দুই নেতার দ্বন্দ্বের বলি সাধারণ নেতাকর্মীরা
রাউজানে মাঠ ধরে রাখতে পেশিশক্তি প্রয়োগ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
চট্টগ্রামের রাউজানে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক (সদ্যবিলুপ্ত) গোলাম আকবর খোন্দকার এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর (পদ স্থগিত) দ্বন্দ্বের বলি হচ্ছেন দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা। ৫ আগস্টের পর এখানে ১৫টি হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এর মধ্যে ১০টিই রাজনৈতিক। সংঘাত-সংঘর্ষে দুই গ্রুপের ৩ শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। সর্বশেষ মঙ্গলবার গোলাম আকবরের ওপর হামলা এবং এর জেরে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অন্তত ৪০ জন আহত হওয়ার ঘটনায় দুই নেতার দ্বন্দ্ব যেন চিরস্থায়ী রূপ নিয়েছে। যদিও ওই ঘটনার পরপরই দলের হাইকমান্ড চট্টগ্রাম উত্তর জেলা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে। পৃথক চিঠিতে গিয়াস কাদেরের বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানের পদসহ সব পর্যায়ের পদ স্থগিত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বারবার সতর্ক করার পরও এলাকায় হানাহানি ও সন্ত্রাসে মদদ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।
এদিকে মঙ্গলবার রাউজানে হামলা ও সংঘর্ষের জন্য গিয়াস কাদের চৌধুরীকে সরাসরি দায়ী করেছে গোলাম আকবর ও রাউজান উপজেলা বিএনপি। এক সংবাদ সম্মেলনে হামলায় নেতৃত্বদানকারী শীর্ষ সন্ত্রাসী আজিজুল হকসহ ১১ জনের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। অন্যদিকে গিয়াস কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও হানাহানিতে মদদ দেওয়ার যে অভিযোগ কেন্দ্র থেকে আনা হয়েছে, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, রাউজানে সব হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য গোলাম আকবর দায়ী। তার অনুসারীরা মঙ্গলবারের ঘটনার প্রতিবাদে বুধবার রাউজানে মিছিল ও সংবাদ সম্মেলন করেছে। গোলাম আকবরের হয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরাই ঘটনার সূত্রপাত করে বলে দাবি করেন গিয়াস কাদের।
অন্যদিকে গোলাম আকবরের ছেলে তারেক আকবর খোন্দকার বলেছেন, ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়ে নতুন বাংলাদেশ আমাদের দিয়েছে। নতুন বাংলাদেশে একজন প্রবীণ রাজনীতিকের ওপর দলীয় প্রতিপক্ষের এমন হামলা কখনো মেনে নেওয়া যায় না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গোলাম আকবর ও গিয়াস কাদেরের বিরোধ বহু পুরোনো। দলের যে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে তারা পালটাপালটি অবস্থান নেন এলাকায়। আগামী সংসদ নির্বাচনে রাউজানে বিএনপি থেকে এ দুই নেতা ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করতে চান। তাই দুই নেতাই মাঠ ধরে রাখতে চান। এটি করতে গিয়েই মূলত পেশিশক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে। যার চূড়ান্ত রূপ দেখা গেছে স্বয়ং গোলাম আকবরের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে। রাউজানে গিয়াস কাদের চৌধুরীর অবস্থান শক্ত বলেও জানান তারা।
মঙ্গলবার বিকালে রাউজান উপজেলা বিএনপির প্রয়াত সভাপতি মহিউদ্দিন আহমদের কবর জিয়ারত করতে গেলে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কের সত্তার ঘাট এলাকায় দলীয় প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হন গোলাম আকবর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, কালো একটি পাজেরো জিপ নিয়ে যখন গোলাম আকবর সত্তারঘাট এলাকা অতিক্রম করছিলেন, তখন লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল নিয়ে তার দিকে তেড়ে আসছেন ৫০/৬০ জন যুবক। তারা বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। প্রত্যুত্তরে গোলাম আকবর খোন্দকারের গাড়িবহরের লোকজনও হামলা প্রতিরোধের চেষ্টা করলে সংঘর্ষ বাধে। একপর্যায়ে গোলাম আকবরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে তার কয়েকজন অনুসারী নিরাপদ স্থানে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তখনো তাকে ধাওয়া করছিল প্রতিপক্ষের লোকজন। এ সময় তাকে ঘিরে থাকা কয়েকজনকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখা যায়। গোলাম আকবরও রক্তাক্ত হন। তাকে একটি বাইকে তুলে সরিয়ে নেওয়া হয়।
হামলায় নেতৃত্ব দেন ১১ সন্ত্রাসী : ঘটনার প্রতিবাদে বুধবার গোলাম আকবর খোন্দকারের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম শহরে সংবাদ সম্মেলন করে রাউজান বিএনপি। অন্যদিকে বিক্ষোভ সমাবেশ করে রাউজানকে অশান্ত করার জন্য দুই নেতাকে দায়ী করেন পরস্পরের অনুসারীরা। গোলাম আকবরের গাড়িবহরে হামলায় শীর্ষ সন্ত্রাসী আজিজুল হকসহ ১১ জন নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে দাবি করেছে রাউজান উপজেলা বিএনপি। অন্যরা হলেন-সাবের সুলতান কাজল, মোহাম্মদ রিয়াজ, শাহজাহান সাহিল, লিটন মহাজন, শাহাদত মির্জা, ইউসুফ তালুকদার, মোহাম্মদ সোহেল, মোহাম্মদ একরাম, রাসেল খান ও মোহাম্মদ শহিদ। রাউজান উপজেলা বিএনপির সভাপতি জসিম উদ্দিন সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য দেন। জসিম উদ্দিন বলেন, উপজেলা বিএনপির প্রয়াত সভাপতি মহিউদ্দিন আহমদের কবর জিয়ারত করতে যাওয়ার পথে সন্ত্রাসীরা অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সত্তারঘাট এলাকায় গোলাম আকবরের ওপর হামলা করে। হামলায় গোলাম আকবরসহ ৩০ নেতাকর্মী আহত হন। তার ব্যবহৃত পাজেরো জিপ ভাঙচুর, ৯-১০টি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ এবং অন্তত ২০টি মোটরসাইকেল হামলাকারীরা নিয়ে যায় বলে দাবি করা হয়।
মঙ্গলবার ঘটনার পরপর ফেসবুক লাইভে আসেন গোলাম আকবর খোন্দকারের ছেলে তারেক আকবর খোন্দকার। তিনি বলেন, রাউজানে সহিংস রাজনীতি চলছে। আমার বাবা বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, সাবেক এমপি ও সাবেক রাষ্ট্রদূত। তার মতো একজন স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিককে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে, তা কল্পনাও করিনি। তিনি আরও বলেন, আমার বাবার ওপর গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর সন্ত্রাসী বাহিনী হামলা করেছে। তার গুন্ডাবাহিনী আমার বাবাকে হত্যাচেষ্টা করেছে। আমার বাবা সব সময় সহিংস রাজনীতির বিপক্ষে। কী হচ্ছে এই বাংলাদেশে। আমরা কি এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম।
গোলাম আকবরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা : চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সদ্যবিলুপ্ত কমিটির আহ্বায়ক গোলাম আকবরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে গিয়াস কাদের চৌধুরীর অনুসারীরা। মঙ্গলবার তাদের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিতে হামলার প্রতিবাদে বুধবার রাউজানে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। বিকালে উত্তর জেলা বিএনপি নেতা আবু জাফর চৌধুরীর নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু হয় রাউজান সদর মুন্সিরঘাটা থেকে। মিছিলটি চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক হয়ে জলিলনগর বাসস্টেশন চত্বরে গিয়ে সমাবেশে মিলিত হয়।
পুলিশের বক্তব্য : রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, মঙ্গলবারের সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের কোনো ব্যর্থতা নেই। ঘটনার দিন সকাল থেকে যৌথভাবে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ সড়কে একসঙ্গে টহলে ছিল। টহলের ফাঁকে সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটে যায়। এদিকে বুধবার রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত থানায় কোনো পক্ষ মামলা বা অভিযোগ করেনি বলে জানান তিনি।
গিয়াস কাদেরের পদ স্থগিত : নিজ এলাকায় দলের অভ্যন্তরে হানাহানি ও সংঘাতে মদদ দেওয়ার অভিযোগে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর পদ স্থগিত করা হয় মঙ্গলবার রাতেই। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত চিঠিতে এই স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। চিঠিতে বলা হয় ‘আপনাকে দল থেকে বারবার সতর্ক করার পরও আপনি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে উসকানি দিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। তাই দলের গঠনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ স্থগিত করা হলো। তবে গিয়াস কাদের চৌধুরী তার বিরুদ্ধে আনা দলের এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, তিনি মহলবিশেষের ষড়যন্ত্রের শিকার। ছাত্রলীগের লোকজন নিয়ে রাউজানে সন্ত্রাস করছেন গোলাম আকবর খোন্দকার।
একই রাতে পৃথক চিঠিতে রাউজানে সংঘাতের ঘটনায় চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। শিগ্গিরই আহ্বায়ক কমিটি পুনর্গঠন করা হবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

