Logo
Logo
×

সারাদেশ

দাবদাহে আগেই পেকেছে আম, দাম নিয়ে হতাশ চাষিরা

Icon

মো. আবু সাঈদ, নওগাঁ

প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২৫, ০৬:২০ পিএম

আমের ‘নতুন রাজধানী’ খ্যাত নওগাঁয় এবার আম পাড়ার সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। প্রশাসনের নির্ধারণ করে দেওয়া সময়সীমা অনুসারে আম্রপালি আম বাজারে আসার কথা ছিল ১৮ জুন থেকে।

কিন্তু প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সময়ের প্রায় ১৫ দিন আগে থেকেই বাজারে উঠতে শুরু করেছে আম্রপালি। শুধু আম্রপালি নয়, প্রায় সব জাতের আম দাবদাহের কারণে এবার নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পেকে গেছে।

নওগাঁর বাজারগুলো ভরে গেছে নানা জাতের আমে। এসব বাজার এখন দিনভর সরগরম থাকছে আম কেনাবেচায়। তবে প্রায় সব জাতের দাম দাবদাহের কারণে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পেকে গেছে।

এদিকে বাজারে ব্যাপক পরিমাণে আমের আমদানি হওয়ায় যথার্থ দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। দাম নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে তারা বলছেন, গত বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক দামে বিক্রি হচ্ছে নাক ফজলি, ল্যাংড়া, আম্রপালি, ব্যানানা ম্যাংগোসহ বিভিন্ন জাতের আম।

চলতি বছর নওগাঁয় ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে ১২ দশমিক ৭৮ টন হিসাবে জেলায় আম সংগ্রহের মোট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৮৭ হাজার ২৩৪ টন। চলতি মৌসুমে এ জেলায় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার আম-বাণিজ্য হতে পারে বলে ধারণা করছে স্থানীয় প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ।

নওগাঁর সবচেয়ে বড় আমের বাজার সাপাহার উপজেলা সদর আমের হাট। মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে সাপাহার আমের হাটে গিয়ে দেখা যায়, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইঞ্জিনচালিত ভটভটিতে ক্যারেটে ভর্তি করে হাটে আম এনেছেন চাষিরা।

উপজেলা সদরের গোডাউনপাড়া থেকে জিরোপয়েন্ট, হাসপাতাল রোড থেকে জিরোপয়েন্ট এবং জিরোপয়েন্ট থেকে কলেজ মোড় পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রাস্তার দুপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসেছে আমের বাজার।

আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গুটি আম ওঠার মধ্য দিয়ে গত ২২ মে শুরু হয়েছে সাপাহার আমের হাট। বাজারে গোপালভোগ ও ক্ষিরসাপাত আম উঠেছে ২৮ মে থেকে। প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা অনুযায়ী নওগাঁর আম হিসেবে জিআই স্বীকৃতি পাওয়া নাক ফজলি আম ৫ জুন থেকে বাজারে ওঠার কথা ছিল; কিন্তু দাবদাহের কারণে নির্ধারিত সময়ের ৮-১০ দিন আগেই বাজারে উঠতে শুরু করে।

নওগাঁয় সবচেয়ে বেশি চাষ হওয়া আম্রপালি আম প্রশাসনের নির্ধারণ করা সময়সীমা অনুযায়ী ১৮ জুন থেকে বাজারে আসার কথা ছিল। কিন্তু সেই জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বাজারে উঠতে শুরু করে। আম্রপালি আম বাজারে ওঠার পর থেকেই বাজার জমজমাট হয়ে ওঠে।

প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সময়ের অনেক আগেই পাকতে শুরু করেছে ব্যানানা ম্যাঙ্গো ও বারি আম-৪। ব্যানানা ম্যাঙ্গো আম বাজারে আসার কথা ২৫ জুন এবং বারি আম-৪ বাজারে আসার কথা ১০ জুলাই থেকে। অথচ নওগাঁর বাজারে ইতোমধ্যে উঠতে শুরু করেছে ব্যানানা ম্যাঙ্গো ও বারি আম-৪।

সাপাহার আম বাজারে কথা হয় পত্নীতলা উপজেলা রূপগ্রামের সাইফুল, বেলাল হোসেন, সাপাহার উপজেলার তিলনা গ্রামের সাখাওয়াত হোসেন, আইহাই গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম, নিখিল বর্মণ, ফুটকইল গ্রামের সোহেল রানা, গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে।  

তারা বলেন, এবার প্রচণ্ড-গরমের কারণে আম্রপালি, নাক ফজলি, বারি আম-৪, ল্যাংড়া, ব্যানানা ম্যাঙ্গো আম আগেভাগেই পেকে গেছে। গোপালভোগ, ক্ষিরসাপাতি ও নাক ফজলি আম বাজারে ওঠার চার-পাঁচ দিন দাম ঠিকমতো পেলেও সময়ের আগেই আম্রপালি ও ল্যাংড়া আম বাজারে উঠতে শুরু করায় দরপতন শুরু হয়। এখন বাজারে একসঙ্গে নাক ফজলি, আম্রপালি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ আম প্রচুর পরিমাণে বাজারে উঠছে। ফলে আমের যথার্থ দাম পাচ্ছেন না চাষিরা।

এসব আমচাষি জানিয়েছেন, ল্যাংড়া আম মণপ্রতি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা, আম্রপালি ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকা, নাক ফজলি ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা, ব্যানানা ম্যাঙ্গো ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকা এবং বারি আম-৪ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা মণ দরে।

তারা আরও জানান, প্রশাসন এবার কেজি দরে আম কেনার নির্দেশনা দিলেও সেই নির্দেশনা মানছেন আড়তদাররা। আগেই ঢলতা প্রথা অনুযায়ী এ বাজারে আম বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ কেজিতে মণ দরে। বেশ কয়েক বছর ধরে এ নিয়ম চলে আসছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা।

আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা জানান, গত বছর এই সময়ে ল্যাংড়া আম মণপ্রতি ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা, আম্রপালি ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকা, নাক ফজলি ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা, বারি আম-৪ ৩ হাজার ৮০০ থেকে  ৪ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে।

সাপাহার আমচাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন হাবিব বলেন, গত বছর আম্রপালি আম বাজারে যখন প্রথম উঠতে শুরু করে সেই সময় প্রতি মণ আম ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকায়। মৌসুমের শেষ দিকে প্রতি মণ আম্রপালি ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা মণ দরেও বিক্রি হয়েছে। অথচ সেই আম এবার বাজারে ওঠার শুরুতেই বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকায়। দাবদাহের কারণে বাগানের আম পেকে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে আম বিক্রি করছেন চাষিরা।

 

ফুটকইল গ্রামের আমচাষি গিয়াস উদ্দিন বলেন, সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশকের দাম এবং সেচ ও শ্রমিকের খরচ বাড়ায় আম উৎপাদনের খরচ বেড়েছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। বেড়েছে পরিবহণ খরচও। অথচ গত বছরের চেয়ে অর্ধেকেরও কম দামে এবার আম বিক্রি হচ্ছে। গত বছর ৫০ টাকা কেজির নিচে আম্রপালি আম বিক্রি হয়নি। অথচ এবার সেই আম ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। দাবদাহের প্রভাব তো আছেই এর সঙ্গে আড়তদারদের কারসাজিও আছে। তারা সিন্ডিকেট করে আমচাষিদের ঠকাচ্ছে। চাষিদের কাছ থেকে কম দামে আম কিনছেন অথচ ঢাকাসহ দেশের বড় বড় বাজারে এই আমই ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি করছে।

সাপাহারের গোডাউনপাড়া এলাকায় বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কের স্বত্বাধিকারী তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানা এ বছর প্রায় ২০০ বিঘা জমিতে আম চাষ করেছেন। তিনি বলেন, এবার সব উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। সাধারণত ল্যাংড়া, নাক ফজলি ও গোপালভোগ আম সংগ্রহ শেষপর্যায়ে আসলে আম্রপালি ও বারি আম-৪ এসব আম বাজারে উঠতে শুরু করে; কিন্তু এবার প্রায় একই সময়ে এসব আম পেকে গেছে। প্রচণ্ড গরমের কারণে এমনটি হয়েছে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম