রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ও সমাজচিন্তা
গোলাম রব্বানি
প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রবীন্দ্রনাথের কথা চিন্তা করলেই আমাদের মানসপটে শ্বেত-শুভ্র লম্বা চুল দাড়িবিশিষ্ট একজনের ছবি মাথায় আসে, মনে হয় নিজের মনে সারা দিন কবিতা ও সাহিত্য সাধনাতেই মগ্ন ছিলেন তিনি, মনে হয় জগৎ সংসারের আর কোনো কিছু নিয়ে যেন তার মাথাব্যথা নেই-এর সঙ্গে এ পল্লি সংস্কারক রবীন্দ্রনাথের কোনো মিল নেই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি কোনো খেয়ালি উদাসীন মানুষ ছিলেন না, ছিলেন সত্যিকারের একজন সমাজ সংস্কারক-যিনি বুঝেছিলেন, সাধারণ জনগোষ্ঠীর উন্নতি করতে না পারলে, তাদের স্বাবলম্বী করতে না পারলে সব রাজনৈতিক আন্দোলন অর্থহীন, তথাকথিত স্বাধীনতার কোনো মূল্য থাকবে না। তাই অন্য নেতারা যখন ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত, সে সময় তিনি সাধারণ মানুষের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের পরিচিত কবি রবীন্দ্রনাথকে আমরা এখানে পাই নতুন রূপে।
ছেলে রথীন্দ্রনাথ লিখেন ‘কিছুদিন পর বাবা দেখলেন প্রজারা ঋণমুক্ত না হলে তারা কোনো বিষয়েই উন্নতি করতে পারবে না। কৃষির বা শিল্পের জন্য যেটুকু মূলধন দরকার তা তাদের হাতে কখনোই থাকবে না। এজন্য বাবা পতিসরে একটি ব্যাংক খুললেন। কয়েকজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ব্যাংকের কাজ শুরু হলো। পরে বাবা যখন নোবেল প্রাইজ পেলেন এক লাখের ওপর সব টাকাটাই এ কৃষি ব্যাংকের কাজে দিলেন। কৃষি ব্যাংক হয়ে প্রজাদের খুব উপকার হলো-কয়েক বছরের মধ্যেই তারা মহাজনদের দেনা সম্পূর্ণ শোধ করে দিতে পেরেছিল।’
তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রেষ্ঠ কাজ কিন্তু পতিসর নামক একটি অঞ্চলের উন্নতি ঘটানো নয়, আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থার একটি মডেল স্থাপনে। আমরা আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থার নানা রকম মডেল খুঁজি, দেশে ও বিদেশে। কিন্তু আমাদের চোখের সামনেই বিদ্যমান সেই মডেল। সেই মডেল স্থাপন করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মডেলটির নাম শান্তিনিকেতন। শিক্ষাক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের এই যে অবদান এটা নিয়ে খুব বেশি কথাবার্তা হয় না। অবশ্য আমাদের দোষ দেওয়া যায় না, কারণ তার সাহিত্য জগতের দ্যুতি এতটাই প্রখর যে, সেই ঔজ্জ্বল্যে আশপাশের অন্যান্য ব্যাপারগুলো হুট করে চোখে পড়ে না, চোখে ধাঁধা লেগে যায়। সেই দ্যুতিতে চোখ একটু সয়ে এলে তবেই আমরা আশপাশের জিনিসগুলোর দিকে তাকানোর ফুরসত পাই।
দেশ-রাষ্ট্র-ধর্ম-জাতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন উদারনৈতিক চেতনার অধিকারী। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কিছুকাল পর ১৯১৪ সালে কোনো এক গুণমুগ্ধ ইংরেজ পাঠিকাকে কবি চিঠিতে লেখেন-
‘I do not belong to any religious sect nor do I subscribe to any particular Creed. That I know that the moment my God has created me he has made himself mine.’ আর এ কারণেই তিনি বিশ্বকবি। সমগ্র পৃথিবীর সমগ্র মানব জাতির সম্পদ। শিক্ষার ক্ষেত্রেও তিনি এ আন্তর্জাতিক উদার চেতনা লালন করতেন। অল্প বয়সেই শিক্ষাব্যবস্থার অসাড়তাটুকু ধরতে পেরেছিলেন তিনি। হয়তো এ কারণেই গতানুগতিক শিক্ষালাভ করেননি তিনি। রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন মাত্র ষোলো বছর তখন ‘ভারতী’ পত্রিকায় এক প্রবন্ধে তিনি লেখেন-
বঙ্গদেশে এখন এমনি সৃষ্টি ছাড়া শিক্ষাপ্রণালী প্রচলিত হইয়াছে যে, তাহাতে শিক্ষিতেরা বিজ্ঞান দর্শনের কতকগুলি বুলি এবং ইতিহাসের সাল ঘটনা ও রাজাদিগের নামাবলী মুখস্থ করিতে পারিয়াছেন বটে, কিন্তু তাহাতে তাঁহাদের রুচির উন্নতি করতে পারেন নাই বা স্বাধীনভাবে চিন্তা করিতেও শিখেন নাই। আমাদের বর্তমান ‘শিক্ষিত সমাজের’ ক্ষেত্রেও কথাগুলো আজও কত তীব্রভাবে সত্য। অল্প বয়সের এই চিন্তা পরিণত বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেল ‘শান্তিনিকেতন’ ও শ্রীনিকেতন নামে দুটি শিক্ষা-আশ্রম প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে ১৯০১ সালে এক চিঠিতে তিনি লেখেন-
শান্তিনিকেতনে আমি একটি বিদ্যালয় খুলিবার জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করিতেছি। সেখানে ঠিক প্রাচীনকালের গুরুগৃহ বাসের মতো সমস্ত নিয়ম। বিলাসিতার নাম গন্ধ থাকিবে না। উপযুক্ত শিক্ষক কোনোমতেই খুঁজিয়া পাইতেছি না। এখনকার কালের বিদ্যা ও তখনকার কালের প্রকৃতি একত্রে পাওয়া যায় না। ১৯০১ সালের ২২ ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় স্থাপিত হয় ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ নাম দিয়ে। ডিগ্রি পাওয়া ও চাকরি করা এগুলোর সামাজিক গুরুত্ব যাই থাকুক, রবীন্দ্রনাথ বরাবরই এদের গৌণ স্থান দিয়েছেন। বলেছেন-
মরা মন নিয়েও পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীর ঊর্ধ্বশিখরে ওঠা যায়, আমাদের দেশে প্রত্যহ তার পরিচয় পাই। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের দেশে এখনো প্রত্যহ আমরা এর পরিচয় পেয়ে থাকি। এক চিঠিতে তিনি লেখেন-
আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্ররা একটা বড় জিনিস লাভ করছে যেটা ক্লাসের জিনিস নয়-সেটা হচ্ছে বিশ্বের মধ্যে আনন্দ, প্রকৃতির সঙ্গে আত্মীয়তার যোগ। সেটাতে যদিও পরীক্ষায় সহায়তা করে না কিন্তু জীবনকে সার্থক করে। আমাদের ছেলেরা বৃষ্টিতে ছুটে বেড়ায়, জ্যোৎস্না রাত্রিতে আনন্দ ভোগ করে, তারা রৌদ্রকে ডরায় না, তারা গাছে চড়ে বসে পড়া করে-এগুলোকে আমি সামান্য জিনিস মনে করিনে।
না এগুলো আসলেও সামান্য জিনিস ছিল না। ছিল অসামান্য রকম সাধারণ জিনিস, যা তার আগে কেউ চিন্তা করেনি, চিন্তা করলেও বাস্তবরূপ দিতে পারেনি। এখানে শিশুরা সত্যিকার অর্থে শিখছিল। গতানুগতিক পড়াশোনা কিন্তু শান্তিনিকেতনে বাতিল করা হয়নি। পরিবর্তন এসেছিল পদ্ধতিতে। তথ্যসর্বস্ব গর্দভ নয়, সত্যিকারের মানুষ সৃষ্টিই ছিল শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্য। কিছুদিন পরই স্থাপিত হয় ‘শ্রীনিকেতন’ অল্প সংখ্যক ছাত্র নিয়ে, যাদের অধিকাংশই পিতৃমাতৃহীন অথবা যাদের পিতা-মাতা এতই নিঃস্ব ছিল যে, যে কোনো স্কুলে পাঠানো তাদের সাধ্যের অতীত ছিল। তিনি এখানে সৃষ্টি করলেন বৃত্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থার। তবে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আশাহত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৩৯ সালে, মৃত্যুর দুবছর আগে শান্তিনিকেতনের শিক্ষক যিনি এক সময় এরই ছাত্র ছিলেন, সেই তেজেসচন্দ্র সেনকে এক চিঠিতে লেখেন ‘আমি কেবল দুঃখ পাই-প্রত্যহ দেখিতে পাই যেখানে এ আশ্রমের প্রাণ সেখানে সেবা পৌঁছায় না। আশ্রম হয়েছে স্কুল-এই জড়ভার বহন করতে হচ্ছে সহজে নয়, যোগাতে হচ্ছে অনেক বলি।’ এ স্থলে বলা দরকার, ‘আশ্রম’ বলতে তিনি বুঝতেন বিদ্যাচর্চার স্থান নয়, জীবনচর্চার স্থান।
শোষিত জনগণের পাশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দাঁড়িয়েছেন মহাজনদের হাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করার জন্য, কৃষকেরা মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়েছে, বছর বছর প্রতিকূল আবহাওয়ার মুখোমুখি হয়ে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে ভূমিহীন হয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে, তাদের এই ঋণের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি নামমাত্র সুদে টাকা ধারের প্রয়োজন মেটানোর জন্য বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে টাকা ধার করে পতিসর কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। নোবেল পুরস্কারের ১ লাখ ৮ হাজার টাকাও তিনি ওই ব্যাংকে জমা রাখেন কৃষকদের ঋণ পাওয়ার সুবিধার্থে।
