চাকরি মেলায় বদলে গেল ১৪৪৫ জনের জীবনের ঠিকানা
মতিউর রহমান, মানিকগঞ্জ
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:২৪ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সকাল গড়াতেই মানিকগঞ্জ কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (টিটিসি) চত্বর যেন রূপ নেয় স্বপ্নের মিলনমেলায়। কারও হাতে ফাইল, কারও বুকে জমে থাকা অনিশ্চয়তা, আবার কারো চোখে দীর্ঘদিনের বেকারত্ব কাটিয়ে ওঠার দৃঢ়প্রত্যয়।
বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) আয়োজিত চাকরি মেলাটি শুধু একটি নিয়োগ কার্যক্রম নয়— এটি ছিল হাজারও তরুণ-তরুণীর জীবনে নতুন করে দাঁড়ানোর এক মানবিক উপলক্ষ।
এ চাকরি মেলা থেকে প্রাথমিকভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন ১ হাজার ৪৪৫ চাকরিপ্রত্যাশী।
বেকার তরুণ-তরুণীদের জীবনে আশার আলো জ্বালাতে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মানিকগঞ্জ এবং সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের অর্থায়নে, উইনরক ইন্টারন্যাশনালের সহায়তায় আশ্বাস প্রকল্পের আওতায় ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন ও ওয়্যারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ আয়োজন বাস্তবায়ন করে।
শুরুতে মানবপাচারের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসা সারভাইভারদের জন্য চাকরি মেলার পরিকল্পনা করা হলেও পরে এটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। মানবপাচারের নির্মম অভিজ্ঞতা পেরিয়ে ফেরা ৮০ জন সারভাইভারের মধ্যে ৫০ জন এই মেলা থেকেই চাকরির সুযোগ পেয়েছেন; যা তাদের জীবনে ফিরে আসার পথে এক বড় পদক্ষেপ।
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় চাকরি মেলার উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নাজমুন আরা সুলতানা। টিটিসি মানিকগঞ্জের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী নূর অতএব আহম্মদের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মাদ আলী, মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌসুমী নাসরিন, উইনরক ইন্টারন্যাশনালের ম্যানেজার মায়াজ কাবির এবং মানিকগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাস।
নির্ধারিত সময়ের আগেই টিটিসি চত্বরে জমে ওঠে মানুষের ভিড়। কেউ অনেক দিন ধরে প্রস্তুত করা জীবনবৃত্তান্ত হাতে এসেছে, কেউ আবার শেষ মুহূর্তে বসেই নিজের সিভি তৈরি করেছেন। চাকরিপ্রত্যাশীদের চোখে ছিল একটাই প্রশ্ন—আজ কি ভাগ্য বদলাবে?
নিয়োগকর্তাদের টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই তরুণ-তরুণীদের অনেকেই বলছিলেন- এটাই আমাদের শেষ ভরসা।
টিটিসি, মানিকগঞ্জের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী নূর অতএব আহম্মদ জানান, মেলায় প্রায় ৫ হাজার ২৫৭ জন চাকরিপ্রত্যাশী জীবনবৃত্তান্ত জমা দেন। অংশগ্রহণকারী ১৬টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ৪৪৫ জনকে মনোনীত করা হয় এবং এর মধ্যে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েছেন ৬২৭ জন।
তিনি বলেন, প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সাড়া পেয়েছি। এটি প্রমাণ করে, তরুণরা সুযোগ পেলে তারা ঘুরে দাঁড়াতে জানে।
ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন, মানিকগঞ্জের কেস কো-অর্ডিনেটর মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, মানবপাচারের শিকার হয়ে যারা ফিরে আসেন, তারা শুধু কর্মহীন নয়—তারা মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েন। এই চাকরি মেলা তাদের আত্মবিশ্বাস ফেরানোর একটি প্রয়াস।
মেলায় অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল ম্যাক্স ফাউন্ডেশন, মুন্নু ফ্যাব্রিক্স, আকিজ গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সিঙ্গার বাংলাদেশ, স্বপ্ন, কেইফুং লেদার, ফ্রন্টডেস্ক বাংলাদেশসহ মোট ১৬টি প্রতিষ্ঠান।
চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা জানান, প্রাথমিকভাবে নির্বাচিতদের মধ্য থেকে যাচাই-বাছাই শেষে আরও নিয়োগ দেওয়া হবে।
দিনের শেষে টিটিসি প্রাঙ্গণে যখন ভিড় কমে আসে, তখন অনেকের মুখে ক্লান্তির ছাপ থাকলেও চোখে ছিল প্রশান্তির আলো। কেউ পেয়েছেন চাকরির নিশ্চয়তা, কেউ পেয়েছেন নতুন করে চেষ্টা করার সাহস।
এই চাকরি মেলা প্রমাণ করেছে—সঠিক উদ্যোগ আর মানবিক সহযোগিতা থাকলে বেকারত্বের অন্ধকার পেরিয়ে স্বপ্নের আলোয় ফেরা সম্ভব। মানিকগঞ্জের এ আয়োজন তাই শুধু একটি চাকরি মেলা নয়, এটি ছিল মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এক জীবন্ত উদাহরণ।
