দড়ি টেনেই ৫০ বছর পার
গোলাম মোস্তফা, উল্লাপাড়া (সিরাজগঞ্জ)
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:০৪ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘আশায় আশায় দড়ি টাইনা পার করলাম ৫০ বছর। আইজ পর্যন্তও সেতুর মুখ দেইখলাম না। কত এমপি চেয়ারম্যান কইল বিরিজ (ব্রিজ) বানাইয়া দিমু। আসলে কেউ কথা রাহে নাই। জীবনে বিরিজ দেইখা যাইতে পারমু সেটাও আর মনে হয় না।’
অনেক ক্ষোভ-দুঃখে কথাগুলো বললেন উল্লাপাড়া উপজেলা সলঙ্গা ইউনিয়নের চরগোজা গ্রামের সত্তরোর্ধ ইছহাক মিয়া।
এই ইউনিয়নের চরবেড়া গ্রামের পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝপঝপিয়া নদীর উপর একটি পাকা সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন এই জনপদের অন্তত ২০টি গ্রামের মানুষ। অপ্রশস্ত এই নদীতে স্বাধীনতার পর থেকে ডিঙ্গি নৌকায় দড়ি টেনে এখানকার লোকজন পারাপার হন।
ইছহাক মিয়া অর্ধশতাব্দী ধরে দড়ি টেনে নৌকা চালানোর কষ্টের কথা তার ভাষায় এমনভাবেই বললেন।
উল্লাপাড়া উপজেলার সলঙ্গা-ধামাইকান্দি রাস্তার মাঝে ঝপঝপিয়া নদীপার হয়ে চরবেড়া, তেলকুপি, গোজা, সাতটিক্রি, বড় গোজা, চর গোজা, মানিকদিয়ার, ছোট গোজা, দিয়ারপাড়া, ভরমোহনী, সলঙ্গা, ধামাইকান্দিসহ অন্তত ২০টি গ্রামের মানুষ সলঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদ, সলঙ্গা বাজার, ডাকঘর, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, সলঙ্গা থানাসহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন যাতায়াত করে থাকেন। এখানে ষষ্ঠি চন্দ্র দাস নামের একটি ব্যক্তি চরবেড়া খেয়াঘাটে একটি ডিঙ্গি নৌকায় লোকজন পারাপার করেন। তিনি পারাপার হওয়া পরিবারগুলো থেকে প্রতি বছর ধান নিয়ে থাকেন; কিন্তু দিনের বেশির ভাগ সময় বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি খেয়াঘাটে অনুপস্থিত থাকেন। ফলে নদী পারাপার হতে আসা লোকজনকে নিজের হাতে দড়ি টেনে চলাচল করতে হয়। বিশেষ করে চর বেড়া গ্রামে অবস্থিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চর বেড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নদী পারাপারে বেশি সমস্যায় পড়ে।
চর গোজা গ্রামের তাইজুল ইসলাম, চরবেড়া গ্রামের সোহেল রানা, মিলন হোসেন, শরিফ মিয়াসহ স্থানীয় ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, স্বাধীনতার আগে এই নদীতে পারাপারে জন্য স্থানীয়রা বাঁশের সাঁকো তৈরি করতেন; কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে নদীটি পার হতে একটি ডিঙ্গি নৌকা তাদের একমাত্র ভরসা।
তারা এই দীর্ঘ সময়ে একাধিক সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানদেরকে এখানে একটি সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন। তারা এ দাবি পূরণ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও আজ পর্যন্ত সে প্রতিশ্রুতি কেউই বাস্তবায়ন করেননি। ফলে নিজেদের দড়ি টেনে ছোট ডিঙ্গি নৌকায় ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পারাপারের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদেরকে। এসব ভুক্তভোগী এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি চান।
চর বেড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেরাজুল ইসলাম, মিম খাতুন, মাহিম রেজা, মাহিয়া আক্তরসহ অনেক শিক্ষার্থী দুঃখ করে বলেন, বেশির ভাগ দিনই ডিঙ্গি নৌকার মাঝি ষষ্ঠি কাকা থাকেন না। তারা দড়ি টেনে অনেক ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হন। অনেক দিন পড়ে গিয়ে স্কুল, পোশাক, ব্যাগ ভিজিয়ে ফেলেন। নিজেরা সাঁতার জানার কারণে কেউ পানিতে ডুবে যায়নি। এসব শিক্ষার্থী অবিলম্বে এই নদীতে একটি পাকা সেতু নির্মাণের দাবি জানান।
সলঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মন্টু জানান, তারা ঝপঝপিয়া নদীতে একটি পাকা সেতু নির্মাণের অনেক চেষ্টা করেছেন। রাজনৈতিক নেতাদের আবেদন অনুরোধ জানিয়েছেন; কিন্তু কেউ তাদের সমস্যা অনুধাবন করেননি। তবে সম্প্রতি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ থেকে এ খেয়াঘাটে কয়েক দফা জরিপ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) উল্লাপাড়া কার্যালয়ের উপজেলা প্রকৌশলী মো. শহিদুল্লাহ উক্ত ঝপঝপিয়া নদীতে স্থানীয় লোকজনের দড়ি টেনে ডিঙ্গি নৌকা চালানোর দুর্ভোগের বিষয়টি স্বীকার করে জানান, এলজিইডি থেকে ইতোমধ্যে ওই খেয়াঘাটে সেতু নির্মাণের জন্য পরিকল্পনা প্রস্তুত করে ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
