Logo
Logo
×

সারাদেশ

টুল-পিঁড়িতে চুল কেটে ৫০ বছর পার করলেন আহম্মদ আলী

Icon

মো. আ. রহমান শিপন, সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা)

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১০:০৮ পিএম

টুল-পিঁড়িতে চুল কেটে ৫০ বছর পার করলেন আহম্মদ আলী

একটা সময় গ্রামীণ হাট-বাজারে টুল-পিঁড়ি পেতে চুল-দাড়ি কাটানোর দৃশ্য ছিল অতি পরিচিত। সারি সারি করে বসতেন ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দররা। সেই দৃশ্য এখন যেন হারাতে বসেছে।

বর্তমানে শহর-বন্দর ও গ্রামের হাট বাজারগুলোতে রয়েছে আধুনিক সুবিধা সংবলিত সেলুন। রয়েছে পুরুষদের জন্য পার্লারের ব্যবস্থা। চুল ও দাড়ি কাটার জন্য রয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও মেশিন। বর্তমানে তাই আগের মতো তেমন কেউ পিঁড়িতে বসে চুল ও দাড়ি কাটাতে চান না।

গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার আহম্মদ আলী (৬৩)। ৫০ বছর ধরে এখনো এ পেশায় রয়ে গেছেন। তিনি উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের জামালহাট গ্রামের বাসিন্দা।

সরেজমিন দেখা যায়, সুন্দরগঞ্জ উপজেলাধীন বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী হাসানগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের পাশে খোলা জায়গায় বসে চুল ও দাড়ি কাটার কাজ করছেন নরসুন্দর আহম্মদ আলী। কাস্টমারকে পিঁড়ি বা টুলে বসিয়ে চুল ও দাড়ি কাটছেন।

স্থানীয় প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই দশক আগেও দেশের বিভিন্ন হাট-বাজার ও প্রত্যন্ত গ্রামে আহম্মদ আলীর মতো ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরদের চুল-দাড়ি কাটানোর দৃশ্য চোখে পড়তো। মূলত হাট-বাজারে ইটের ওপর অথবা পিঁড়িতে বসিয়ে কিংবা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা মানুষের চুল-দাড়ি কেটে দিতেন। বর্তমানে এমন নরসুন্দরদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। হঠাৎ প্রত্যন্ত এলাকার কোনো হাটে দুই-একজনের দেখা মেলে। তাদের নির্দিষ্ট কোনো বসার জায়গা নেই। যেখানে সুযোগ পান সেখানেই চুল-দাড়ি কাটার সরঞ্জাম ও বসার ইট-পিঁড়ি নিয়ে বসে পড়েন।

চুল কাটাতে আসা রামদেব গ্রামের আইয়ুব আলী নামের এক ব্যক্তি বলেন, আহম্মদ আলী ভাই ফুটপাতের নাপিত হলেও তার কাজ খুব ভালো। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে হাটে এসে তার কাছে চুল কাটাতাম। এখন আমি ছেলেকে এনে চুল কাটাই।

আহম্মদ আলীর নিয়মিত কাস্টমার দেওডোবা গ্রামের শরীফ উদ্দিন বলেন, কামলার কাজ করি। সেলুনে চুল ও দাড়ি কাটাতে গেলে কমপক্ষে ৮০ থেকে ১০০ টাকা লাগে; কিন্তু ইনার কাছে মাত্র ৩০ টাকাতেই চুল ও দাড়ি কাটানো যায়। সেলুনের চাইতে ইনার কাজ কোনো অংশে খারাপ না।

নরসুন্দর আহম্মদ আলীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বয়স যখন ১৪-১৫ তখন থেকেই গ্রাম হাট-বাজারে এভাবেই দাড়ি ও চুল কাটছেন তিনি। ফলগাছা, জামালহাট, দেওডোবা, তেলানীপাড়া, রামদেব, মনিরাম, বলদীপাড়া, হাতীবান্ধা এলাকা থেকে বাজারে আসা মানুষ তার কাস্টমার। চুল ও দাড়ি কেটে সংসার চলে তার। চুল কাটতে ২০-৩০ টাকা এবং শেভ বা দাঁড়ি ঠিক করতে ১৫-২০ টাকা নেন।

আক্ষেপ করে নরসুন্দর আহম্মদ আলী যুগান্তরকে বলেন, এক সময় আমার বাবা-চাচা জ্যাঠা হাট-বাজারে গ্রামে গ্রামে নাপিতের কাজ করতেন। তারা এখন আর বেঁচে নেই। আমার ছেলে ভাতিজারা নাপিতের কাজ করে তারা আধুনিক সেলুনে। আমি এখনো টুল-পিঁড়িতে বসেই চুল দাড়ি কাটি। আগের মতো গ্রামে যেতে পারি না। হাট-বাজারে যে আয় হয় তাতে সংসার ঠিকমতো চলে না।

স্থানীয় আব্দুল আজিজ বলেন, ছোটবেলায় বাবা বাজারে চুল কাটাতে নিয়ে আসতেন। টুলের ওপর বসে হাঁটুর ওপর মাথা রেখে চুল কাটাতে গিয়ে অনেক সময় ঘুমিয়ে পড়তাম। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এগুলো এখন রূপকথার মতো মনে হবে।

বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জব্বার বলেন, সভ্যতার বিবর্তনে মানবজীবনের গতিধারায় পরিবর্তন ও নতুনত্বের ছোঁয়াই জেন্টস পারলারগুলোতে বাহারি রঙের হেয়ার স্টাইলের ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে হাট-বাজারে পিঁড়িতে বসা সেলুনগুলা। নরসুন্দরদের স্থান দখল করে নিয়েছে নামিদামি সেলুন। আশি নব্বইয়ের দশকে এভাবে পিঁড়িতে বসিয়ে গ্রামবাংলার মানুষের চুল-দাড়ি কাটার সেই পরিচিত দৃশ্য এখন আর সচরাচর চোখে পড়ে না।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম