস্তার ধারে বসে ভিক্ষা করে। এমনকি প্রেসিডেন্টের বাসভবন হোয়াইট হাউজের চারপাশ দিয়ে অনেকের রাত কাটে। আবার অনেকে ঠিক সেই দেশ থেকেই মহাশূন্যে পাড়ি দিচ্ছে, চমৎকার। প্রশ্ন হচ্ছে- কী এমন জাদু রয়েছে আমেরিকায়? চীনও কিন্তু একটি বেশ জনবহুল দেশ। তাছাড়া উন্নত দেশের সারিতে তাদের বর্তমান ভালো দাপটও বটে। তা সত্বেও আমেরিকার মত না গর্জে বা না বর্ষে! কারণ কী? ভেবেছেন কি কখনও?
বাকস্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের বেস্ট প্রাকটিস নেই সেখানে। চীন এবং রাশিয়া যত ধনী বা শক্তিশালীই হোক না কেন গণতন্ত্রের বেস্ট প্রাকটিসের অভাবের কারণে আমেরিকার মত বিশ্বে প্রভাব ফেলতে পারছে না। মানুষ জাতির কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা সত্যি প্রশংসনীয়। যেমন আমরা নিজেরা ভালো কিছু না করতে পারলেও যখন অন্যেরা করে সেটা কিন্তু খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখি। যেমন বাংলাদেশের কথাই বলি, সবাই যে আমেরিকার প্রশংসায় পঞ্চমুখ তা নয়; তবুও সে দেশ সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক।
ট্রাম্পের পতন ও বাইডেনের উত্থানসহ কে কোন পোস্ট পেতে যাচ্ছে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সবাই বেশ মেতে আছে। গোটা বিশ্বের রাজনীতি হচ্ছে দাবা খেলার মত, চতুরতার মধ্য দিয়ে খেলে জিততে না পারলে পরাজিত। ট্রাম্পের চতুরতা বিশ্বের অনেক দেশের রাজনীতির সঙ্গে বেশ মিল ছিল তা সত্ত্বেও তিনি পরাজিত হয়েছেন। কারণ একটিই সেটা হলো বাড়ির মালিক (আমেরিকার জনগণ) আর যাই করুক কাজের মানুষের কর্মের প্রতি কঠোর নজরদারি বজায় রাখে।
ট্রাম্প কত চেষ্টাই না করলেন পদে টিকে থাকতে। জনগণ ট্রাম্প নামক কাজের লোকটার প্রতি সন্তুষ্ট নয়, তাই তার শত চেষ্টা সত্ত্বেও কাজ হয়নি। কত ক্ষমতা কত কিছু সব রসাতলে চলে গেল। তাপের কাছে যেমন লোহা গলে যায় আবার সেই তাপের কারণে পানির মত তরল পদার্থ বাষ্প হয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। এটাই রহস্য, এটাই সত্য। যার কারণে গোটা বিশ্ব আমেরিকার গণতন্ত্রের পূজারি। কারণ সেখানের কনস্টিটিউশনের মূলমন্ত্র হলো জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের সরকার।
মিস্টার বাইডেন বেশ সহজ করে জানিয়েছেন তার একটি কথায় আর সেটি হলো, তিনি রাজনীতি করেন মানুষের সেবা করার জন্য, বড়লোক হবার জন্য নয়। এটা এ যুগে একটি অপ্রিয় সত্য কথা। বাংলাদেশে যদি সত্যিকারার্থে এমন একটি কথা একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। কারণ গত পঞ্চাশ বছরে এমনটি চোখে পড়েনি। তবে পাশ্চাত্যে এটাই বেশিরভাগ দেশে প্রতিষ্ঠিত, যা জো বাইডেন বলেছেন। সুইডেনে বহুবার দেখেছি অনেকেই প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় যা করতে পারেননি পরে রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়ে অন্য কর্মে নিযুক্ত হয়েছেন এবং এখন বেশ আছেন। তবে এটা সত্য যে রাজনীতি করার কারণে কিছুটা লাইনঘাট করে নেবার সুযোগ পেয়েছেন যা হয়তো সাধারণ জনগণের পক্ষে সম্ভব হতো না।
বাংলাদেশে রাজনীতি মানেই অর্থনীতিতে সাফল্য, জনগণের জন্য কিছু করুক বা নাই করুক চৌদ্দ গোষ্ঠীর জন্য যা করার করে। এখন জনগণ যেমন আস্থা হারিয়েছে রাজনৈতিকদের উপর রাজনীতিবিদরাও জনগণের উপর বিশ্বাস হারিয়েছে। যার ফলে দেশের ভোট সিস্টেম বিলীন হতে চলেছে। দেখা যাচ্ছে টাকা নিয়েও ভোট দেয়নি আবার ভোট দিয়েছে অথচ টাকা পায়নি। কয়েকবার এমনটি ঘটেছে, শেষে বিনা ভোটে ব্যালট বাক্স ভরা হয়েছে। এটাই জয়ী হওয়ার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি।
যাইহোক আমেরিকার ইলেকশন শেষ হয়েছে। অনেক তথ্য জেনেছি।
ভাবনা, কী হবে আমাদের অভাগা বাংলাদেশের? কবে আমরা আমাদের গণতন্ত্র ফিরে পাবো নাকি সঠিক সময় এখনও হয়নি? দেশ অতীতের তুলনায় ভালোই তো আছে। দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, বেকারত্বের সংখ্যা কমেছে। সবাই বেশ ভালোই তো আছে। কী দরকার গণতন্ত্রের, যেভাবে চলছে তাতে সমস্যা কোথায়? তারপর টাকার বিনিময়ে ভোট দিয়ে যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে চাই তাহলে তো সঠিক গণতন্ত্র কখনও হবে না। সেক্ষেত্রে যেমন আছি তেমন থাকায় সমস্যা কোথায়? অথবা যদি সত্যিকারভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে চাই তবে আমাদের চিন্তাচেতনায় বড় ধরণের পরিবর্তন আনতে হবে। সে পরিবর্তন সমষ্টিগতভাবে হতে হবে নিজ নিজ জায়গা থেকে। এটা একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ সবার জন্য।
মানুষ জাতি চাপে পড়ে সমস্যার সমাধান খোঁজে। আমরা যদি সত্যিই চাপের মধ্যে পড়তাম তবে সমাধান বের করতাম। আমার মনে হয় মুষ্টিমেয় কিছু লোক চাপের মধ্যে আছে, সর্বাঙ্গীনভাবে চাপ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত পরিবর্তন হবে না। সেক্ষেত্রে প্রথম যে কাজটি করতে হবে আমাদের সবাইকে সেটা হলো চাপ সৃষ্টি করা নিজেদের ভেতর থেকে। যেমন একটি ডিম বাইরের চাপে ভেঙ্গে ধ্বংস হয়ে যায় অথচ তার ভেতরের চাপে সৃষ্টি করে একটি জীবন। আমাদেরকে নিজ নিজ জায়গা থেকে চাপ সৃষ্টি করতে হবে পরিবর্তনের জন্য আর সেটা হতে পারে আমাদের বিবেককে কলুষযুক্ত করা। এটা যদি করতে পারি তবে আমার বিশ্বাস বাংলাদেশ শুধু নিজেকে নয়; গোটা বিশ্বকে প্রকৃত গণতন্ত্রের পথ দেখাতে পারবে।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৪০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
পৃথিবী মানেই কি আমেরিকা?
গোটা বিশ্ব তাকিয়ে আছে একটি দেশের দিকে। মনে হচ্ছে পৃথিবী মানেই আমেরিকা। আসলেই কি তাই? অরাজকতা, অন্যায়, অত্যাচার থেকে শুরু করে ভালো-মন্দ সব কিছুরই প্রভাব রয়েছে সেখানে। সেখানেও মানুষ রাস্তার ধারে বসে ভিক্ষা করে। এমনকি প্রেসিডেন্টের বাসভবন হোয়াইট হাউজের চারপাশ দিয়ে অনেকের রাত কাটে। আবার অনেকে ঠিক সেই দেশ থেকেই মহাশূন্যে পাড়ি দিচ্ছে, চমৎকার। প্রশ্ন হচ্ছে- কী এমন জাদু রয়েছে আমেরিকায়? চীনও কিন্তু একটি বেশ জনবহুল দেশ। তাছাড়া উন্নত দেশের সারিতে তাদের বর্তমান ভালো দাপটও বটে। তা সত্বেও আমেরিকার মত না গর্জে বা না বর্ষে! কারণ কী? ভেবেছেন কি কখনও?
বাকস্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের বেস্ট প্রাকটিস নেই সেখানে। চীন এবং রাশিয়া যত ধনী বা শক্তিশালীই হোক না কেন গণতন্ত্রের বেস্ট প্রাকটিসের অভাবের কারণে আমেরিকার মত বিশ্বে প্রভাব ফেলতে পারছে না। মানুষ জাতির কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা সত্যি প্রশংসনীয়। যেমন আমরা নিজেরা ভালো কিছু না করতে পারলেও যখন অন্যেরা করে সেটা কিন্তু খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখি। যেমন বাংলাদেশের কথাই বলি, সবাই যে আমেরিকার প্রশংসায় পঞ্চমুখ তা নয়; তবুও সে দেশ সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক।
ট্রাম্পের পতন ও বাইডেনের উত্থানসহ কে কোন পোস্ট পেতে যাচ্ছে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সবাই বেশ মেতে আছে। গোটা বিশ্বের রাজনীতি হচ্ছে দাবা খেলার মত, চতুরতার মধ্য দিয়ে খেলে জিততে না পারলে পরাজিত। ট্রাম্পের চতুরতা বিশ্বের অনেক দেশের রাজনীতির সঙ্গে বেশ মিল ছিল তা সত্ত্বেও তিনি পরাজিত হয়েছেন। কারণ একটিই সেটা হলো বাড়ির মালিক (আমেরিকার জনগণ) আর যাই করুক কাজের মানুষের কর্মের প্রতি কঠোর নজরদারি বজায় রাখে।
ট্রাম্প কত চেষ্টাই না করলেন পদে টিকে থাকতে। জনগণ ট্রাম্প নামক কাজের লোকটার প্রতি সন্তুষ্ট নয়, তাই তার শত চেষ্টা সত্ত্বেও কাজ হয়নি। কত ক্ষমতা কত কিছু সব রসাতলে চলে গেল। তাপের কাছে যেমন লোহা গলে যায় আবার সেই তাপের কারণে পানির মত তরল পদার্থ বাষ্প হয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। এটাই রহস্য, এটাই সত্য। যার কারণে গোটা বিশ্ব আমেরিকার গণতন্ত্রের পূজারি। কারণ সেখানের কনস্টিটিউশনের মূলমন্ত্র হলো জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের সরকার।
মিস্টার বাইডেন বেশ সহজ করে জানিয়েছেন তার একটি কথায় আর সেটি হলো, তিনি রাজনীতি করেন মানুষের সেবা করার জন্য, বড়লোক হবার জন্য নয়। এটা এ যুগে একটি অপ্রিয় সত্য কথা। বাংলাদেশে যদি সত্যিকারার্থে এমন একটি কথা একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। কারণ গত পঞ্চাশ বছরে এমনটি চোখে পড়েনি। তবে পাশ্চাত্যে এটাই বেশিরভাগ দেশে প্রতিষ্ঠিত, যা জো বাইডেন বলেছেন। সুইডেনে বহুবার দেখেছি অনেকেই প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় যা করতে পারেননি পরে রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়ে অন্য কর্মে নিযুক্ত হয়েছেন এবং এখন বেশ আছেন। তবে এটা সত্য যে রাজনীতি করার কারণে কিছুটা লাইনঘাট করে নেবার সুযোগ পেয়েছেন যা হয়তো সাধারণ জনগণের পক্ষে সম্ভব হতো না।
বাংলাদেশে রাজনীতি মানেই অর্থনীতিতে সাফল্য, জনগণের জন্য কিছু করুক বা নাই করুক চৌদ্দ গোষ্ঠীর জন্য যা করার করে। এখন জনগণ যেমন আস্থা হারিয়েছে রাজনৈতিকদের উপর রাজনীতিবিদরাও জনগণের উপর বিশ্বাস হারিয়েছে। যার ফলে দেশের ভোট সিস্টেম বিলীন হতে চলেছে। দেখা যাচ্ছে টাকা নিয়েও ভোট দেয়নি আবার ভোট দিয়েছে অথচ টাকা পায়নি। কয়েকবার এমনটি ঘটেছে, শেষে বিনা ভোটে ব্যালট বাক্স ভরা হয়েছে। এটাই জয়ী হওয়ার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি।
যাইহোক আমেরিকার ইলেকশন শেষ হয়েছে। অনেক তথ্য জেনেছি।
ভাবনা, কী হবে আমাদের অভাগা বাংলাদেশের? কবে আমরা আমাদের গণতন্ত্র ফিরে পাবো নাকি সঠিক সময় এখনও হয়নি? দেশ অতীতের তুলনায় ভালোই তো আছে। দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, বেকারত্বের সংখ্যা কমেছে। সবাই বেশ ভালোই তো আছে। কী দরকার গণতন্ত্রের, যেভাবে চলছে তাতে সমস্যা কোথায়? তারপর টাকার বিনিময়ে ভোট দিয়ে যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে চাই তাহলে তো সঠিক গণতন্ত্র কখনও হবে না। সেক্ষেত্রে যেমন আছি তেমন থাকায় সমস্যা কোথায়? অথবা যদি সত্যিকারভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে চাই তবে আমাদের চিন্তাচেতনায় বড় ধরণের পরিবর্তন আনতে হবে। সে পরিবর্তন সমষ্টিগতভাবে হতে হবে নিজ নিজ জায়গা থেকে। এটা একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ সবার জন্য।
মানুষ জাতি চাপে পড়ে সমস্যার সমাধান খোঁজে। আমরা যদি সত্যিই চাপের মধ্যে পড়তাম তবে সমাধান বের করতাম। আমার মনে হয় মুষ্টিমেয় কিছু লোক চাপের মধ্যে আছে, সর্বাঙ্গীনভাবে চাপ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত পরিবর্তন হবে না। সেক্ষেত্রে প্রথম যে কাজটি করতে হবে আমাদের সবাইকে সেটা হলো চাপ সৃষ্টি করা নিজেদের ভেতর থেকে। যেমন একটি ডিম বাইরের চাপে ভেঙ্গে ধ্বংস হয়ে যায় অথচ তার ভেতরের চাপে সৃষ্টি করে একটি জীবন। আমাদেরকে নিজ নিজ জায়গা থেকে চাপ সৃষ্টি করতে হবে পরিবর্তনের জন্য আর সেটা হতে পারে আমাদের বিবেককে কলুষযুক্ত করা। এটা যদি করতে পারি তবে আমার বিশ্বাস বাংলাদেশ শুধু নিজেকে নয়; গোটা বিশ্বকে প্রকৃত গণতন্ত্রের পথ দেখাতে পারবে।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com