Logo
Logo
×

সারাদেশ

হারিয়ে গেছে ২৭ জাতের ধান, বীজগুলোর ঠাঁই সংরক্ষণাগারে

Icon

এটিএম সামসুজ্জোহা, ঠাকুরগাঁও

প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:৩১ পিএম

হারিয়ে গেছে ২৭ জাতের ধান, বীজগুলোর ঠাঁই সংরক্ষণাগারে

ঠাকুরগাঁও মুক্তি শিশু নিকেতনের শিক্ষিকা আদি ধানের গল্পে শিশুদের মাতিয়ে তুলেছেন। ছবি: যুগান্তর

এক সময় এই অঞ্চলের মাঠজুড়ে যে সোনালী ফসলের ঐতিহ্য বয়ে যেত, সেই ফসলের নামগুলো এখন কেবলই স্মৃতির ফ্রেমে বন্দি। উচ্চ ফলনশীল (উফশী) এবং হাইব্রিড ধানের আগ্রাসী দাপটে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ঠাকুরগাঁওয়ের স্থানীয় ২৭টি আদি জাতের ঐতিহ্যবাহী ধান আজ বিলুপ্তির মুখে। 

মাল সারা, মাগুরশাল, সাপাহার, রাজু ভোগ, কালো নেনিয়া, সাদা নেনিয়া, সিন্দুর কটুয়া, ধোরা ভাদুই, চেঙ্গা, কাকুয়া, পারি যা, কাশিয়া বিন্নি, কল মিতাসহ আরও অনেক জাতের ধান এখন কৃষকের মাঠ থেকে হারিয়ে গেছে। আদি এই বীজগুলো ঠাঁই পেয়েছে মানব কল্যাণ পরিষদ নামে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সংরক্ষণাগারে, যা কালের সাক্ষী হয়ে নিরবে জানান দিচ্ছে এক হারানো ঐতিহ্যের কথা।

সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের বিল পাড়া গ্রামের সত্তোরোর্ধ্ব চাষী আবুল কালাম আজাদ আক্ষেপ করে বলেন, নতুন জাতের ধান চাষ করে ফলন ঠিকই পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু হারিয়ে গেছে ভাতের আসল স্বাদ আর ঘ্রাণ। পুরনো জাতের ধানে যে অন্যরকম সুঘ্রাণ এবং ভাতের স্বাদ ছিল, তা এখনকার ধানে অনুপস্থিত।

তার কথার রেশ ধরে পাশের গ্রামের সিরাজুল ইসলাম যোগ করেন, এখনকার ধানের ভাত খেয়ে পেট ভরে, কিন্তু সেই তৃপ্তিটা আর পাই না। আগের ধানের ভাতে যে মিষ্টি ঘ্রাণ ছিল, তা মুখে লেগে থাকত। ওই ধান দিয়ে তৈরি পিঠাপুলি, পায়েস আর ভাপা পিঠার স্বাদ ছিল একেবারেই অন্যরকম, যা এখন আর মেলে না। 

কৃষকের এই বক্তব্য প্রকারান্তরে প্রমাণ করে, ঐতিহ্যবাহী ধানগুলো কেবল খাদ্যশস্য ছিল না, তা ছিল এ অঞ্চলের খাদ্য সংস্কৃতির ভিত্তি।

স্থানীয়রা জানান, এই অঞ্চলে  একসময় বছরের দুই মৌসুমে এই ২৭ জাতের ধান চাষ হতো। হেমন্ত ঋতুতে কৃষকের ঘরে উঠত নানা রকমারি ধান। বিশেষত, ভাদ্র মাসে উঠা এই ধানই কৃষকদের আশ্বিন-কার্তিকের মঙ্গা মোকাবিলায় সহায়ক ছিল।

বর্তমানে বছরে তিন মৌসুমে ধান চাষ হচ্ছে। আগে কৃষকরা মূলত বৃষ্টির ওপর ভরসা করতেন, কিন্তু খাদ্যশস্যের যোগান বাড়াতে বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবনী জাত নিয়ে আসায় কৃষকরা এখন ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করেই ধান চাষ করছেন। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে চাষাবাদের ধরণ ও কৃষকের জীবনযাত্রা।

বিশিষ্ট শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিদ অধ্যাপক মনতোষ কুমার দে এই বিলুপ্তির ঘটনাকে সংস্কৃতির ক্ষতি হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, এই ধানগুলো কেবল ফসল ছিল না, আমাদের সংস্কৃতির অংশ ছিল। প্রতিটি ধানের নাম, তার বিশেষত্ব, পিঠাপুলি তৈরির পদ্ধতি—এগুলো ছিল আমাদের ঐতিহ্য।

তিনি জোর দিয়ে এই ধানগুলো সংরক্ষণের দাবি জানান।

জাতীয় কৃষক সমিতির স্থানীয় নেতা জুয়েল ইসলাম জোরালো দাবি জানিয়েছেন বিলুপ্তপ্রায় এই ধানগুলো সংরক্ষণের জন্য। তাঁর মতে, এই আদি জাতগুলো কেবল বীজ নয়, এটি আমাদের আদি সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতীক।

বিলুপ্তপ্রায় বীজগুলো সংগ্রহকারী বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাটির প্রকল্প সমন্বয়কারী রাশেদুল আলম লিটন জানান, আমরা আমাদের সাধ্যমতো এই ধানগুলোর বীজ সংগ্রহ করে সংরক্ষণাগারে রেখেছি। এখন প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং বৃহত্তর উদ্যোগের, যাতে এই বীজগুলো আবার মাঠে ফিরিয়ে আনা যায়।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাসিরুল আলম স্বীকার করেন, হাইব্রিড ধানের ফলন বেশি হওয়ায় কৃষকরা সেদিকে ঝুঁকছেন।

তবে তিনি জানান, কৃষি বিভাগ বিলুপ্তপ্রায় জাতগুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে কৃষকদের সচেতন করছে এবং জাতীয় পর্যায়ে বীজ সংরক্ষণের উদ্যোগের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার চেষ্টা করছেন।

স্থানীয় বিএডিসির বীজ প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্রের উপপরিচালক ফারুক হোসেন বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর সঙ্গে শত শত বছর ধরে খাপ খাইয়ে আসা এই আদি জাতগুলোর বীজ সংরক্ষণ করা অপরিহার্য।

কৃষক ও সচেতন মহলের দাবি—সরকারি উদ্যোগে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে বিলুপ্তির পথে থাকা এই ঐতিহ্যবাহী ধানের বীজগুলো ফিরিয়ে এনে কৃষকের মাঠের চাষাবাদ পুনরায় শুরু করা হোক।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম