‘গভীর নলকূপের’ বলি শিশু সাজিদ
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজশাহী অঞ্চলের বরেন্দ্র এলাকা ক্রমশ মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। ফলে ফসলের জমিতে সেচের পানি নিয়ে দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। অগভীর নলকূপ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না পানি। এ অবস্থায় অনেকেই পুরোনো অগভীর ‘সেমিডিপ’ তুলে অন্য জায়গায় বসাচ্ছেন। সেখানে তৈরি হওয়া গর্তগুলো খোলাই পড়ে থাকে। আবার নতুন নলকূপ বসাতে গিয়েও একাধিক জায়গায় খননের প্রয়োজন হয়। সেখানেও থেকে যাচ্ছে পরিত্যক্ত গর্ত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব গর্ত এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, নাচোল এবং নওগাঁর নিয়ামতপুর, পোরশা ও সাপাহার উপজেলার মাঠে-ঘাটে অন্তত পাঁচশ খোলা গর্ত ছড়িয়ে আছে। যেগুলোর ব্যাস ৮ থেকে ১২ ইঞ্চি। এসব গর্তে শিশুরা পড়লে সেখান থেকে উঠে আসা দুঃসাধ্য। গত ১০ নভেম্বর দুপুরে রাজশাহীর তানোরের কোয়েলহাট পূর্বপাড়ায় এমনই একটি গর্তে পড়ে যায় শিশু সাজিদ। ৩৩ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার রাতে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
জানা যায়, গভীর নলকূপের অনুমোদন না থাকলেও বিভিন্ন কৌশলে সেগুলো স্থাপন করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে অসাধু শ্রেণি পানির ব্যবসা করে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। বরেন্দ্র অঞ্চলের সেচ ব্যবস্থাপনায় সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএমডিএর রয়েছে কয়েক হাজার গভীর নলকূপ। পানির স্তর দ্রুত কমে যাওয়ায় ২০১৫ সালেই তারা নতুন গভীর নলকূপ স্থাপন বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ব্যক্তি মালিকানায় নলকূপ বসানোর প্রবণতা থামেনি।
অভিযোগ রয়েছে, অনুমোদন পেতে লেনদেন হয় বিপুল টাকা। শুধু গত বছরই তানোরে নতুন করে ৩২টি সেমিডিপ চালুর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তার বাইরে আরও শত শত সেমিডিপ চলছে ভিন্ন নামে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে। কোথাও মুরগির খামার, কোথাও আবাসিক ঘর বা শিল্পকারখানার আড়ালে চলছে সেচপাম্প।
সাজিদ যে গর্তে পড়ে মারা গেছে, সেটি খনন করেছিলেন স্থানীয় কছির উদ্দিন। সেমিডিপ বসানোর জন্য তিনি সেচ কমিটির অনুমোদন নেননি। এলাকাবাসীর ভাষ্য, বিদেশফেরত কছির পানিব্যবসায় বেশ লাভ করায় এলাকায় পাঁচটি সেমিডিপ বসিয়েছেন। এর একটি চালান মৎস্য খামারের নামে নেওয়া বিদ্যুৎ সংযোগে, দুটি সেচের নামে এবং বাকি দুটির সংযোগ নেওয়া হয়েছে অন্যের লাইন থেকে অবৈধভাবে। প্রায় এক বছর আগে শিশু সাজিদদের বাড়ির পাশে নতুন সেমিডিপ বসানোর চেষ্টা করেন কছির। টানা তিন জায়গায় গর্ত করিয়েও পানি পাননি। তাই আর নলকূপ বসানো হয়নি। খড়কুটো ও মাটি দিয়ে গর্তের মুখ ঢেকে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বর্ষণে সেই মাটি সরে গিয়ে গর্ত উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। আর তাতে পড়েই প্রাণ যায় শিশু সাজিদের।
উন্নয়নকর্মী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে অন্তত পাঁচশ গর্ত রয়েছে। এগুলো একেকটি মৃত্যুকূপ। এগুলো অচিরেই বন্ধ না করলে, সাজিদের মতো আরও অনেক শিশুর জীবন হুমকিতে পড়বে।
রাজশাহীর তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাঈমা খান বলেন, কছির উদ্দিনের আগের সেচপাম্পগুলো বৈধ কিনা, তা খতিয়ে দেখা হবে। তবে যে বোরহোলে (মাটির গভীরের গর্ত) পড়ে শিশুটির মৃত্যু হয়েছে, সেটির কোনো অনুমোদন ছিল না। তিনি বেআইনি কাজ করেছেন। সবকিছু পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।