শিকলই নিত্য সঙ্গী কলেজ শিক্ষার্থী আলমগীরের
মো. হাবিবুর রহমান হাবিব, সাটুরিয়া (মানিকগঞ্জ)
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৫২ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত শেখরীনগর গ্রামের এক কোণে ভাঙা টিনের ঘরের বারান্দায় লেপ-কাঁথার স্তূপের ওপর বসে আছে ২৪ বছরের তরুণ আলমগীর হোসেন। দুই পা শিকলে বাঁধা, পাশে মরিচা ধরা তালা— এই শিকলই তার দিনের সঙ্গী, রাতের পাহারাদার। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, এমনকি প্রস্রাব-পায়খানাও হয় সেই এক জায়গায়।
দীর্ঘ দুই বছর ধরে এভাবেই শিকলে বাঁধা অবস্থায় কাটছে তার অসহায় জীবন। শীতের রাত, ঝড়-বৃষ্টি বা গ্রীষ্মের দহন—কোনোটাই তার জীবনের অবস্থার পরিবর্তন আনতে পারেনি। আশপাশের মানুষের কাছে এটি এখন এক নিত্যনৈমিত্তিক দৃশ্য—যন্ত্রণার এই জীবন যেন হয়ে গেছে সবার কাছে স্বাভাবিক।
আলমগীর শেখরীনগর গ্রামের মৃত আওলাদ হোসেনের বড় ছেলে। এক সময় তিনি ছিল পড়াশোনায় মেধাবী ছাত্র। স্থানীয় একটি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশও করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর আচরণে পরিবর্তন দেখা দেয়, ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় তার মানসিক ভারসাম্য।
পরিবার জানায়, আলমগীর হঠাৎ রাগারাগি করতে শুরু করে, কখনো কখনো লোকজনকে মারতে উদ্যত হতো। নিরাপত্তার স্বার্থে শেষ পর্যন্ত পরিবারের লোকজন বাধ্য হয়ে তাকে শিকলে বেঁধে রাখে।
গ্রামের বাসিন্দা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, আলমগীর আগে একদম ভালো ছিল। লেখাপড়ায়ও মনোযোগী ছিল। হঠাৎ করে মাথায় সমস্যা দেখা দেয়। বাইরে গেলে ঝামেলা করত, তাই পরিবার তাকে শিকলে বেঁধে রাখছে।
প্রতিবেশী সাহেরা খাতুন জানান, আলমগীরের বাবা মারা গেছে অনেক দিন হলো। পরিবারে তেমন সামর্থ্য নেই। তার ভাই দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালায়, চিকিৎসার খরচ বহন করা সম্ভব না।
আলমগীরের ছোট ভাই আব্দুল আউয়াল বলেন, ভাইটা এসএসসি পাস করেছে। হঠাৎ মানসিক সমস্যা দেখা দেওয়ার পর আমরা কী করব বুঝে উঠতে পারিনি। প্রায় দুই বছর ধরে শিকলে বেঁধে রাখতে হচ্ছে।
অসহায় মা রুবিয়া খাতুন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমাদের খাওয়ারই কষ্ট, চিকিৎসা করাব কী দিয়ে? শিকল বেঁধে আলাদা ঘরে রাখি। ও শিকল পরেই খায়, ঘুমায়, গোসল করে, টয়লেট করে। আল্লাহ যদি কেউ দয়া করে সাহায্য করতেন, ছেলেটাকে হয়তো আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো যেত।
শিকলে বাঁধা অবস্থায় কথা বলার সময় আলমগীর জানান, আমাকে দিন-রাত শিকলে বেঁধে রাখে। তিনটা তালা লাগে পায়ে। আমারও ইচ্ছা করে ভালো হয়ে আবার বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে, বাইরে যেতে।
সাটুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৫নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. আব্দুল লতিফ বলেন, পরিবারটি অত্যন্ত দরিদ্র। বাবার মৃত্যুর পর ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েছে তারা। আমরা চেষ্টা করেছি আলমগীরের জন্য প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করতে, কিন্তু কাগজপত্র ঠিকঠাক না থাকায় তা সম্ভব হয়নি।
দীর্ঘ দুই বছর ধরে শিকলে বন্দি আলমগীরের জীবন এখন এক নিঃশব্দ আর্তনাদ। সমাজের অনেকে জানেন তার কষ্টের কথা, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেননি। দরিদ্র এই পরিবারটির পক্ষে চিকিৎসার ব্যয় বহন করা অসম্ভব।
অসহায় মা এখন মানবিক সহায়তার আবেদন জানিয়েছেন— কেউ যদি ছেলের চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়, তবে হয়তো আমার আলমগীর আবার হাসতে পারবে।
