Logo
Logo
×

সারাদেশ

যে কারণে বাবা-মা ও স্ত্রীকে ‘প্রতিবন্ধী’ বানালেন কৃষক লীগ নেতা

Icon

তানজিমুল হক, রাজশাহী

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৩৪ পিএম

যে কারণে বাবা-মা ও স্ত্রীকে ‘প্রতিবন্ধী’ বানালেন কৃষক লীগ নেতা

ক্ষমতার দাপট আর স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে রাজশাহীর তানোরে কৃষক লীগ নেতা ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আলম তার বাবা-মা এবং স্ত্রীকে প্রতিবন্ধী কার্ড দিয়েছেন। উপজেলার বাধাইড় ইউনিয়নের আট নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জাহাঙ্গীর আলম ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সময় এটি করেছেন। যুবলীগের স্থানীয় শীর্ষ নেতা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান লুৎফর হায়দার রশিদ ময়নার দাপটে বেপরোয়া ছিলেন তিনি। এছাড়া প্রতিবন্ধী কার্ড গ্রহণকারী জাহাঙ্গীরের স্ত্রী পলিয়ারাও একই ইউপির সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সদস্য।

এই দম্পতি শুধু নিজের পরিবারের সদস্য নয়, সুস্থ ও স্বাভাবিক ৩৫ জন নারী-পুরুষকে প্রতিবন্ধী কার্ড প্রদানে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। প্রকৃত দুস্থ এবং অসচ্ছল প্রতিবন্ধীদের বঞ্চিত করে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে হাতিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। এ ঘটনায় আট নম্বর ওয়ার্ডের শিবরামপুর এলাকার বাসিন্দা সাদিউর রহমান ভুয়া প্রতিবন্ধী সনদ বাতিল এবং জড়িত দম্পতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।

সম্প্রতি তিনি তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যেই সমাজসেবা অধিদপ্তর তদন্ত শুরু করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলছেন, ইতোমধ্যে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। তদন্ত শেষে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ওই ইউপি সদস্য দম্পতির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, জাহাঙ্গীর তার পিতা নুরুল ইসলাম, মা জাহানারা বেগম এবং স্ত্রী পলিয়ারাকে দৃষ্টি ও শারীরিক প্রতিবন্ধী সাজিয়ে ভুয়া সনদ তৈরি করেছেন। অথচ এরা তিনজনই শারীরিকভাবে সুস্থ এবং সবল। এছাড়া অভিযোগে এই তিনজনসহ আরও ১৪ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে। অজ্ঞাত হিসাবে রয়েছেন আরও ১০ থেকে ১৫ জন। এরা সবাই জাহাঙ্গীর আলমের আট নম্বর ওয়ার্ডের শিবরামপুর এলাকার বাসিন্দা।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, যাদের প্রতিবন্ধী কার্ড দেওয়া হয়েছে, তারা কেউ শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধী না। ভুয়া তথ্য দিয়ে সমাজসেবা অফিস থেকে প্রতিবন্ধী কার্ড নিয়েছেন। এরপর তারা সরকার প্রদত্ত প্রতিবন্ধী ভাতা এবং সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং প্রতারণামূলক। আর এ ঘটনার সঙ্গে আট নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জাহাঙ্গীর আলম এবং তার স্ত্রী (৭, ৮ ও ৯) নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী সদস্য পলিয়ারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এই অনৈতিক কাজের জন্য এ দম্পতি প্রত্যেকের কাছ থেকে সাত থেকে নয় হাজার টাকা গ্রহণ করেছেন।

এদিকে ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আলমকে শিবরামপুরের সুশীল নামে শারীরিক এক প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেওয়ার জন্য চার হাজার টাকা দেন। তবে তাকে কার্ড দেননি জাহাঙ্গীর। এ ধরনের প্রতারণার একটি ভিডিও যুগান্তরের হাতে এসেছে। ভিডিওতে ওই আদিবাসী প্রতিবন্ধী তার সঙ্গে প্রতারণার বর্ণনা দিয়েছেন।

অভিযোগকারী সাদিউর রহমান বলেন, ‘ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর বাধাইড় ইউনিয়ন কৃষক লীগের নেতা। তিনি তানোর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি এবং উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান লুৎফর হায়দার রশিদ ময়নার দাপটে বেপরোয়া ছিলেন। আওয়ামী লীগ এবং যুবলীগ নেতাদের সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মসূচির অসংখ্য ছবি এবং ভিডিও রয়েছে। ময়নার দাপটেই তিনি স্ত্রী এবং বাবা-মাকে অনিয়মের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী কার্ড করে দিয়েছেন। সচ্ছল ব্যক্তিদের কাছ থেকেও টাকা নিয়ে কার্ড দিয়ে দরিদ্র অসচ্ছল প্রতিবন্ধীদের বঞ্চিত করেছেন। এছাড়া তার স্ত্রী পলিয়ারা সাত নম্বর ওয়ার্ডের জুমারপাড়া এলাকার একটি পরিবারের চার সদস্যকে প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেওয়ার নামে ৪০ হাজার টাকা নিয়ে প্রতারণা করেছেন।’

অভিযোগ সম্পর্কে ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমার মা কয়েকদিন থেকে খুবই অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আমি কথা বলতে পারব না। কথা বলতে হলে সাক্ষাতে বলব। আর তখনই অভিযোগ সম্পর্কে কথা বলতে পারব।’ তবে স্থানীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, অভিযোগের ব্যাপারে গণমাধ্যমকর্মী বা সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে ফোন দেওয়া হলে তিনি বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কথা বলেন না। এছাড়া তার স্ত্রী পলিয়ারাকে ফোন দেওয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

এদিকে ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর এবং তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে তানোর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. হোসেন খান বলেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছি। অভিযোগে যে ১৭ ব্যক্তির নাম উল্লেখ রয়েছে, এর মধ্যে সাতজনের কার্ড আছে। এদের মধ্যে জাহাঙ্গীরের স্ত্রী এবং বাবা-মা আছেন। বাকি ১০ জনের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে সাতজনের ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কয়েকদিন আগেই তাদের নোটিশ করেছি। তাদের বক্তব্য নেওয়া হবে। এরপর তারা প্রকৃত প্রতিবন্ধী কী না-সেটি মেডিকেল টেস্টের মাধ্যমে যাচাই করা হবে। ইউপি সদস্য দম্পতির বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ ব্যাপারে বক্তব্যের জন্য তানোরের ইউএনও নাঈমা খানকে ফোন দেওয়া হয়। তবে তিনি না ধরায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম