Logo
Logo
×

এশিয়া

তাইওয়ান ঘিরে চীন ও জাপানের মধ্যে কেন এত মতবিরোধ?

Icon

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ১০:২৪ পিএম

তাইওয়ান ঘিরে চীন ও জাপানের মধ্যে কেন এত মতবিরোধ?

জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানে তাকাইচি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ফাইল ছবি

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে জাপান ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক দ্রুত অবনতি হয়েছে। এই বিরোধের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে তাইওয়ান—যে ইস্যু দীর্ঘদিন ধরেই দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার কারণ।

৭ নভেম্বর দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র দুই সপ্তাহ পর জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানে তাকাইচি সতর্ক করে বলেন—তাইওয়ানের বিরুদ্ধে চীনের যেকোনো সামরিক পদক্ষেপ জাপানের জন্য ‘বেঁচে থাকার হুমকিস্বরূপ পরিস্থিতি’ সৃষ্টি করবে। জাপানের আইনে এ ধরনের পরিস্থিতি সম্মিলিত আত্মরক্ষা প্রয়োগের পথ খুলে দিতে পারে। তাকাইচির এমন মন্তব্যই মূলত উত্তেজনার সূচনা করে। 

তাকাইচির মন্তব্যের পরপরই ওসাকায় নিযুক্ত চীনা কনসাল জেনারেল জুয়ে জিয়ান এক্স-এ একটি পোস্টে লেখেন যে তিনি ‘এক মুহূর্ত দেরি না করে একটি নোংরা ঘাড় কেটে ফেলবেন।’ যদিও পরে পোস্টটি মুছে ফেলা হয়, তবুও এতে চরম ক্ষুব্ধ হয় টোকিও।

তাকাইচি তার অবস্থান থেকে সরে আসেননি। বরং তিন দিন পর তিনি আবার বলেন, তার বক্তব্য ছিল ‘খারাপ পরিস্থিতির একটি মূল্যায়ন।’

১৩ নভেম্বর চীনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সান ওয়েইডং বেইজিংয়ে জাপানের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে টোকিওর ‘ভুল মন্তব্য’ প্রত্যাহারের দাবি জানান। একদিন পর টোকিও পাল্টা চীনা রাষ্ট্রদূতকে তলব করে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানায়।

বেইজিং এই ঘটনাকে আন্তর্জাতিক আইন ও যুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ‘গুরুতর লঙ্ঘন’ বলে আখ্যা দেয়। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং বলেন, এমন মন্তব্য চীন-জাপান সম্পর্কের রাজনৈতিক ভিত্তিকে ‘গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে’ এবং চীনা জনগণের ‘ক্ষোভ ও নিন্দার জন্ম দেয়।’

অর্থনৈতিক প্রতিশোধের বিস্তার

শুরুটা ছিল বাকযুদ্ধ, কিন্তু দ্রুত তা অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগে রূপ নেয়।

জাপানি রাষ্ট্রদূতকে তলব করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই চীন ১৪ নভেম্বর জাপান সফরের বিরুদ্ধে ভ্রমণ-সতর্কতা জারি করে, যেখানে চীনা নাগরিকদের বিরুদ্ধে একাধিক অপরাধ ও হামলার কথা উল্লেখ করা হয়।

এই সতর্কতার সরাসরি প্রভাব পড়ে জাপানের পর্যটন নির্ভর এলাকাগুলোতে।

চীনা বিমান সংস্থাগুলো টিকিটের মূল্য ফেরত দিতে শুরু করলে কয়েক দিনের মধ্যেই পাঁচ লাখের বেশি বুকিং বাতিল হয়।

বছরের প্রথম আট মাসে ৬৭ লাখ চীনা পর্যটক জাপান ভ্রমণ করেছিলেন। নোমুরা রিসার্চ ইনস্টিটিউট হিসাব করছে—এই বয়কট বছরে জাপানের ২.২ ট্রিলিয়ন ইয়েন (১৪.২ বিলিয়ন ডলার) ক্ষতির কারণ হতে পারে।

একই সময় ২০ নভেম্বর ওকিনাওয়ায় নোঙর করার কথা থাকা একটি চীনা ক্রুজ জাহাজও যাত্রা বাতিল করে।

এরপর চীন জাপানের সামুদ্রিক খাদ্য আমদানি স্থগিতের ঘোষণা দেয়। 

চীনের নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর তাইওয়ানের নেতা উইলিয়াম লাই চিং-তে জাপানি উপাদান দিয়ে প্রস্তুত খাবার খাওয়ার ছবি পোস্ট করেন। তাইওয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও নাগরিকদের বেশি করে জাপান ভ্রমণ ও জাপানি পণ্য কেনার আহ্বান জানান।

চীনে খবর আসে— জাপানি চলচ্চিত্র মুক্তি দেরি করে দেওয়া হচ্ছে।

বেইজিংয়ে জাপানের দূতাবাস জাপানি নাগরিকদের নিজেদের নিরাপত্তায় সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়।

চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলে—তাকাইচির মন্তব্য ‘দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতায় গুরুতর প্রভাব’ ফেলছে।

কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও উত্তেজনা বাড়িয়েছে

১৭ নভেম্বর জাপান বেইজিংয়ে সিনিয়র কূটনীতিক মাসাকি কানাইকে পাঠায়। তিনি চীনা কর্মকর্তার কাছে চীন কনসাল জুয়ের স্বেচ্ছা প্রত্যাহার দাবি তোলেন এবং চীনের ভ্রমণ-সতর্কতা প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, জাপানের জননিরাপত্তা পরিস্থিতি ‘অবনতি হয়নি।’

কিন্তু বৈঠকটিই আবার বিতর্ক সৃষ্টি করে।

চীনা সামাজিক মাধ্যমে ‘জাপানি কর্মকর্তার মাথা নিচু করা’র একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যা পরে মুছে ফেলা হয়। জাপান অভিযোগ করে—চীন ‘অসমন্বিত’ গণমাধ্যম ব্যবস্থা করেছে। চীন এ অভিযোগ অস্বীকার করে।

পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় যখন: 

• চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রীদের একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক স্থগিত করে।

• জোহানেসবার্গে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে তাকাইচি ও চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের মধ্যে বৈঠকের ব্যবস্থা করতেও চীন বাধা দেয়।

সম্পর্কের ঐতিহাসিক ভিত্তি

জাপান বারবার বলছে, তারা এখনো চীনের বিষয়ে তাদের ঐতিহাসিক অবস্থানেই অটল।

১৯৭২ সালের যৌথ ইশতেহারে জাপান স্বীকার করেছিল—তারা চীনের এই দাবি ‘বোঝে ও সম্মান করে’ যে তাইওয়ান চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।

১৮৯৫ সালে প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধের পর জাপান তাইওয়ান দখল করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে জাপান তাইওয়ান ও পেঙ্গু দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ ত্যাগ করে চীনা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করে।

চীন সবসময় বলে আসছে—তাইওয়ান প্রশ্নে কোনো বহিরাগত হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়; এটি তাদের ‘মূল স্বার্থের কেন্দ্রবিন্দু।’

এদিকে আঞ্চলিক উত্তেজনা শুধু তাইওয়ানেই সীমাবদ্ধ নয়।

১৬ নভেম্বর চীনের কোস্ট গার্ড জাপান-নিয়ন্ত্রিত সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জের কাছে টহল দিলে টোকিও তীব্র প্রতিবাদ জানায়। বেইজিং পাল্টা জানায়—জাপান যেন ‘চীনের আঞ্চলিক সার্বভৌমত্বকে সম্মান করে।’

‘পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক’ বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি

বিস্তর উত্তেজনা সত্ত্বেও তাকাইচি বলেছেন—জাপান চীনের সঙ্গে ‘পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ’ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। তাইওয়ান নিয়ে তার এ মন্তব্য আসে দক্ষিণ কোরিয়ায় APEC সম্মেলনের ফাঁকে শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাতের ঠিক এক সপ্তাহ পর।

সেখানে শি তাকে বলেন—ইতিহাস ও তাইওয়ানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান বজায় রাখতে হবে, যাতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তি ‘ক্ষতিগ্রস্ত বা নড়বড়ে’ না হয়।

তিনি আরও বলেন—দুই দেশকে ভালো প্রতিবেশীসুলভতা, বন্ধুত্ব, সমতা, পারস্পরিক সুবিধা এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি অনুসরণ করতে হবে।

সূত্র: আনাদোলু

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম