Logo
Logo
×

সারাদেশ

রাজশাহীতে সঞ্চয়ের নামে প্রতারণা

আমানতকারীদের ৯৫ কোটি টাকা নিয়ে উধাও ১৮ সমিতি

Icon

রাজশাহী ব্যুরো

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৫, ১০:০১ পিএম

আমানতকারীদের ৯৫ কোটি টাকা নিয়ে উধাও ১৮ সমিতি

রাজশাহীর বাগমারায় গত কয়েক বছরে সমবায় বিভাগের নিবন্ধন নিয়ে বিভিন্ন নামে ব্যাঙের ছাতার মতো শত শত সমবায় সমিতি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে অফিস খুলে বসে। বিভিন্ন বাহারি নাম দিয়ে সমিতিগুলো গ্রামীণ জীবন-মান উন্নয়নের কথা বলে ও অতি মুনাফার লোভ দেখিয়ে সঞ্চয় আমানত সংগ্রহ করে আসছিল।

উপজেলার ৬০টির বেশি গ্রামে এসব সমিতি শুধু সঞ্চয় আমানত নিয়ে কিছু কিছু করে মুনাফা দিয়ে এসেছে আস্থা অর্জনের জন্য। এসব সমিতিতে টাকা জমা রেখে সর্বস্বান্ত হয়েছেন কয়েক হাজার আমানতকারী।

ভুক্তভোগী আমানতকারীরা বলছেন, তারা আগে বুঝতে পারেননি যে এসব সমিতির অন্যতম লক্ষ্যই ছিল বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে সঞ্চয় আমানত নিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা। এমনই বড় আর্থিক প্রতারণার শিকার হয়েছেন স্থানীয় হাজার হাজার মানুষ। সমিতিগুলোর মধ্যে ১৮টি সম্প্রতি কার্যক্রম গুটিয়ে উধাও হয়ে যাওয়ার পর আমানতকারীরা বুঝতে পারেন তারা প্রতারিত হয়েছেন। প্রতিকার পেতে অভিযোগ দিতে ছুটে যাচ্ছেন উপজেলা নির্বাহী কার্যালয়ে ও থানায়।

এদিকে বাগমারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহবুবুল ইসলাম জানান,  প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রতারিত ২ হাজার ৩০০ জন আমানতকারী তার দপ্তরে ও থানায় অভিযোগ জমা করেছেন। তাদের আমরা প্রতারণার মামলা করার পরামর্শ দিয়েছি।

তিনি বলেন, আমরা জানতে পেরেছি ১৮টি সমবায় সমিতি গ্রাহকদের প্রায় ৯৫ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। এটা অনেক বড় আর্থিক প্রতারণা। প্রতারিতরা অধিকাংশই নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ। অনেকেই নিঃস্ব হয়ে গেছেন। সমিতিগুলো বেআইনিভাবে সঞ্চয় আমানত সংগ্রহ করেছে যা তারা করতে পারে না।

বাগমারা উপজেলার একডালা গ্রামের খোদেজা বেগম (৫৬) হাঁস মুরগি পেলে জীবনের শেষ সম্বল প্রায় চার লাখ টাকা জমিয়েছিলেন। জীবনের শেষ স্বপ্ন ছিল একটা পাকা ঘর বানিয়ে বাকি জীবনটা সেখানে কাটিয়ে দেওয়া; কিন্তু এক সমিতির কর্মী তাকে বলেন, মাত্র চার লাখে পাকা বাড়ি হবে না। আপনি আমাদের সমিতিতে টাকা জমা করেন। চার বছর পরেই দ্বিগুণ হবে। খোদেজা বেগম সমিতিতে টাকা জমা করেন। গত মাসে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেন সমিতির অফিস উধাও। সমিতির লোকেরা কেউ নেই।

বাগমারা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তৌহিদুল ইসলাম জানান, সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, সমিতিগুলোতে সঞ্চয় আমানত রেখে ২ হাজার ৩০০ জন মানুষ প্রতারিত হয়েছেন। সঞ্চয় গ্রহণকারী ১৮টি সমবায় সমিতি অফিস গুটিয়ে পালিয়েছে। নিয়ে গেছে প্রায় ৯৫ কোটি টাকা। তবে প্রতারিত মানুষের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। সব হিসাব পেলে দেখা যাবে টাকার অংকটাও আরও বেশি হবে বলে অনেকেই তাকে জানিয়েছেন।

অভিযোগ সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উধাও সমিতিগুলোর একটি ম্যাসেঞ্জার সঞ্চয় সমিতি। এই সমিতিতে ৩৩ লাখ টাকা আমানত রেখেছিলেন শাহানাজ বেগম নামের এক নারী ও তার পরিবারের লোকেরা। টাকা জমার পর কিছুদিন কিছু কিছু করে মুনাফা পেয়েছিলেন; কিন্তু সম্প্রতি ম্যাসেঞ্জার সমিতির লোকেরা অফিস গুটিয়ে পালিয়েছেন। গত মঙ্গলবার থানায় অভিযোগ দিয়েছেন শাহানাজ বেগম। পুলিশ বলেছে তারা উদ্যোক্তাদের খুঁজছেন।

প্রতারিত আমানতকারীরা আরও জানান, এসব সমবায় সমিতির উদ্যোক্তা ও কর্মীরা টাকা নেওয়ার সময় লোভনীয় মুনাফার কথা বলেছেন। সঞ্চয় আমানতের ওপর বিভিন্ন মেয়াদি স্কিম দেখিয়ে বছরে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা মুনাফা দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। বেশি মুনাফার লোভে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এসব সমিতিতে অনেকেই ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত আমানত জমা দিয়েছিলেন। এসব সমিতির কোনো কোনোটি নিম্নে ৩ থেকে ঊর্ধ্বে ৩৫ কোটি টাকা পর্যন্ত গ্রাহকের সঞ্চয় আমানত নিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন।

আলোর বাংলা গ্রাম উন্নয়ন সমিতির গ্রাহক কমিটির সভাপতি মঞ্জুর হোসেন জানান, এই সমিতির কর্মকর্তা ও কর্মীরা ৪৫০ জন আমানতকারীর ২৩ কোটি টাকা নিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন। তাদের  অনেকের ফোন নম্বর বন্ধ রয়েছে। ফলে গ্রাহকরা কোনোভাবেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না।

অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা বীরেন সরকার অভিযোগে জানান, তিনি মোহনা সমবায় সমিতিতে সাড়ে ৯ লাখ টাকা রেখেছিলেন। তার সঙ্গে আরও ১৯ জন গ্রাহক প্রতারিত হয়েছেন। তারা সবাই সমিতির কর্মকর্তাদের নামে মামলা করেছেন।

মাহাবুর রহমান বলেন, আলবায়া নামের সমিতিতে তিনিসহ ৭০ জন আমানতকারী প্রায় চার কোটি টাকা জমা করেছিলেন। টাকা না পেয়ে মামলা করেন। পুলিশ সমিতির দুই উদ্যোক্তাকে গ্রেফতার করেছে; কিন্তু তারা টাকা ফেরত পাচ্ছেন না।

বাগমারা উপজেলা সমবায় দপ্তরের তথ্যমতে, গত কয়েক বছরে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গ্রাম পরিবেশ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বলে ৩০৩টি সমবায় সমিতি নিবন্ধন নিয়েছিল। কিন্তু তারা সঞ্চয় আমানত কার্যক্রম পরিচালনা করবেন এমন কথা বলেনি। গত বছর সমিতিগুলির বিরুদ্ধে টাকা জমা নিয়ে ফেরত না দেওয়ার অভিযোগ আসতে থাকে। এ সময় তদন্ত করে ৬৮টি সমিতির নিবন্ধন বাতিল করা হয়। বাকি ৯৯টি সমিতিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

উপজেলা সমবায় পরিদর্শক তাসনিমুল হক জানান, ২০১৮ থেকে ২০২০ এর মধ্যে এসব সমিতি নিবন্ধন লাভ করে। কিন্তু তারা সঞ্চয় আমানত নিতে শুরু করলে সমিতিগুলির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠে। ফলে অনেক সমিতির কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। কিন্তু অনেকেই এসব অবৈধ সমিতিতেই টাকা জমা করেন অতি মুনাফার লোভে।

এদিকে একটা উপজেলাতেই এত বেশিসংখ্যক সমিতির নিবন্ধন প্রদানের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।

এ বিষয়ে উপজেলা সমবায় অফিসার কাউসার আলী বলেন, নিবন্ধন দেওয়ার সময় সমিতির উদ্যোক্তা পরিচালকরা বলেনি তারা মুনাফার লোভ দেখিয়ে আমানত নেবে। নিবন্ধন পেয়েই তারা গ্রামে গ্রামে অফিস খুলে সঞ্চয় আমানত গ্রহণ করতে শুরু করে। আমরা জানতে পেরে অনেক সমিতির নিবন্ধন বাতিলও করি। এখন ৩০৩টি সমিতির মধ্যে কতগুলো সচল আছে তদন্ত করে বের করতে হবে। তবে কেউ যেন আর এসব সমিতিতে টাকা না রাখেন সেই পরামর্শ দেন তিনি।

অন্যদিকে যেসব সমিতির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে সেগুলোর একটির নাম আলোর বাংলা ফাউন্ডেশন। ফোন নম্বর সংগ্রহ করে যোগাযোগ করা হলে আলোর বাংলার পরিচালক আজিজুল হক জানান, তারা গ্রাহকের সঞ্চয় যেমন গ্রহণ করেছে তেমনি গ্রাহকদের মুনাফা ও ঋণও দিয়েছে। তাদের কিছু সম্পদ আছে এবং কিছু টাকা ঋণ হিসেবে গ্রাহকের কাছেও পড়ে আছে। তাদের সময় দিলে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিয়ে দেবেন।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম