Logo
Logo
×

সারাদেশ

পারিবারিক বিরোধে খুন

টাকার বিনিময়ে আপস প্রস্তাবের অভিযোগ চাঁদের বিরুদ্ধে

Icon

রাজশাহী ব্যুরো

প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:১১ পিএম

টাকার বিনিময়ে আপস প্রস্তাবের অভিযোগ চাঁদের বিরুদ্ধে

রাজশাহীর চারঘাটে ২০০৯ সালে পারিবারিক বিরোধে একটি খুনের ঘটনায় করা মামলা রাজনৈতিক হিসেবে প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন আসামিরা। আর এতে জোর সুপারিশ করেছেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদ। তিনি মোটা টাকার বিনিময়ে এ সুপারিশ করেছেন বলে অভিযোগ মামলার বাদীপক্ষের।

এ ঘটনা নিয়ে সোমবার দুপুরে রাজশাহী সিটি প্রেস ক্লাবে তারা সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সেখানে তারা আসামিদের মৃত্যুদণ্ড দাবি করেছেন।

মামলার এজাহারের বর্ণনা অনুযায়ী- ২০০৯ সালের ৬ অক্টোবর চারঘাট উপজেলার রায়পুর গ্রামের বাসিন্দা রঞ্জু আহমেদ মোটরসাইকেল নিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন। পথে প্রতিপক্ষরা তার গতিরোধ করে মারধর শুরু করেন। এ সময় তিনি চিৎকার শুরু করলে তার বাবা শামসুল ইসলাম, ভাই মনিরুল ইসলাম ও মো. মন্টু তাকে বাঁচাতে যান। এ সময় সবাইকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। হাসপাতালে নেওয়ার সময় মন্টু মারা যান।

এ ঘটনায় সেদিন রঞ্জু আহমেদ বাদী হয়ে চারঘাট থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামিরা হলেন- রায়পুর গ্রামের এমদাদুল হক ওরফে আবু তালেব, জুমারত আলী, ওহাব, নজরুল, বজলু, ইসলাম, খালেক, কালাম, ইনছার, রফিকুল, শাজাহান, আনারুল, এনামুল, সাজদার রহমান, হোসেন, আবু তাহের, হাবিবুর রহমান, কালাম, রবিউল, রেজাউল, জিনারুল ও সাদরুল। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে। মামলাটি এখন রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত-৩ এ বিচারাধীন। ইতোমধ্যে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। যুক্তিতর্কের জন্য আগামী ১৪ অক্টোবর দিন ধার্য রয়েছে।

এরই মধ্যে গত ৩০ জুন মামলাটি রাজনৈতিক উল্লেখ করে প্রত্যাহারের জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেছেন আসামি ইমদাদুল হক ওরফে আবু তালেব, মো. রবিউল, আবু তাহের, রেজাউল হক, বজলু, মো. ওহাব, নজরুল ইসলাম ও আবদুল খালেক।

আসামিদের প্রত্যেকের আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী আবু সাঈদ চাঁদ লিখেছেন ‘জোর সুপারিশ করছি।’

জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে মতামত চেয়ে আবেদনগুলো গত ২৯ জুলাই জেলা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর কাছে পাঠানো হয়েছে। এরই মধ্যে বাদীপক্ষ বিষয়টি জানতে পেরেছেন।

আসামিদের আবেদনে বলা হয়েছে- ‘তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী রাজনৈতিক শত্রুতাবশত আসামি করেছে।’

তবে মামলার বাদী রঞ্জু আহমেদ নিজেও বিএনপির কর্মী। তার পুরো পরিবারই বিএনপির সমর্থক। এ ব্যাপারে ভায়ালক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন বিএনপি তাদের একটি প্রত্যয়নপত্রও দিয়েছে। তাছাড়া বাদীপক্ষের আইনজীবী হিসেবে ২০০৯ সাল থেকেই হত্যা মামলাটি পরিচালনা করে এসেছেন রাজশাহী মহানগর বিএনপির সদ্য সাবেক আহ্বায়ক এরশাদ আলী ঈশা। অথচ জেলার আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদ এ মামলার ৮ আসামিকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য তাদের আবেদনে সুপারিশ করেছেন।

বিষয়টি জানতে পেরে মামলার বাদী রঞ্জু আহমেদ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক আফিয়া আখতারের কাছে লিখিতভাবে আপত্তি জানিয়েছেন। গত ২৯ সেপ্টেম্বর তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের আইন-১ শাখায়ও লিখিতভাবে আপত্তি জানিয়েছেন। তার আবেদনে সুপারিশ করেছেন রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক এরশাদ আলী ঈশা।

আর আবু সাঈদ চাঁদ যে মামলা প্রত্যাহারের আবেদনে সুপারিশ করেছেন, সেই বিষয়ে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর কাছেও লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন রঞ্জু।

অভিযোগে তিনি লেখেন- পারিবারিক মামলাটি টাকার বিনিময়ে তুলে নেওয়ার জন্য রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাইদ চাঁদ ও তার ক্যাডার বাহিনী আমাকে চাপ দিয়েছে। ভয়ভীতি দেখিয়েছে। আমি তাতে রাজি না হওয়ায় আবু সাইদ চাঁদ টাকার বিনিময়ে রাজনৈতিক মামলা বলে চালিয়ে দেওয়ার জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর সুপারিশ করেন।

সংবাদ সম্মেলনে বাদী রঞ্জু আহমেদ জানান, তার দাদা মৃত রহমত মণ্ডলের নামে দলিল থাকা ২ বিঘা ৪ কাঠা জমি দখলে নিয়ে বাড়ি করে আছেন গ্রামপ্রধান জুমারত সরকার। এই নিয়ে তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধ। সেই বিরোধের জের ধরে তার ওপর হামলা হয়। তাকে বাঁচাতে গিয়ে তার বাবা শামসুল হক ও ভাই মনিরুল ইসলাম ও মন্টুও আহত হন। হামলার ১০ মিনিটের মধ্যেই তার ভাই মন্টু মারা যান। আর ওই হামলার পর থেকে চারবছর বিছানাগত ছিলেন শামসুল হক। পরে তিনিও মারা যান। এটি কোনোভাবেই রাজনৈতিক মামলা নয়।

মামলার এজাহার, পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্র, সাক্ষীদের সাক্ষ্য, তাদের জবানবন্দি ও জেরার কোনো জায়গায় আসেনি যে এটি আওয়ামী লীগ-বিএনপি সংঘর্ষ কিংবা রাজনৈতিক ঘটনার জেরে হত্যাকাণ্ড।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আসামিরা সুবিধাভোগী। আগে তারা আওয়ামী লীগেরই রাজনীতি করতেন। তাই ভায়ালক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের পলাতক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মজিদ তাদের হয়ে ৯ বিঘা জমি নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন আপস করার জন্য; কিন্তু আমি রাজি হইনি। গত বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চেয়ারম্যান মজিদ আত্মগোপন করলে আসামিরা ভায়ালক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ছয় নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি আব্দুস সালামের মাধ্যমে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদের কাছে যান। এরপর চাঁদ নিজে আমাদের বাড়ি আসেন এবং ৫০ লাখ টাকার বিনিময়ে মামলাটি আপস করে নিতে বলেন। আমি রাজি না হলে চাঁদের সমর্থকরা ভয়-ভীতি দেখান। আবু সাঈদ চাঁদ মোটা টাকার বিনিময়ে ওই ৮ আসামির সঙ্গে চুক্তি করেছেন এবং তিনি আমার দায়ের করা হত্যা মামলাটিকে রাজনৈতিক মামলা হিসেবে প্রত্যাহার করানোর চেষ্টা করছেন। এ মামলাটি প্রত্যাহার হলে আমি আমার ভাই হত্যার বিচার পাব না।

তিনি বলেন, আমি নিজে বিএনপি করার কারণে দীর্ঘ ১৫ বছর জেল-জুলুম ও হুলিয়ার মধ্যে জীবন পার করেছি। ৫ আগস্টের পর এখনও আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আসামিরা হুমকি দিয়েছে যে, মামলার রায় হলে তাদের ফাঁসি হবে, তাই তারা আরও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েই ফাঁসির দড়ি পরবেন। এ অবস্থায় আমি ঢাকায় পালিয়ে থাকছি। এলাকায় থাকতে পারছি না।

সংবাদ সম্মেলনে রঞ্জু আহমেদ এবং নিহত মন্টুর স্ত্রী লাভলী বেগমকে বারবার চোখের পানি মুছতে দেখা যায়। এ সময় তার সঙ্গে নিহত মন্টুর ছেলে সেলিম রেজা ও মেয়ে শিরিনা খাতুনও উপস্থিত ছিলেন।

রঞ্জু বলেন, রায়ের আগমুহূর্তে মামলাটি প্রত্যাহার না করা কিংবা আসামিদের অব্যাহতি না দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি। এ ব্যাপারে আমি বিএনপির হাইকমান্ড, প্রধান উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা, জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং জেলা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

যোগাযোগ করা হলে মামলার প্রধান আসামি ইমদাদুল হক ওরফে আবু তালেব বলেন, আমরা বিএনপি করি। তাই মামলায় আসামি করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদও সেই সময় বাদী রঞ্জুকে আপস করার কথা বলেছিল কিন্তু সে পাত্তাই দেয়নি। এখন চাঁদ চেয়ারম্যান (সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবু সাঈদ চাঁদ) সুপারিশ করেছেন।

পারিবারিক বিরোধে খুনের মামলা প্রত্যাহারে সুপারিশের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি নেতা আবু সাঈদ চাঁদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার কোনো বক্তব্য নাই, আমার কোনো মন্তব্য নাই। এটা পারিবারিক বিরোধে খুন নাকি রাজনৈতিক খুন সেটা এলাকায় গিয়ে খোঁজ নেন।’

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম