Logo
Logo
×

সারাদেশ

মানত পূরণে খোদার পাথর ভিটায় দুধ ঢাললেন ভক্তরা

Icon

নাজমুল হুদা নাসিম, বগুড়া

প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৪৭ পিএম

মানত পূরণে খোদার পাথর ভিটায় দুধ ঢাললেন ভক্তরা

মানত পূরণে খোদার পাথর ভিটায় দুধ ঢাললেন ভক্তরা

বগুড়ার শিবগঞ্জের ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়ে বৌদ্ধ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া খোদার পাথর ভিটা বা দুধ পাথরে অনেক ভক্ত দিনভর দুধ ঢালেন। কেউ কেউ সিঁদুর দিয়ে প্রণাম করেন। মনের আশা পূরণ হবে- এ বিশ্বাস ও আশায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মানুষ পাথরে দুধ ঢালেন।

তবে পাথরে দুধ ঢালার পর কারো মানত পূরণ হয়েছে কিনা সেই সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে পারে না। প্রত্নতত্ত্ববিদরা বলেন, এটি বৌদ্ধ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।

খোঁজ নিয়ে ও এলাকার প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন নগরী পুন্ড্রনগরখ্যাত বগুড়ার শিবগঞ্জের মহাস্থানগড়ের বিশাল এলাকাজুড়ে ইতিহাসের শত শত উপকরণ ও নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মহাস্থানগড়ের যে কোনো প্রান্তে গেলেই হাজার বছরের ইতিহাস জানা যাবে। তেমনি একটি প্রত্ন নিদর্শন খোদার পাথর ভিটা।

স্থানীয়রা এটাকে ‘দুধ পাথর’ বলে থাকেন। মহাস্থানগড়ের ভিতরে হযরত শাহ সুলতান বলখী মাহীসাওয়ার (রহ.) মাজারের উত্তর-পশ্চিম দিকে এ প্রত্ন স্থানটির অবস্থান। খোদার পাথর ভিটা মূলত বৌদ্ধ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। তবে মজার বিষয় হলো প্রত্ন স্থানটির ‘খোদার পাথর ভিটা’ নামকরণ হয়েছে এখানে অবস্থিত একটি লম্বা পাথর খণ্ডকে ঘিরে। পুন্ড্রনগরে অবস্থিত একটি টিলা বা ঢিবি। ঢিবিটির উপরিভাগে প্রাপ্ত চারকোণা গ্রানাইট পাথরটিকে স্থানীয়রা এমন নামকরণ করেছেন।

এ পাথর খণ্ডটিতে রয়েছে দরজার হুড়কো লাগাবার দুটি ছিদ্র, উপরের দিকে ফোকর ও ফুলের নকশা। স্থানীয়দের কেউ কেউ এখানে নগ্ন পায়ে পাথরের এ খণ্ডটিতে ভক্তি নিবেদন করেন।

ধারণা করা হয়, পাথরটিতে নকশা খোদাই করা আছে। সেজন্য একে ‘খোদাই পাথর’ বলা হতো, যা কালক্রমে ‘খোদার পাথরে’ পরিণত হয়েছে।

এই ভিটার ধ্বংসাবশেষ পাল শাসনামলের প্রথম দিকের বলে জানা গেছে। ১৯৭০ সালে এ ঢিবি বা ভিটাতে খনন করে একটি মন্দির এবং তার সঙ্গে ছোটখাটো কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়।

মন্দিরটি পূর্বাভিমুখী একটি আয়তাকার বৌদ্ধ মন্দির। এতে রয়েছে, পাথরে বাঁধানো মেঝে এবং ভিত-দেয়াল। ভিতের উপর স্থাপিত দেয়াল ছিল কাদামাটিতে গাঁথা ইটের তৈরি। দরজার চৌকাঠের বাজু, সরদল ও দরজার উপরের দিকের অলংকৃত অংশ সম্ভবত পাথরে নির্মিত হয়েছিল। এটি দীর্ঘাকার ও চৌকাণাকৃতির মসৃণ পাথর যা সাধারণত প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না।

ধারণা করা হয়, পুন্ড্রনগরের রাজা পরশুরাম এটি সংগ্রহ করে মসৃণ করে পাঠা বা অন্য কোনো প্রাণী বলি দেওয়ার কাজে ব্যবহার করতেন।

প্রাচীন মন্দিরটি কালের গর্ভে বিলীন হয়েছে। খোদার পাথরটি সবেধন নীলমনির মতো একটু আধটু ভক্তি শ্রদ্ধা আদায় করছে। হিন্দু ও আশপাশের মুসলিম সম্প্রদায়ের নারী ও পুরুষরা বিভিন্ন সময় মানত করে পাথরটিতে দুধ ঢালেন ও তেল-সিঁদুর দেন। অনেকে আবার বাড়ির গরুর প্রথম দুধ এনে পাথরে ঢেলে দেন নৈবেদ্য হিসেবে। অনেকে রোগমুক্তি কামনা করেন এখানে।

অনেক সময় হিন্দু ভক্তরা পাথরটিকে ব্রহ্মার বাহন বলে থাকেন। তবে কেন এমনটি বলেন তা জানা যায়নি। পাথরের উপরে একটি প্রাচীন বটগাছ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

হযরত শাহ্ সুফি বলখী মাহীসাওয়ারের (রহ.) ওফাত দিবস বা বিভিন্ন সময় গাছের তলায় মাঝে মাঝে বাউল সন্ন্যাসীর আড্ডা বসে, একতারা বাজিয়ে গান করেন।

প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ বগুড়ার ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়ে বেড়াতে আসেন। তারা হযরত শাহ সুফি বলখী মাহীসাওয়ারের (রহ.) মাজার, খোদার পাথর ভিটা, মহাস্থান জাদুঘর, গোবিন্দ ভিটাসহ বিভিন্ন প্রত্ন নিদর্শন পরিদর্শন করেন। অনেকে সঙ্গে করে আনা দুধ পাথরে ঢেলে দেন।

নাটোরের সিংড়া উপজেলার দমদমা গ্রামের সিরাজুল ইসলাম ও মিনারা খাতুন দম্পতি জানান, তাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় এক যুগ আগে। আজ পর্যন্ত তাদের সংসারে কোনো সন্তান আসেনি। মানুষের কাছে শুনেছেন মহাস্থানগড়ের খোদার পাথর ভিটায় দুধ ঢাললে মনের ইচ্ছা পূরণ হয়। এ বিশ্বাস থেকে তারা সঙ্গে আনা নতুন গাভীর দুই লিটার দুধ পাথরে ঢেলেছেন।

বগুড়ার নন্দীগ্রামের সনাতন ধর্মের সুকান্ত সাহা জানান, তার একটি সন্তান বাকপ্রতিবন্ধী। ছেলে কথা বলতে পারবে- এ বিশ্বাসে খোদার পাথরে দুধ ঢালতে এসেছেন।

এ সময় কয়েকজন হিন্দু ধর্মের নারীকে খোদার পাথরে সিঁদুর ও জবা ফুল দিয়ে প্রণাম করতে দেখা যায়।

বাসন্তী রানী নামে এক নারী বলেন, বিশ্বাসে স্বর্গ মেলে, তর্কে বহুদূর। তার বিশ্বাস পাথরটি অলৌকিক। এর কোনো না কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে। এ কারণে তার মতো অনেক ভক্ত মানত নিয়ে এখানে আসেন; ভক্তি নিবেদন করেন।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের সাবেক পরিচালক ড. নাহিদ সুলতানা জানান, খোদার পাথর ভিটা একটি প্রত্ন নিদর্শন। এখানে খনন করে মন্দিরের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেখানেই এ পাথরটি পাওয়া যায়। মন্দিরটি অষ্টম শতকে (পাল আমলে) নির্মিত বৌদ্ধ মন্দির।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম