Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

নজরুল : সাহসী জীবনের ভাষ্যকার

Icon

জাকির আবু জাফর

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নজরুল : সাহসী জীবনের ভাষ্যকার

‘সাহস’ শব্দটির সঙ্গে চিরকাল বীরত্বের তকমা জড়ানো। চিরদিনই শব্দটিকে বহন করেছেন বীরের জাতি। বীর মানে ঢাল তলোয়ারওয়ালা কোনো দুন্ধুমারী মুখ নয়! বরং জীবনের সব পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে সত্য উচ্চারণকারী স্বচ্ছ মনের মুখ!

পৃথিবী জেগে আছে এমন সত্যধারী বীরদের দুঃসাহসী উচ্চারণের উষ্ণতায়। সমরক্ষেত্রে প্রবল প্রতাপে আত্মবিশ্বাসে মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে লড়াই করার বীরত্ব নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। একইসঙ্গে কোনো জালিম শাসকের মুখোমুখি সত্য উচ্চারণও কম বীরত্বের কাজ নয়। যুদ্ধে ভীষণ সাহস প্রয়োজন, সত্য উচ্চারণেও গভীর সাহস দরকারি। বরং জীবনযুদ্ধে সত্য বলাটা কখনো কখনো যুদ্ধের চেয়েও কঠিন হয়ে পড়ে। যুদ্ধে সাহসিকতা দেখাতেই হয়, নইলে পরাজয় অবধারিত।

কিন্তু চলমান ঘটমান জীবনে? না, এখানে সত্য উচ্চারণের সাহস সব সময় না দেখালেও চলে। কেউ কেউ মনে করেন, হয় তো শঠতার আশ্রয় নিলেই বুঝি বিজয় এলো। আপাতত তা-ই মনে হয়। কিন্তু সত্যি কি তাই! না মোটেও তাই নয়। বরং সময়ের ব্যবধানে অসত্যই ডেকে আনে পরাজয়। সত্য তার ক্ষমতা নিয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। জীবন্ত হয়ে ওঠে সত্যের মুখ।

জীবনের ক্ষুরধার কিরিচের ওপর দাঁড়িয়ে সত্য বলতে পারাই প্রকৃত সাহস। এমন সত্যের বাহককেই বীরের তকমা দেয় ইতিহাস! যারা ইতিহাসের বুকে আশ্রয় পেয়ে যান, তারা পরবর্তীদের অনুপ্রেরণার আধার হয়ে ওঠেন। তাদের অনুসরণীয় বলে গণ্য করে মানুষ। তারাই হয়ে যান জাতির বীরত্বের সোপান।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এমন সাহসী জীবনেরই ভাষ্যকার। তার কবিতা ও গানের শরীরজুড়ে সত্যের এ জিহ্বা বড় লকলকে। বড় প্রভাবশালী। সাহস নয় শুধু, তিনি চাষ করেছেন দুঃসাহসের! এমন দুঃসাহসের উদাহরণ তার কবিতার অঙ্গে অঙ্গে জাজ্বল্যমান। ধরুন ‘বিদ্রোহী’র কথা-এ কবিতায় সাহসের যে সমাচার, একে শুধু সাহস নয়, বরং মানবজাতির দুঃসাহসের সঙ্গেই নেওয়া যায়। না, দুঃসাহস মানেই অবাস্তব কিংবা কাল্পনিক কোনো সাহস নয়। বরং এটি জীবনের উচ্চ চূড়ার এক বিস্ময় ইঙ্গিত। যা নজরুলে এসে বাস্তব হয়ে উঠেছে।

চলুন পাঠ করি এর কটি পঙ্ক্তি-

‘ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/খোদার আসন আরশ ছেদিয়া/উঠিয়াছি আমি বিস্ময় মহা বিশ্ব বিধাত্রির।’ কিংবা ‘ আমি ঝঞ্জা/আমি ঘূর্ণি/ আমি পথ সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি/ আমি নৃত্য পাগল ছন্দ/ আমি আপনার তালে নেচে যাই/ আমি মুক্ত জীবনানন্দ!’ অথবা ‘ধরি বাসকির ফণা ঝাপটি/ ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি।’

... আমি রোশে উঠি যবে/ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া/ ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ/নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া/ আমি বিদ্রোহ বাহী/নিখিল অখিল ব্যপীয়া।’

এসব বিস্ময়কর উচ্চারণ নয়! দুঃসাহসী উদ্বোধন নয় কি! নিশ্চয়! এটি শুধু বিস্ময়কর নয়, মহাবিস্ময়কর! এসব মানব কল্পনার দুঃসাহসের উপমা। বিদ্রোহী কবিতার প্রতিটি ছত্রই এমন দুঃসাহসে ঠাসা!

আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবের কথা যখনই ভাবি, অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে যান নজরুল। কেন? বহুবার এমন প্রশ্ন করেছি নিজেকে। জিজ্ঞেস করেছি-কেনো আমাদের জাতীয় জীবনে নজরুল এতটা প্রাসঙ্গিক! এতটা গুরুত্ববহ! নিজেকে নিজেই জবাব দিয়েছি, নজরুল আমাদের চেতনা ও চৈতন্যের কবি। আমাদের সাহস ও সংগ্রামের কবি। আমাদের প্রতিবাদী ভাষার কবি। আমাদের জাতীয় জীবনে প্রয়োজনে ব্যবহৃত কবি। এবং মৃত্যু মুখে দাঁড়িয়ে সত্য উচ্চারণকারী।

জাতির প্রয়োজনে ব্যবহৃত হন যে কবি, তার মৃত্যু নেই। তিনি হারান না কালের গর্ভে। অলক্ষ্যে জেগে থাকেন আড়ালে। জাতি তার প্রয়োজনে খুঁজে নেন কবিকে। নজরুল তেমনই একজন কবি, যাকে আমাদের সব সংগ্রাম, সংকটে, আন্দোলন, বিপ্লবে খুঁজতে হয়। খুঁজে নেই আমরা। খুঁজে নিতে হয়। আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার বাঁকে বাঁকে নজরুলের চিহ্ন অতি জ্বলজ্বলে। বিভিন্ন লড়াই আন্দোলনে নজরুলের বারুদ-বাণী জ্বলজ্বলন্ত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর নজরুল। তিনি যখন উচ্চারণ করেন-লাথি মার/ভাঙরে তালা/যত সব বন্দীশালা/ আগুন জ্বালা/আগুন জ্বালা/ ফেল উপাড়ি!

তখন শরীরে রক্তের প্রতিটি ফোঁটা যুদ্ধঘোড়ার মতো টগবগিয়ে ওঠে। লাফিয়ে ওঠে সম্মুখ সমরের আয়োজনে। আগুন জ্বলে ওঠে রক্তের শিরায় শিরায়।

যে কবিতা, যে গান মানুষের রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে, সে কবিতা, গান কোনো ঝড়ে নিভতে পারে না। নেভাতে পারে না কোনো তীব্র তুফান। ফলে তা কাল থেকে কালান্তরে থেকে যায়। থেকে যায় সংগ্রামী মানুষের উচ্চারণে। নজরুল তেমনই গান, কবিতার স্রষ্টা। তেমনই সাহসী জীবনের ভাষ্যকার।

ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের অগ্রদূত নজরুল। জাতির প্রতিটি সংকটে পথ হয়ে ওঠে নজরুলের গান, কবিতা।

একটি জাতির ভবিষ্যতের দিকে এগোতে হলে নানা সংকটের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। নানা সমস্যার মোকাবিলা করে যেতে হয় আগামীর দিকে। এসব সমস্যার মধ্যে সব থেকে বড় সমস্যা রাজনৈতিক। রাজনীতির তালায় ঝুলে থাকে ক্ষমতার চাবি। রাজনীতির পথ মাড়িয়ে ক্ষমতা-আরোহণে আগ্রহী সবাই ক্ষমতার চাবিটি হস্তগত করতে আকাক্সক্ষী। ফলে একটি দেশে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ক্ষমতাশালী লোকরা কোনোভাবেই ছাড়তে চান না ক্ষমতার রশি। আবার ক্ষমতার বাইরের অগ্রসরমাণ দল দ্রুত ক্ষমতা-আরোহণের স্বপ্নে বিভোর থাকেন। এ পরস্পর বিপরীতমুখী রশি টানাটানির সংকটে প্রকট হয়ে ওঠে রাজনৈতিক সমস্যা। এখান থেকেই শুরু রাজনৈতিক বিভাজন। বাংলাদেশে এ বিভাজনটিই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। রাজনৈতিক এ কুড়াল গোটা জাতিকে দ্বি-খণ্ডিত নয় শুধু টুকরা টুকরা করে দিয়েছে। ফলে একটি দেশ, এক ভাষার মানুষ প্রায় এক ধর্মে বিশ্বাসী হয়েও ঘৃণায় পরস্পর মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। শত্রু বিবেচনা করছে একে অপরকে। একটি দেশ এবং জাতির জন্য এটি ভয়ংকর! ঠিক এমন প্রেক্ষাপটে আমরা যদি ফিরি নজরুলের দিকে, কি পাই? পেয়ে যাই সেই অমৃত বাণী, যা শত্রুদলকে বন্ধুদলে রূপান্তরের যাদু। যেখানে সব কিছুর ওপরে মানুষের স্থান। মানুষের সম্মান। ‘গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই/ নহে কিছু মহিয়ান।’ আহা মানুষের প্রতি কী প্রেমময় বাণী! এ বাণী শুধু একাল কিংবা এ দেশের জন্য নয়। বরং সব কালের, সব দেশের মানুষের জন্য। এখানেই নজরুল সাহসী! এখানেই নজরুল সত্য উচ্চারণকারী! অর্থাৎ সামান্য রাজনৈতিক স্বার্থে জগতের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে হেয় জ্ঞান কর, তুমি কে! মানুষকে অবহেলা কর! কিংবা মানুষকে শত্রুর কাতারে ঠেলে দাও! কেনো? কি চাও তুমি? মানুষতো সৃষ্টির সবচেয়ে সম্মানীয়। সবচেয়ে দামি! অথচ তুমি তাকে মনে করছ দামহীন! মূল্যহীন! না এ হতে পারে না। হয় না। কী করে হবে! মানুষকে বাদ দিলে কী থাকে জগতের! এ জগৎটাই তো মানুষের আনন্দ অনুভূতির বাগান। সুতরাং ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। অর্থাৎ সৃষ্টি জীবের বা মহাবিশ্বের সৃষ্টির মধ্যে মানুষই শ্রেষ্ঠ। তার এ শ্রেষ্ঠত্ব সাহসের সঙ্গে সত্য ধারণ করার কারণেই।

নজরুলের একটি কবিতার নাম- ‘ভয় পেয়ো না হে মানবাত্মা।’ এ কবিতায় তিনি লিখেছেন- ‘সত্য পথের তীর্থ পথিক/ ভয় নাহি নাহি ভয়/ শান্তি যাদের লক্ষ্য/ তাদের/ নাই নাই পরাজয়/। অশান্তিকামী ছলনার রূপে/ জয় পায় মাঝে মাঝে/ অবশেষে চির লাঞ্ছিত হয়/ অপমানে আর লাজে।’ এ পঙ্ক্তিগুলো জীবনদর্শনে ঋদ্ধ। এটিই তো সূর্যালোকের মতো স্পষ্ট, যার পথচলা সত্যের দিকে, সত্য ধারণ করে তার তো ভয় নেই। কেননা, সত্য একদিন প্রতিষ্ঠিত হবেই। অন্ধকার সরবেই। শেষ হবে রাতের আঁধার। রাত শেষ হওয়া মানেই নতুন প্রভাতের আগমন। যে মিথ্যা আঁধারের মতো ছেয়ে থাকে, আলোর আগমনে পালিয়ে যায় মুহূর্তে এবং মিথ্যা লাঞ্ছিত হয়। অপমানিত হয়। এ কবিতার শেষাংশে এটিকে আরও তীব্র স্বচ্ছতা দিয়েছেন নজরুল-ভয় নাহি, নাহি ভয়/ মিথ্যা হইবে ক্ষয়/ সত্য লভিবে জয়!’ এইতো নজরুল, এইতো নজরুলের উচ্চারণ।

‘এক আল্লাহ জিন্দাবাদ’ কবিতার দুটো পঙ্ক্তি পাঠ করা যাক- উহারা চাহুক দাসের জীবন/ আমরা শহীদি দরজা চাই/ নিত্য মৃত্যু ভীত ওরা/ মোরা/ মৃত্যু কোথায় খুঁজে বেড়াই।’ এ এক বিস্ময় দুঃসাহসী উচ্চারণ নয়! মৃত্যুকে খুঁজে বেড়ানোর হিম্মত থাকে ক’জন লোকের বুকে। পৃথিবীর মানুষরা মৃত্যু থেকে পালিয়েই তো বেড়ায়। মৃত্যু ভয়ে কাতর চোখই পৃথিবীতে বেশুমার! জগতের সব কিছুর বিনিময়ে দুদণ্ড বাঁচতে চায় মানুষ। বাঁচতে চায় আরও আরও বেশিদিন। সেখানে কিনা নজরুল মৃত্যুকে খুঁজে বেড়ান! চোখ কপালে ওঠার পালা নয় কি!

‘বিদ্রোহী’ কবিতায় লিখেছেন-‘করি শত্রুর সাথে গলাগলি/ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা!’

মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা! হায়! কী অদ্ভুত শক্তির প্রকাশ। কথায় আছে, বীর দাঁড়িয়ে যায় মৃত্যুর মুখোমুখি। হয়তো সত্যি তাই। দাঁড়িয়েই যায়। নইলে মৃত্যুপথ থেকে বিজয় ছিনিয়ে আনে কী করে মানুষ! ঠিক বীরের মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে যাওয়া থেকে আগ বাড়িয়ে উচ্চারণ করলেন-করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা।

‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ এ থেকে পড়া যাক একটি অংশ-

‘ওরে ও পাগলা ভোলা/দে রে দে প্রলয় দোলা,/

গারদগোলা/ জোরসে ধরে হ্যাচকা টানে/

মারো হাঁক হায়দারী হাঁক,/কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক/

ডাক ওরে ডাক মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে...।’

এইযে, ডাক ওরে ডাক মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে-এর চেয়ে দুঃসাহসী উচ্চারণ কী হতে পারে! এ আহ্বান মৃত্যুকে নয়, বরং জীবনকেই ত্যাজদ্বীপ্তি দেওয়ার এক অনন্য মন্ত্র। এ মন্ত্রে উজ্জীবিত চোখই পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে।

নজরুলের একটি গানের অংশ বিশেষ পাঠের আমন্ত্রণ জানাই। গানটি হলো ‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান’-

যার মুখে শুনে তৌহিদের কালাম/ ভয়ে মৃত্যুও করিত সালাম/ যার দ্বীন দ্বীন রবে কাঁপিত দুনিয়া / জ্বিন ইনসান।’

উপরে কবিতাংশগুলোর প্রতিটিতে মৃত্যুর চিত্র মানবীয় কল্পনার অতি বিস্ময়কর চিত্র ফুটে উঠেছে। কিন্তু এ গানটিতে এসে বিস্ময়টিই যেন বিস্মিত হয়ে গেল। এখানে যেন স্থির হলো-জীবনের কাছে মৃত্যু পরাভূত। শুধু পরাভূত নয়, জীবন এখানে বীরত্বের প্রতীক! তাই মৃত্যু সসম্মানে হাত উঠিয়ে সালাম দিচ্ছে জীবনকে। আহা জীবনের কী সাহসী রূপ চিত্রিত করেছেন নজরুল।

মৃত্যু নিয়ে নজরুলের এসব কবিতা ও গানের শরীরে উঁকি দিলেই বুঝতে বাকি থাকে না, কেমন বুকের পাটা ছিল নজরুলের। কেমন বিশ্বাসে বলিয়ান ছিলেন তিনি। কেমন সত্য ধারণকারী ছিলেন একজন নজরুল। বলতেই হয়-বাংলা কবিতায় নজরুল হলেন সাহসী জীবনের ভাষ্যকার।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম