Logo
Logo
×

সারাদেশ

নয় মাস পর সমুদ্রপথ খুলতেই সেন্টমার্টিনে হাজারও পর্যটক

Icon

কক্সবাজার প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:৩১ পিএম

নয় মাস পর সমুদ্রপথ খুলতেই সেন্টমার্টিনে হাজারও পর্যটক

কক্সবাজার–সেন্টমার্টিন নৌরুট দীর্ঘ নয় মাস বন্ধ থাকার পর উৎসবমুখর জনস্রোত। ছবি: যুগান্তর

কক্সবাজার–সেন্টমার্টিন নৌরুট দীর্ঘ নয় মাস বন্ধ থাকার পর আবার যখন খুলল, তখন সমুদ্রপথে যে উৎসবমুখর জনস্রোত নামবে—এমন দৃশ্য অনেকেই আশা করেননি। শুক্রবার (১ ডিসেম্বর) ভোরের আলো ফুটতেই দেখা গেল ভিন্ন এক কক্সবাজার। নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাটমুখী রাস্তা ভরে যায় শত শত পর্যটকে। অনেকে আবার রাতেই এসে ক্যাম্প করে থেকেছেন জেটিঘাট এলাকায়।

ঠিক সকাল ৭টায় তিনটি জাহাজ—এমভি বার আউলিয়া, এমভি কর্ণফুলী ও কেয়ারি সিন্দবাদ—ধীরে ধীরে বাঁধন ছাড়তেই ভেসে ওঠে উদ্বোধনী সাইরেন। নতুন মৌসুমের প্রথম দিনেই ১১০০ যাত্রী। সাম্প্রতিক বছরগুলোর নিরিখে প্রথম দিনের এই সংখ্যা যেন একটি স্পষ্ট বার্তা—দীর্ঘ অপেক্ষার পর সেন্টমার্টিন ফিরে পেয়েছে নিজের প্রাণ।

প্রশাসনের কঠোর নজরদারিতে প্রথম দিনের যাত্রা ‘স্বচ্ছ ও সুশৃঙ্খল’

জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও ট্যুরিস্ট পুলিশের যৌথ তদারকি ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রতিটি পর্যটকের টিকিট যাচাই, লাগেজ স্ক্যানিং, জাহাজে অতিরিক্ত যাত্রী ঠেকানো—সবই চলেছে কঠোরভাবে। রাজধানী থেকে আগত অনেক পর্যটকই বলছেন, ‘এভাবে কঠোর নজরদারি আগে কখনো দেখিনি।’ প্লাস্টিকমুক্ত সেন্টমার্টিন গড়ার অংশ হিসেবে প্রথমবারের মতো যাত্রীদের দেওয়া হয় অ্যালুমিনিয়ামের পানি বোতল।

সকালে ঘাটে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক এম এ মান্নান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহিদুল আলম, কক্সবাজার সদরের ইউএনও নীলুফা ইয়াসমিন চৌধুরী এবং ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ। ঘাটে সরেজমিন এসে তারা পর্যটকদের অভিবাদন জানান এবং নির্দেশনা অনুসরণ নিশ্চিত করেন।

জেলা প্রশাসক এম এ মান্নান বলেন—‘একটি দ্বীপ বাঁচাতে গেলে প্রথমেই থামাতে হবে প্লাস্টিক। আমরা এবার তা বাস্তবে প্রয়োগ করছি।’

দুই মাস রাতযাপনের অনুমতি—বাণিজ্য ও পরিবেশ দুই দিকেই ‘নতুন পরীক্ষা’

সেন্টমার্টিনে রাতযাপন নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ক এবার দুই মাসের জন্য শর্তসাপেক্ষে শিথিল করা হয়েছে—১ ডিসেম্বর থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। ১২ দফা নির্দেশনা কঠোরভাবে মানতে হবে। 

উল্লিখিত নির্দেশনাগুলো—সৈকতে রাতের আলো জ্বালানো নিষিদ্ধ উচ্চ শব্দে অনুষ্ঠান, বারবিকিউ, পার্টি নিষিদ্ধ কেয়াবনে প্রবেশ ও জীববৈচিত্র্যে ক্ষতি হলে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রবাল, শামুক-ঝিনুক, রাজকাঁকড়া সংগ্রহ-বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও মোটরচালিত যানবাহন নিষিদ্ধ, একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ, নিজস্ব ফ্লাস্ক ব্যবহারের পরামর্শ ও জাহাজে উঠার সময় অ্যালুমিনিয়াম বোতল সরবরাহ।

পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক খন্দকার মাহমুদ পাশা বলেন— প্লাস্টিকের বোতল বন্ধ না করতে পারলে দ্বীপ টিকবে না। এবার আমরা কঠোর প্রয়োগে যাচ্ছি। এবং সব ধরনের বিধিনিষেধ কঠোরভাবে বাস্তয়ান করা হবে।

এদিকে সেন্টমার্টিন জেটিঘাটের কাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। শ্রমিকরা বলছেন, ‘বড় ভিড় এলে হয়তো চাপ সামলানো কঠিন হবে।’ তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি আলী হায়দার জানালেন— ‘আগামী দুই সপ্তাহে সব কাজ সম্পন্ন হবে।’

টিকেট কালোবাজারি রোধেই কঠোরতা, প্রথম দিনে জরিমানা:

সদর ইউএনও নীলুফা ইয়াসমিন চৌধুরী জানান, সব টিকেট অনলাইনে বিক্রি হওয়ার কথা থাকলেও তিন পর্যটককে টিকেট দেওয়া হয়েছে। এমন অভিযোগ পেয়ে প্রথম দিনেই কেয়ারি সিন্দাবাদকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী এবার থেকে টিকিট পুরোটাই অনলাইন-ভিত্তিক, ট্যুরিজম বোর্ড অনুমোদিত পোর্টাল ছাড়া কোথাও টিকিট মিলবে না। প্রতিটি টিকিটে যুক্ত থাকবে— ট্রাভেল পাস, কিউআর কোড, যাত্রী যাচাইয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ঘাটে উপস্থিত ২০ জন ভলান্টিয়ার প্রতিনিয়ত যাচাই করছেন টিকিটের সত্যতা। ফলে কালোবাজারির সুযোগ প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। 

দ্বীপে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসছে—তবুও সামনে কঠিন পরীক্ষা

দীর্ঘ বিরতির পর সেন্টমার্টিনে এখন পুরোপুরি বদলে যাওয়া দৃশ্য। স্টলগুলোতে আবার রান্নার ধোঁয়া, হোটেল–মোটেলে বুকিংয়ের চাপ, স্থানীয়দের মুখে হাসি। কিন্তু একইসঙ্গে চলছে এক ধরনের অঘোষিত পরীক্ষা— ‘দায়িত্বশীল পর্যটন কি বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হবে?’

পরিবেশবিদদের মতে, এই দুই মাসের অভিজ্ঞতা থেকেই ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নির্ধারণ হবে— রাতযাপন আরও বাড়বে নাকি আবার নিষেধাজ্ঞা ফিরে আসবে।

সেন্টমার্টিনের ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান ফয়েজুল ইসলাম বলেন—‘এক দশক ধরে পর্যটনই আমাদের প্রাণ। সমস্যা থাকলেও আতিথেয়তায় আমরা কখনোই পিছিয়ে থাকব না।’ তিনি বলেন আমরা বিধিনিষেধ যাতে পর্যটকরা মানে সেজন্য সচেতনামূলক প্রচারণা চালাবো।

জেলা প্রশাসক এম এ মান্নান যুগান্তরকে বলেন— ‘সেন্টমার্টিন শুধু একটি দ্বীপ নয়—এটি আমাদের জাতীয় সম্পদ। কঠোর নজরদারিতে আমরা নিশ্চিত করছি— পর্যটন হবে নিরাপদ, সুশৃঙ্খল এবং পরিবেশবান্ধব।’ 

তিনি যোগ করেন— ‘নিয়ম ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম