ডা. মাহফুজ আহমেদ চৌধুরী
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘আপনার রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন, ওনাকে বাঁচাতে এখনই আইসিইউতে স্থানান্তর করতে হবে’-কথাগুলো একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে শোনার পর আমরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি। আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) হচ্ছে একটি হাসপাতালের বিশেষ বিভাগ, যেখানে জীবন-সংকটাপন্ন রোগীদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের চিকিৎসা ও মনিটরিং করা হয়। এটি শুধু চিকিৎসকের একার জায়গা নয়, এটি একটি বহু বিশেষজ্ঞ দলের (মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিম) সমন্বিত প্রচেষ্টা। এ দলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স, শ্বাস-প্রশ্বাস থেরাপিস্ট, ফার্মাসিস্ট, পুষ্টিবিদ এবং প্রশাসনিক ব্যক্তিরা সবাই অন্তর্ভুক্ত, যাদের সামগ্রিক দলগত কাজ হলো আইসিইউ।
* প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবস্থাপনা
আইসিইউ অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর। এখানে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিগুলো রোগীর জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে-
▶ মনিটরিং ডিভাইস : হার্ট রেট, ব্লাড প্রেসার, অক্সিজেন লেভেল পরিমাপ করে।
▶ ভেন্টিলেটর : শ্বাস-প্রশ্বাসে সহায়তা করে।
▶ ইনফিউশন পাম্প : নির্দিষ্ট হারে ওষুধ প্রদান করে।
▶ ডায়ালিসিস মেশিন : কিডনি বিকল রোগীদের জন্য।
* সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (ইনফেকশন কন্ট্রোল)
আইসিইউতে রোগসংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ কারণ, এখানের রোগীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে।
▶ হ্যান্ড হাইজিন (সাবান-পানি বা স্যানিটাইজার) মেনে চলতে হয়।
▶ পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (PPE) ব্যবহার করতে হয়।
▶ আইসোলেশন প্রোটোকল মানতে হয়।
▶ পরিবেশের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হয়।
* রোগী সম্পর্কিত কার্যকর তথ্য আদান-প্রদান
▶ টিম কমিউনিকেশন : চিকিৎসা দলের মধ্যে পরিষ্কার, গুরুত্বপূর্ণ ও সংক্ষিপ্ত তথ্য আদান-প্রদান।
▶ পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ : নিয়মিত আপডেট, সঠিক তথ্য প্রদান, স্টাফরাই রোগীর পরিবারের সঙ্গে প্রাথমিক যোগাযোগ এবং সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকেন।
▶ আন্তঃবিভাগীয় যোগাযোগ : ল্যাব, ইমেজিং, ফার্মেসির সঙ্গে সমন্বয়।
* মানবিক ও মানসিক সহায়তা
আইসিইউ শুধু শারীরিক চিকিৎসা নয়, মানসিক সহায়তাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
▶ রোগীর মানসিক অবস্থা বিবেচনা (যদি সচেতন থাকেন)।
▶ পরিবারের জন্য মানসিক সমর্থন।
▶ চিকিৎসা দলের মানসিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা।
* প্রশাসনিক ও লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা
▶ শয্যা ব্যবস্থাপনা ও বরাদ্দ করা।
▶ সরঞ্জাম ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ করা।
▶ স্টাফ শিডিউলিং ও ডিউটি রোস্টার করা।
▶ আইনগত ও নৈতিক দিকনির্দেশনা অনুসরণ করা।
▶ ডকুমেন্টেশন ও রেকর্ড কিপিং।
* রোগীর পরিবারের ভূমিকা ও দায়িত্ব
রোগীর পরিবারও সঠিক তথ্য প্রদানের মাধ্যমে আইসিইউ ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে কাজ করে।
* সঠিক তথ্য প্রদান
▶ পূর্ববর্তী রোগের ইতিহাস ও চিকিৎসা ইতিহাস প্রদান।
▶ অ্যালার্জি ও ওষুধের তথ্য প্রদান।
▶ ব্যক্তিগত প্রেফারেন্স (ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক) প্রদান।
* সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ
▶ চিকিৎসা পরিকল্পনা সম্পর্কে জানা।
▶ জীবনের শেষ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত (এন্ড-অফ-লাইফ কেয়ার) গ্রহণ।
▶ লিখিত অনুমতি অথবা প্রত্যাখ্যানপত্র প্রদান।
* সহায়ক ভূমিকা
▶ নির্ধারিত সময়ে পরিদর্শন করা।
▶ চিকিৎসা দলের নির্দেশনা মানা।
▶ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা করা।
* চ্যালেঞ্জ
▶ সংবেদনশীল তথ্য নিয়ে কাজ : রোগীর গোপনীয়তা রক্ষা করা।
▶ মানসিক চাপ মোকাবিলা করা : ক্রাইসিস বা ইমারজেন্সি ম্যানেজমেন্ট দক্ষতা।
▶ টিম পরিচালনা করা : বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কাজ করা।
▶ প্রযুক্তির সঙ্গে অভ্যস্ততা : নতুন যন্ত্রপাতি সম্পর্কে শেখা।
* সমাধানের উপায়
▶ নিয়মিত ট্রেইনিং ও ওয়ার্কশপ।
▶ ক্লিয়ার নিয়মনীতি ও গাইডলাইন।
▶ সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি।
▶ ওপেন কমিউনিকেশন কালচার।
* আইসিইউতে অন্য পেশাজীবীদের গুরুত্ব
আইসিইউ শুধু ডাক্তার-নার্সের জায়গা নয়, এখানে বিভিন্ন পেশার মানুষরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
▶ হাসপাতাল প্রশাসক : সম্পদ ব্যবস্থাপনা।
▶ মেডিকেল রেকর্ড বিশেষজ্ঞ : ডকুমেন্টেশন।
▶ বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার : যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ।
▶ কাউন্সেলর : মানসিক সহায়তা।
▶ পরিচ্ছন্নতা কর্মী : ইনফেকশন কন্ট্রোল।
আইসিইউ ব্যবস্থাপনা একটি জটিল, বহুমুখী প্রক্রিয়া যেখানে চিকিৎসাগত জ্ঞানের পাশাপাশি প্রশাসনিক, মানবিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার সমন্বয় প্রয়োজন। এটি শুধু চিকিৎসা ও প্রযুক্তির বিষয় নয়, বরং মানুষের যত্ন, সহমর্মিতা এবং সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে জীবন রক্ষার এক অসাধারণ পথযাত্রা। আইসিইউ-এর সাফল্য নির্ভর করে সঠিক জ্ঞান, সংবেদনশীলতা এবং টিমওয়ার্কের মাধ্যমে। এ উপলব্ধিই আইসিইউ ব্যবস্থাপনাকে করে তোলে আরও কার্যকর ও মানবিক।
লেখক : অ্যাসোসিয়েট কনসালটেন্ট, মেডিকেল আইসিইউ, এভারকেয়ার হাসপাতাল, ঢাকা