Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

বাংলা সাহিত্যে পলাশী ট্রাজেডি

Icon

আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলা সাহিত্যে পলাশী ট্রাজেডি

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মের এক বছর আগে ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত বাংলা গদ্য এবং ইতিহাসচর্চার ইতিহাসে ‘মাইল ফলক’ গ্রন্থ ‘সিরাজদ্দৌলা’য় অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় মহাশয় লিখেন, সিরাজদ্দৌলা কলঙ্ককাহিনীতে স্বদেশ-বিদেশ সমাচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে। কলঙ্কের ইতিহাস সর্বজনবিদিত। কলঙ্ক সৃষ্টির ইতিহাস সেরূপ নহে।... সিরাজকলঙ্ক প্রধানত দুই শ্রেণীতে বিভক্ত-প্রাচীন ও আধুনিক। এই সকল কলঙ্ক আবার দুই শ্রেণীতে বিভক্ত-লিখিত ও অলিখিত। প্রাচীন লিখিত কলঙ্ক সংখ্যা অধিক নহে। আধুনিক লিখিত কলঙ্ক সংখ্যা অধিক। কিন্তু অলিখিত কলঙ্কের নিকট লিখিত কলঙ্কগুলি পরাজয় স্বীকার করিয়াছে। লিখিত কলঙ্কগুলি ইতিহাসে সীমাবদ্ধ। অলিখিত কলঙ্কের আর সীমা নেই;-তাহা এখনও থাকিয়া থাকিয়া জন্মগ্রহণ করিতেছে।

-এই কথাগুলো যখন লেখা হয়, তখন পলাশী বিপর্যয়ের পর পেরিয়ে গেছে ১৪১ বছর। অর্থাৎ এই ১৪১ বছর ধরেই বাংলা বিহার ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রহননের কাজটি ‘অত্যন্ত নিষ্ঠার’ সঙ্গে অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার। এই কাজে তারা লাগিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী, ভারত প্রবাসী সাদা চামড়ার সায়েব লেখকদের। আর সবচেয়ে বেশি করে সাহায্য পাওয়া গিয়েছিল তথাকথিত বেঙ্গল রেনেসাঁর প্রডাক্টস কলকাতাকেন্দ্রিক অর্থ, বিত্ত, খ্যাতি ও পদোন্নতি ভিখারি বাবু-বুদ্ধিজীবীদের। তারও আগে মীরজাফরের সময় থেকে কিছু বেতনভুক্ত ‘ইতিহাস লিখিয়েদের’ দ্বারা কোম্পানি নিজ নিজ মনের মাধুরী মিশিয়ে উৎপাদন করিয়েছিল ইতিহাস। পাশাপাশি পথে প্রান্তরে সিরাজউদ্দৌলাকে হেয় করার জন্য, তার ভাবমূর্তি বিনাশ করার জন্য ছড়িয়ে দিয়েছিল ভাড়াটে লোকজন। গুজব ও গল্প ইতিহাসের নামে তাই চলে আসছিল তখন পর্যন্ত, এমনকি এখনও।

এই সব তৎপরতার উদ্দেশ্য ছিল একটাই, যে জটিল কুটিল ষড়যন্ত্র, প্রতারণা, জালিয়াতি, বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে বিদেশি ও দেশি বণিক, সমরনায়ক, রাজনীতিবিদ ও আমলারা পলাশীতে জয় পেয়েছিল এবং সিরাজউদ্দৌলাকে করেছিল নির্মমভাবে হত্যা, তাকে ভিন্নখাতে বইয়ে দিয়ে সিরাজকে ‘ভিলেন’ বানানো। কারণ সিরাজকে ‘ভিলেন’ বানাতে না পারলে নিজেদের পাপকেও যেমন জায়েজ করা যাবে না, তেমনি ‘হিরো’ সাজাও হবে না। খুব সঙ্গত কারণেই বিজয়ীপক্ষ পরাজিতের স্কন্ধকে নিজেদের পাপ স্থাপনের সুউচ্চ মঞ্চ বানিয়েছে। ফলে সত্য হয়েছে মিথ্যা, মিথ্যা পেয়েছে সত্যের সম্মান। আর এই মিথ্যাচার, লোককথা, গল্পকে হিতাহিত বাছ-বিচার না করে ইতিহাসের নামে, গল্পে, কবিতায়, মহাকাব্যে পরিবেশন শুরু করে বাংলাভাষী কবি, নাট্যকার ও গদ্যকারগণ।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদের এই মনোবাঞ্ছা চরিতার্থকারীদের আদি নাম রাম রাম বসু ও মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের এই বুদ্ধিজীবীর একজন তার প্রভুর প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত ‘রাজাবলী’তে (১৮০৩) লেখেন, ‘বিশিষ্ট লোকদের ভার্যা ও বধূ ও কন্যা প্রভৃতিকে জোর করিয়া আনাইয়া ও কৌতুক দেখিবার নিমিত্ত গর্ভিনী স্ত্রীদের উদর বিদারণ করানোতে ও লোকেতে ভরা নৌকা ডুবাইয়া দেওয়ানোতে দিনে দিনে অধর্ম বৃদ্ধি হইতে লাগিল।’

এই ধরনের আরো ‘গাঁজা’ ইতিহাসের নামে ছেড়ে ধন্য হয়ে আছেন রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আরেক সাগরেদ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের জীবনীকার ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ব্যয়স্য চরিত্রং’ (১৮০৫)। বাংলা গদ্যে লেখা প্রথম জীবনী ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ (১৮০১) -এর রচয়িতা রাম রাম বসুও একহাত নিয়েছেন সিরাজউদ্দৌলার ওপর। ‘নর-নারী’র লেখক নীলমনি বসাকও অপবাদ প্রচারে যথেষ্ট হাত পাকিয়েছিলেন।

এদের প্রায় সবার চোখেই ক্লাইভ ‘বীরশ্রেষ্ঠ’, ‘ব্যারন অব প্লাসি’, ‘পুরুষোত্তম’, জগৎশেঠ ‘সন্ত’, মীরজাফর ‘সাধু’, ‘মহাধর্মপ্রাণ’। আর ‘দুরচারী’, ‘পাপাত্মা’, ‘দুর্জন’, ‘পামর’ হলেন সিরাজউদ্দৌলা।

এই মিথ্যাচারকে কাব্য করার ক্ষেত্রে যিনি সবচেয়ে বেশি নাম কামিয়েছেন তিনি হলেন নবীন চন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯)। তার বহুল আলোচিত মহাকাব্য ‘পলাশীর যুদ্ধ’ (১৮৭৫)-এ প্রধান ষড়যন্ত্রকারী জগৎশেঠের মুখ দিয়ে সিরাজ সম্পর্কে বলেছেন :

কি বলিব আর/বেগমের বেশে পাপী পশি অন্তপুরে,

নিরমল কুল মম-প্রতিভা যাহার/মধ্যাহ্ন ভাস্করসম, ভূ-ভারত জুড়ে

প্রজ্বলিত-সেই কুলে দুষ্ট দুরাচার/করিয়াছে কলংকের কালিমা সঞ্চার।

অতএব রাজবল্লভ সিদ্ধান্ত জানাচ্ছেন :/চিন্ত সদুপায়! মম এই অভিপ্রায়-/সহৃদয় ইংরেজের লইয়া আশ্রয়/রাজ্যভ্রষ্ট করি এই দুরন্ত যুবায়,/(কতদিনে বিধি বঙ্গে হইবে সদয়!)/সৈন্যাধ্যক্ষ সাধু মিরজাফরের করে/সমর্পি এ রাজ্যভার।

‘মুহূর্তে ক্লাইভ যুদ্ধে হলে সম্মুখীন,/উড়াইবে তৃণবৎ যুবা অর্বাচীন।

তথাকথিত জাতীয় জাগরণের রঙ মাখিয়ে ইতিহাস বিকৃতি করে কাব্য বানিয়ে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী নবীন সেন এই গ্রন্থের জন্য যথেষ্ট ‘বাহবা’ পাচ্ছিলেন সরকারি এবং তার সগোত্রীয় বাবু-বুদ্ধিজীবীদের কাছে। গোল বাধালেন অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় মহাশয়। অব্যাহত অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ ভারতের প্রথম কণ্ঠস্বর। প্রথম এবং অসাধারণ। চিঠি লিখেছেন কবি নবীন সেনকে : ‘এই সকল কাল্পনিক সিরাজ কলঙ্ক প্রদর্শন করিবার হেতু কি?’

তার পক্ষ থেকে উত্তর এলো ‘সাহিত্য’ সম্পাদক সুরেশ চন্দ্র সমাজপতির :

নবীন বাবুর উত্তর এক লাইনও নয়। পলাশীর যুদ্ধ কাব্য, ইতিহাস নয়; আপনাকে ইহাই লিখিতে অনুমতি করিয়াছেন।

অক্ষয় কুমার যে তা জানেন না, তা নয়। তার বক্তব্য হলো,

এটা যে ইতিহাস নয় সে কথা তো সবাই জানে না। তার মতো ‘কৃতবিদ্য স্বদেশভক্ত সাহিত্য সেবক’ যে সর্ব্বথা স্বকপোলকল্পিত অযথা কলঙ্কে সিরাজউদ্দৌলার আপাদমস্তক কলঙ্কিত করে কাব্যরসের অবতারণা করবেন, তা সহসা ধারণা করতে সাহস না পেয়ে অনেকেই যে তার পলাশীর কাব্যকে ইতিহাস বলে গ্রহণ করে থাকেন।

তাই তো তিনি বললেন, কবির পথ নিষ্কণ্টক হইলেও ঐতিহাসিক চিত্র চয়নে সর্ব্বথা নিরঙ্কুশ হইতে পারে না।

ক্ষুব্ধ কণ্ঠে এরপর উচ্চারণ :

সে কালের ইংরাজ বাঙালি মিলিত হইয়া, সিরাজদ্দৌলার নামে কত অলীক কলঙ্ক রটনা করিয়া গিয়াছেন, তাহা সকলের নিকট অপরিচিত নাই! অবসর পাইলে একালের প্রতিভাশালী সাহিত্য সেবকগণ এখনও কত নতুন নতুন রচনা কৌশলের পরিচয় প্রদান করিতে পারেন ‘পলাশীর যুদ্ধ কাব্য তাহারই উৎকৃষ্ট নিদর্শন। যাহা সেকালের লোকেও জানিত না, যাহা সিরাজদ্দৌলার শত্রুদলও কল্পনা করিতে সাহস পাইত না-এ কালের লোকে তাহারও অভাব পূরণ করিতে ইতস্তত: করিতেছেন না। (সিরাজদৌলা, পৃষ্ঠা ২০৫)

তিনি উপসংহারে উপনীত হন এই বলে :

‘যে দেশের কবি-কাহিনী ইতিহাস রচনার ভার গ্রহণ করিয়াছে সে দেশে সিরাজ কালিমা উত্তরোত্তর দুরপনেয় হইয়া উঠিবে, তাহাতে আর বিস্ময়ের কি?’ (সিরাজদ্দৌলা-২০৬)।

সংঘবদ্ধ চক্রের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় মহাশয় দু’জন বিখ্যাত মানুষকে তাঁর পাশে দেখতে পান। এর একজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অন্যজন ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। আর এর ভেতর দিয়ে নতুন এক রবীন্দ্রনাথের সন্ধান আমরা পাই।

নবীনচন্দ্র সেনের কবির পথ ‘নিষ্কণ্টক’, সুতরাং ‘তিনি ইতিহাস মানিতে বাধ্য নহেন’ এই বক্তব্যের ওপর রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় নিজের মত প্রদান করতে গিয়ে ইংরেজি সাহিত্যের টেনিসনের উদাহরণ টেনে আনেন। টেনিসন তিনটি ঐতিহাসিক নাটক লেখেন। এর মধ্যে Queen Mary (রানী মেরি) লেখার আগে যে শতাধিক ইতিহাস গ্রন্থ তিনি পাঠ করেন, তার একটা তালিকা তুলে দেন। তারপর তাঁর মন্তব্য :

টেনিসন নিজের পথ নিতান্ত নিষ্কণ্টক ভাবিলে প্রথমেই এতগুলি ঐতিহাসিক পুস্তক পাঠ করিতেন না। পরে আরও পড়িয়া তবে নাটক লিখিয়াছিলেন। আমাদের জানিতে কৌতূহল হয় কবি নবীনচন্দ্র কতকগুলি ইতিহাস পড়িয়া তবে পলাশীর যুদ্ধ লিখিয়াছিলেন।

নবীনচন্দ্র সেনের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও এই বক্তব্যে আক্রান্ত হন। কারণ বঙ্কিম বলেছিলেন,

ইতিহাসের উদ্দেশ্য কখন কখন উপন্যাসে সুসিদ্ধ হইতে পারে। উপন্যাস লেখক সর্বত্র সত্যের শৃঙ্খলে বদ্ধ নহেন। ইচ্ছামতো অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য কল্পনার আশ্রয় লইতে পারেন।

অন্যদিকে গ্লাডস্টোন Queen Mary সম্পর্কে বলেছেন, ‘এ গ্রন্থ একটা Careful Historic Study’.

রামানন্দ দেখান, বেরিং ফিল্ড Queen Mary নাটকের একটি চরিত্র সম্পর্কে আপত্তি করলে ন্যায়নিষ্ঠ টেনিসন সেই চরিত্রটিই নাটক থেকে বাদ দেন।

টেনিসনের ‘বেকেট’ নাটক সম্পর্কে বিখ্যাত ঐতিহাসিক গ্রিন বলেন,

আমার সমুদয় গবেষণা দ্বারা দ্বিতীয় হেনরির চরিত্র ও পারিষদগণের বিষয়ে আমার তদ্রূপ উজ্জ্বল জ্ঞান জন্মে নাই, যেমন টেনিসনের বেকেট পড়িয়া হইয়াছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখনো নোবেল পুরস্কারে অভিষিক্ত হননি। সিরাজউদ্দৌলা সম্পর্কে তার আর কোনো লেখারও উল্লেখ পাওয়া যায় না। যদিও মৈত্রেয় মহাশয়ের লেখা থেকে আমরা জানি যে ‘ভূতপূর্ব ‘সাধনা’ সম্পাদক শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সিরাজদ্দৌলাকে’ প্রথম পাঠক সমাজে উপনীত করেন।’ তারপর এই গ্রন্থ যখন ইংরেজকুলে গোস্বার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন রবীন্দ্রনাথ কলম ধরলেন :

শ্রীযুক্ত অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় মহাশয়ের সিরাজদ্দৌলা পাঠ করিয়া কোনো অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পত্র ক্রোধ প্রকাশ করিয়াছেন। স্বজাতি সম্পর্কে পরের নিকট হইতে নিন্দোক্তি শুনিলে ক্রোধ হইতেই পারে। সমূলক হইলেও।

কিন্তু আমাদের সহিত উক্ত সম্পাদকের কত প্রভেদ! আমাদিগকে বিদেশী লিখিত নিন্দোক্তি বাধ্য হইয়া অধ্যয়ন করিতে হয়, তাহা মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিতে হয়। মৈত্রেয় মহাশয়কে কিঞ্চিত ‘অবৈধ আবেগের’ জন্য মৃদু অভিযুক্ত করার পরও রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনার শেষে স্পষ্ট করে লেখেন :

সবল দুর্বলকে যেমন স্বচ্ছন্দে নিশ্চিন্ত-চিত্তে বিচার করিয়া থাকে, দুর্বল সবলকে তেমন করিয়া বিচার করিতে গেলে সবলের ভ্রুযুগল কুটিল এবং মুষ্টিযুগল উদ্যত হইয়া উঠিতে পারে। অক্ষয় বাবু হয়তো আদিম প্রকৃতির সেই রূঢ় নিয়মের অধীনে আসিয়াছেন, কিন্তু বাংলা ইতিহাসে তিনি যে স্বাধীনতার যুগ প্রবর্তন করিয়াছেন সেজন্য তিনি বঙ্গসাহিত্যে ধন্য হইয়া থাকিবেন।

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয়ের ‘সিরাজদ্দৌলা’ প্রকাশের পর পলাশী ট্রাজেডি নিয়ে আমাদের সাহিত্যের অন্ধকার যুগ স্তিমিত হয়ে আসে। অন্ধকারের কুশীলবরা অন্তত এটা উপলব্ধি করলেন, যা তা লিখে, কাণ্ডজ্ঞানহীন বিদ্বেষ প্রচার করে, সাম্রাজ্যবাদের কল্কি হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু জনগণের মনের মণিকোঠায় জায়গা পাওয়া যাবে না।

আর যারা ব্যথিত ক্ষুব্ধ হৃদয় নিয়ে নির্বিরাম ‘নান্দনিক’ অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছিলেন, তারা এবার জেগে উঠলেন। শুরু হলো পলাশী থেকে শিক্ষা নিয়ে জাতীয় জাগরণের পথে এগিয়ে চলা। শুরু হলো ‘স্বাধীনতার যুগ’ প্রবর্তনের কষ্টসাধ্য দুঃসাহসী কর্ম।

দুই

বিদেশি ব্রিটিশ বেনিয়াদের সঙ্গে দেশি স্বার্থান্ধ উচ্চাভিলাষীদের জটিল কুটিল ষড়যন্ত্রের ফলে পলাশীর প্রান্তরে অস্তমিত হয় স্বাধীনতার সূর্য-যে স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে প্রতীক ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। পলাশীর পরাজয় এবং সিরাজের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে জাতির জীবনে নেমে আসে পরাধীনতার অসহনীয়, অবমাননাকর গ্লানি। সেদিক থেকে পলাশী আমাদের লজ্জা ও কলঙ্কের অধ্যায়। আবার একই সঙ্গে পলাশী আমাদের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণেরও ক্ষেত্র। পলাশী উন্মোচিত করে দেশি-বিদেশি বিশ্বাসঘাতকতার স্বরূপ। আবার পলাশী আমাদের অপমানের শরশয্যা থেকে উঠে দাঁড়ানোরও ডাক দেয়। এজন্য ইতিহাসের অন্য দশটি ঘটনার সঙ্গে পলাশীর রয়েছে মৌলিক পার্থক্য। এই পার্থক্যের কারণেই আজ ২৫২ বছর পরও পলাশীর ট্রাজেডিকে অনুধাবন করার তাৎপর্য ও গুরুত্ব যে অনস্বীকার্য দ্যুতি নিয়ে অনুভূত হচ্ছে-বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও সেভাবেই অন্তরে ধারণ করেছিল বাংলা সাহিত্য।

প্রথমেই নাটক প্রসঙ্গ। পলাশী তথা সিরাজউদ্দৌলাকে মঞ্চের পাদপ্রদীপের আলোয় আনার প্রথম কৃতিত্ব নাট্যকার গিরিশ চন্দ্র ঘোষের (১৮৪৪-১৯১২)। তিনি ইংরেজ ও তাদের এদেশীয় ‘গৃহপালিত’ ইতিহাসকারদের কাহিনীর ওপর ভরসা করেননি। গিরিশ ঘোষ বলেন :

সুপ্রসিদ্ধ-ঐতিহাসিক বিহারীলাল সরকার, শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, শ্রীযুক্ত নিখিলনাথ রায়, শ্রীযুক্ত কালিপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি শিক্ষিত সুধীগণ অসাধারণ অধ্যবসায় সহকারে বিদেশী ইতিহাস খণ্ডন করিয়া রাজনীতিক ও প্রজাবৎসল সিরাজের স্বরূপচিত্র প্রদর্শনে যত্নশীল হন। আমি ওই সমস্ত লেখকগণের নিকট ঋণী। ফলে ‘সিরাজদৌলা’য় কিছু দোষ-ত্রুটি থাকলেও : সিরাজদৌলার জীবনধারাকে অনুসরণ করে নাট্যকার স্বাধীনতার আবেগকে প্রকাশ করেছেন। তৎকালীন সমাজে পরাধীনতার বেদনায় বাঙালির যে চিত্তবিক্ষোভ ‘সিরাজদৌলা’ নাটক তার পরিচয় বহন করছে। (বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত : মুহাম্মদ আবদুল হাই, সৈয়দ আলী আহসান: পৃষ্ঠা ২৭০)।

১৩১২ সালের ২৪ শে ভাদ্র এ নাটক প্রথমবার মঞ্চে উপস্থাপিত হয়। ১৯১১ সালে এই নাটকের প্রচার ও অভিনয় নিষিদ্ধ করে ব্রিটিশ সরকার। ক্ষিরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদের (১৮৬৪-১৯৩৭) ‘পলাশীর প্রায়শ্চিত্ত’ এই ধারার আরেকটি নাটক। পলাশীর ঘটনা নিয়ে বাংলা ভাষায় রচিত সবচেয়ে জনপ্রিয় নাটকটির নাম ‘সিরাজদৌলা’-নাট্যকার শচীন সেনগুপ্ত (১৮৯২-১৯৬১)। এই নাটকটি প্রথমবার মঞ্চে আসে ১৯৩৮ সালের ২৯ শে জুন। মঞ্চস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্জন করে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা। পরবর্তীকালে মূলত এই নাটকের ওপর ভিত্তি করে খান আতাউর রহমান নির্মাণ করেন তার কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘নবাব সিরাজদৌলা’। এই নাটক জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুল তখন তার বাঁধভাঙা প্রাণ প্রাবল্য নিয়ে খ্যাতির মধ্যগগনে। তিনি এই নাটকটি সম্পাদনা করে দেন। নাটকে ব্যবহৃত ৬টি গান, ‘আমি আলোর শিখা’, ‘ম্যয় প্রেম নগরকো জাউঙ্গী’, ‘কেন প্রেম যমুনা আজি হল অধীর’, ‘পথহারা পাখি কেঁদে ফিরে একা’, ‘এ-কূল ভাঙে ও-কুল গড়ে এইত নদীর খেলা’ ও ‘পলাশী হায় পলাশী’ নজরুলের লেখা। এই নাটকের সঙ্গীত পরিচালকও ছিলেন নজরুল।

মঞ্চের সঙ্গে ১৯৩৯ সালের ২৪ শে নভেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যা ৬.৪৫ মিনিটে একটানা ২ ঘণ্টা ধরে এই নাটক রেডিওতে প্রচারিত হয়। সিরাজের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা নির্মলেন্দু লাহিড়ী। আলেয়ার সংলাপ দিয়েছিলেন ঊষাবতী, গান গেয়েছিলেন হরিমতী। অবশ্য মঞ্চে কণ্ঠ দেন নীহারবালা। রেডিওতে এ নাটক পরিচালনা করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র (১৯০৫-১৯৯১)।

এর পরপরই HMV কোম্পানি থেকে এই নাটকের রেকর্ড বের হয়। রেকর্ডে আলেয়ার গানে কণ্ঠ দেন পারুলবালা ঘোষ। মাঝির গানে কণ্ঠ দেন মৃণালকান্তি ঘোষ। নাটকের পাড়া অতিক্রম করে এই ‘সিরাজদৌলা’ অচিরেই জায়গা করে নেয় ‘যাত্রা’ দলে। সেই দিন থেকে অদ্যাবধি যাত্রার পালায় সমান জনপ্রিয়তা নিয়ে পরিবেশিত হচ্ছে ‘সিরাজদৌলা’।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকার মঞ্চে নতুনভাবে উঠে আসে সিরাজউদ্দৌলা। এই পর্বের নেতৃত্ব দেন কবি নাট্যকার সিকান্দার আবু জাফর (১৯১৮-১৯৭৫)। ১৯৫১ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত হলো তার নাটক ‘সিরাজউদদৌলা’। সিকান্দার আবু জাফর বাংলাদেশের একমাত্র কবি ও নাট্যকার যিনি কুখ্যাত ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’ অপসারণে রাজনৈতিক নেতা সুভাষচন্দ্র বসুর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় কলঙ্কস্তম্ভটি চূর্ণ করার চাক্ষুস সাক্ষী। সঙ্গত কারণেই তিনি তার নাটকের ভূমিকায় বলছেন :

কাজেই নতুন মূল্যবোধের তাগিদে ইতিহাসের বিভ্রান্তি এড়িয়ে ঐতিহ্য ও প্রেরণার উৎস হিসেবে সিরাজ-উ-দ্দৌলাকে আমি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছি। একান্তভাবে ইতিহাসের কাছাকাছি থেকে এবং প্রতি পদক্ষেপে ইতিহাসকে অনুসরণ করে আমি সিরাজ-উ-দ্দৌলার জীবননাট্য পুনর্নির্মাণ করেছি। ধর্ম এবং নৈতিক আদর্শে সিরাজ-উ-দ্দৌলার যে অকৃত্রিম বিশ্বাস, তার চরিত্রের যে দৃঢ়তা এবং মানবীয় সদগুণগুলোকে চাপা দেবার জন্য ঔপনিবেশিক চক্রান্তকারী ও তাদের স্বার্থান্ধ স্তাবকেরা অসত্যের পাহাড় জমিয়ে তুলেছিল, এই নাটকে প্রধানত সেই আদর্শ এবং মানবীয় গুণগুলোকেই আমি তুলে ধরতে চেয়েছি।

[সিরাজ-উদ-দৌলা : ভূমিকা

১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে এ নাটক ঢাকায় প্রথম মঞ্চস্থ হয়। ১৯৫২ সালেও মঞ্চে আসে এ নাটক। বাংলা একাডেমী জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থার অর্থানুকূল্যে ১৯ শে এপ্রিল ১৯৬৩-তে আবার মঞ্চে আসে এ নাটক। বাংলা একাডেমী এ নাটক গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে ১৯৬৩ সালে। একই সময়ে করাচিতে পূর্ব পাকিস্তান সমিতির প্রযোজনায় ‘কন্ট্রাক’ হলে অভিনীত হয়। সে সময় সিরাজের ভূমিকায় নামেন খান আতাউর রহমান। আর মীরজাফরের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন প্রখ্যাত চিত্রকলা শিল্পী এস এম সুলতান।

সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে লেখা বাংলাদেশ পর্বের একমাত্র নাটক নাট্যকার সাইদ আহমেদের ‘শেষ নবাব’।

তিন

নবীন সেন, হেমচন্দ্রের সমগোত্রীয় কবি কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫২) মূলত মহাকাব্যকার হলেও ‘অশ্রুমালা’ (১৮৯৪) তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে আধুনিক বাংলা গীতি কবিতার প্রথম কবি কায়কোবাদ। ‘অশ্রুমালা’ কাব্যে প্রকাশিত তার ‘সিরাজসমাধি’ এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন :

এই সে সমাধি গৃহ-এই স্থানে হায়/বঙ্গের গৌরব-সূর্য চিরঅস্তমিত।

এই স্থানে-কি বলিব বুক ফেটে যায়,/স্মরিলে সে কথা প্রাণ হয় আকুলিত।

কত যুগ যুগান্তর গিয়াছে চলিয়া,/সিরাজের অস্থি লয়ে ব্যথিত অন্তরে

আজিও সে ম্লান বেশে আছে দাঁড়াইয়া/হেরিলে তা কার চক্ষে অশ্রু নাহি ঝরে?/নিখিলের এ সমাধি মুহূর্তের তরে,/অতীতের কত কথা পড়ে এই মনে!/কত ঝড় বয়ে যায় প্রাণের ভিতরে,/কত চিত্র ভেসে উঠে নয়নের কোণে!/মনে পড়ে পলাশীর ভীষণ প্রাঙ্গণ,/কুটচক্রী জাফরের ঘোর কৃতঘ্নতা!/বীরশ্রেষ্ঠ ক্লাইভের প্রাণান্তুক রণ,/বাঙালি জাতির চিরকলঙ্কের কথা!

হতভাগ্য সিরাজের অন্তিম প্রার্থনা-/-জাগায় মানবপ্রাণে কি তীব্র বেদনা?

ক্লাইভ এখানে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ হলেও কবির বেদনার অন্তনির্হিত নির্যাস সহজেই অনুমান করা যায়।

শাহাদাৎ হোসেনের (১৮৯৩-১৯৫৩) ‘সিরাজ স্বপ্ন’ নিয়ে এসেছে ব্যর্থ ব্যাকুল রোমাঞ্চাচ্ছন্ন এক তরুণ নবাবের অন্তরক্ষরণের দহন। সিরাজ জীবনের শেষ দৃশ্যই এই কাব্যনাটিকার মূল উপজীব্য।

তবে নজরুলের (১৮৯৯-১৯৭৬) আবির্ভাবের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বাংলা কবিতায় পলাশী ট্র্যাজেডি কিংবা সিরাজউদ্দৌলার শাহাদতবরণ নিতান্ত শোকের, ব্যর্থতার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পলাশী যে কেবল অশ্রু ফেলার গোরস্তান নয়, এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে জাতিকে যে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করা যায়-এ দিকটা অনাবিষ্কৃতই থেকে যেত যদি নজরুল তার যুগপ্রবর্তক প্রতিভা নিয়ে মাঠে না নামতেন।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন এবং সৃষ্টিশীলতায় অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করে আছে পলাশী। পলাশীর বেদনার গোঙরানি তাঁর অন্তর্লোককে একদিকে যেমন করেছে রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত, অন্যদিকে জুগিয়েছে উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বজ্রের মতো জ্বলে ওঠার প্রেরণা। ফলে তিনি পরিণত হয়েছেন জাতীয় জাগরণের প্রতীকে; পরাধীনতা, শোষণ, ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়ার আমাদের প্রধান অবলম্বনে। এজন্যই নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার কাছে মাতৃভূমির জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী এক মহান স্বাধীনতাযোদ্ধা, জাতীয় বীর।

তিনি ব্যথিত হয়েছেন, হয়েছেন উদ্বেলিত। তাঁর মানসলোকে পলাশী যে, সবসময় ছিল, তার নজির ছড়িয়ে আছে অবিনাশী সৃষ্টি সম্ভারে। তবে এই অবস্থান সব সময় প্রত্যক্ষ তা নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরোক্ষে। তাঁর ‘আনন্দময়ী আগমনে’ যেমন পলাশী আছে, তেমনি আছে ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ কবিতায়। আবার প্রত্যক্ষ হয়েছে ‘নবাগত উৎপাত’ কবিতায়। কিংবা শচীন সেনগুপ্তের নাটকে।

বাংলা ভাষাভাষী কবিদের মধ্যে নজরুলই প্রথম এবং একমাত্র কবি যিনি সাড়ম্বরে গভীর দেশপ্রেম ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সিরাজের শাহাদৎবার্ষিকী পালনের জন্য বিবৃতি প্রদান করেছিলেন। ১৯৩৯ সালের ২৯ শে জুন দৈনিক আজাদ-এ প্রকাশিত হয়েছিল এই বিবৃতি।

দৈনিক আজাদে প্রকাশিত সেই মহার্ঘ বিবৃতির পুরোটাই তুলে দিলাম :

কবি নজরুল ইসলাম

‘সিরাজ স্মৃতি উদযাপনের আবেদন’

‘বীর শহীদের জীবনস্মৃতি হইতে প্রেরণা লাভ করুন’

আগামী ৩ রা জুলাই সিরাজদৌলা স্মৃতি দিবস পালনের জন্য আয়োজন হইতেছে, সে সম্পর্কে বাংলার বুলবুল কবি কাজী নজরুল ইসলাম নিম্নরূপ আবেদন প্রচার করিয়াছেন :

আমি জানিতে পারিলাম যে, আগামী ৩ রা জুলাই সিরাজউদ্দৌলা দিবস পালনের আয়োজন চলিতেছে। একথা আজ সর্বজনসম্মত যে বাঙলার শহীদ বীর ও শেষ স্বাধীন নৃপতি নওয়াব সিরাজউদ্দৌলা রাজনৈতিক কোলাহলের ঊর্ধ্বে। হিন্দু মুসলমানের প্রিয় মাতৃভূমির জন্য নওয়াব সিরাজউদ্দৌলা সংগ্রামে অবতীর্ণ হন।

সর্বোপরি বাংলার মর্যাদাকে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়াছিলেন এবং বিদেশী শোষণের কবল হইতে দেশকে রক্ষা করিবার জন্য আপনার জীবন যৌবনকে কোরবানী করিয়া গিয়াছেন।

মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ’র নেতৃত্বে কলিকাতার সিরাজউদ্দৌলা স্মৃতি কমিটি উক্ত অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করিবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করিতেছেন। কলিকাতা কমিটিকে সর্বপ্রকারে সাহায্য প্রদান করিয়া আমাদের জাতীয় বীরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করিবার জন্য আমি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের নিকট আবেদন জানাইতেছি। বিদেশীর বন্ধন শৃঙ্খল হইতে মুক্তি লাভের জন্য আজ আমরা সংগ্রামরত। সিরাজউদ্দৌলার জীবনস্মৃতি হইতে যেন আজ আমরা অনুপ্রাণিত হই-ইহাই আমার প্রার্থনা।

[নজরুল রচনায় পলাশী ট্রাজেডী : নজরুল ইনস্টিটিউট। পৃষ্ঠা-২]

এই ‘জাতীয় বীর’ ও স্বাধীনতার যোদ্ধাকে সম্মান জানাতে নজরুলের পরবর্তী কবিরাও পিছিয়ে থাকেননি। গোলাম মোস্তফার (১৮৯৭-১৯৬৫) ‘১৭৫৭ সালের বিপ্লব’, তালিম হোসেনের (১৯১৮-১৯৯৫) ‘সিরাজ স্মরণ’, ‘হায় সিরাজ, সিরাজ’, ফররুখ আহমদের (১৯১৮-১৯৭৪) ‘মীর জাফরের কৈফিয়ত, আল মাহমুদের ‘পলাশীর স্মৃতি ১৯৯৭’, ফরহাদ মজহারের ‘আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের সামনে’, আবদুল হাই শিকদারের ‘সিরাজদৌলা’, মতিউর রহমান মল্লিকের ‘মীরজাফর’, আসাদ-বিন হাফিজের ‘হারজিত’ কিংবা হাসান আলীমের কবিতা-একই চেতনার আলোকে উদ্ভাসিত!

চার

পলাশীর ট্র্যাজেডি যে কেবল ইতিহাস এবং লিখিত সাহিত্যকেই বেদনার্ত এবং আলোড়িত করেছে তা নয়, আমাদের জনজীবনকেও করেছিল ব্যাপকভাবে ব্যথিত। রেখে গেছে গভীর প্রভাব। আজো মুর্শিদাবাদ, মালদহ কিংবা রাজশাহী অঞ্চলে লোককবির কণ্ঠে ‘মর্সিয়া’র মতো করুণ রসে সিক্ত হয়ে গীত হয় পালা হাহাকার। ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় মুর্শিদাবাদ এলাকা থেকে উদ্ধার করেছিলেন এমনই কয়েকটি লোকগীতি, যা পরে তিনি তার ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’ গ্রন্থের পরিশিষ্ট অংশে মুদ্রিত করেন। এর মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে পলাশীর গানটির কয়েকটি চরণ এরকম :

কি হলো রে জান।

পলাশীর ময়দানে নবাব হারাল পরাণ।

তীর পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি পড়ে রয়ে,

একলা মীরমদন বল কত নেবে সয়ে।

ছোট ছোট তেলেঙ্গাগুলি লাল কুর্তি গায়,

হাঁটু গেড়ে মারছে তীর মীরমদনের গায়।

কি হলো জান-

পলাশী ময়দানে নবাব হারাল পরাণ।

নবাব কাঁদে সিপুই কাঁদে আর কাঁদে হাতী,

কলকেতাতে বসে কাঁদে মোহনলালের বেটি

কি হলো রে জান-

পলাশী ময়দানে উড়ে কোম্পানি নিশান।

-এই গানে কিছু তথ্যগত ভুল আছে। পড়ার সময় মনে রাখতে হবে এ হলো আদি অকৃত্রিম লোকগীতি। লোককবিদের কাছে তথ্যের চাইতেও বড় হয়ে ওঠে পরিবেশনের বৈশিষ্ট্য।

‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে’-এর মতো বিখ্যাত লোকছড়া কার লেখা তা যেমন জানার উপায় নেই, তেমনি এই গানটির রচয়িতার নামও চিরকালের জন্য আড়ালেই থাকবে।

পাঁচ

বাংলা সাহিত্যের পলাশী ট্র্যাজেডি সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত হয়েছে উপন্যাসে। যদিও দু’একটি লিখিত হয়েছে, সেগুলো ইংরেজদের ‘খাস-দালালি’ করার মতলবে। বাকিগুলো অখাদ্য। ফলে একদিকে যেমন ঘটেছে ইতিহাস বিকৃতি, অন্যদিকে দৃষ্ট হয়েছে সাম্প্রদায়িকতায়।

সব মিলিয়ে বলা যায়, পলাশী নিয়ে কবিতা, উপন্যাস কিংবা নাটকে আরো বড় আরো মহৎ কিছু করার সময় শেষ হয়ে যায়নি। তবে সেক্ষেত্রে রচয়িতাকে হতে হবে টেনিসনের মতো সত্যনিষ্ঠ। গায়ের জোরে বদ মতলব তাড়িত হয়ে বাজে কিছু করার চাইতে না করাই তো ভালো।

টেনিসন তার বিখ্যাত ঐতিহাসিক নাটক ‘বেকেট’-এর ভূমিকায়, তার নাটকে স্থান পাওয়া বিভিন্ন ঐতিহাসিক চরিত্রসমূহের বিদেহী আত্মার উদ্দেশ্যে একটি চমৎকার চতুর্দশপদী কবিতা লেখেন। তার শেষ কয়েকটি চরণ বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ :

আমি যদি তোমাদিগকে এমন কথা বলাই,

যাহা তোমরা বল নাই-

যদি তোমাদিগের সদগুণ বিলুপ্ত করিয়া ফেলি,

এবং তোমাদিগকে সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে গঠিত করি,

তাহা হইলে, হে প্রাচীন প্রেতাত্মাগণ

আমার উপর ক্রুব্ধ হইও না।

কারণ, যিনি আমাদিগকে ঠিক জানেন,

তিনি জানেন, যে কেহই নিজের একদিনের

জীবনেরও যথার্থ বৃত্তান্ত লিখিতে পারে না।

এবং পৃথিবীতে আর কেহই তাহার জন্য

লিখিয়া দিতে পারে না।

[রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় অনূদিত]

-যদি এই রকম দায়িত্ববোধ কারও মধ্যে থাকে, তাহলে সে ব্যক্তি যত বড় লেখকই হন, নিজের পাপকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য, ঘাড় উঁচু করে বলবেন না,

উপন্যাস লেখক সর্বত্র সত্যের শৃঙ্খলবদ্ধ নহেন। ইচ্ছামতো অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য কল্পনার আশ্রয় লইতে পারেন।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম