Logo
Logo
×

সারাদেশ

সুদের কারবারিদের পোয়াবারো

ঋণের বৃত্তে বন্দি নিম্ন আয়ের মানুষ, পালিয়ে বেড়াচ্ছে অনেক পরিবার

তানজিমুল হক

তানজিমুল হক

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৫, ১০:২০ এএম

ঋণের বৃত্তে বন্দি নিম্ন আয়ের মানুষ, পালিয়ে বেড়াচ্ছে অনেক পরিবার

ঋণের বৃত্তে আটকা পড়েছেন বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের তিন জেলার নিম্ন আয়ের মানুষ। কিছুতেই এ বৃত্তের নাগপাশ থেকে মুক্তি মিলছে না। বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এবং সুদের কারবারিদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে পড়ছেন বেকায়দায়। 

ঋণের অর্থ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ না করে সাংসারিক প্রয়োজনে ব্যয় করছেন। ফলে পরিশোধ করতে না পারায় পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠেছে। এনজিওগুলো টার্গেট পূরণে যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ দিচ্ছে। ঋণ পরিশোধের জন্য এনজিও এবং সুদ কারবারিদের অব্যাহত চাপের মুখে ঋণগ্রস্তরা হয়ে পড়ছেন দিকভ্রান্ত। মানসিক যন্ত্রণায় অনেকেই এখন এলাকাছাড়া। অনেকেই অভাবের তাড়নায় হতাশ হয়ে বেছে নিচ্ছেন আত্মহননের পথ। ঋণের বৃত্তে বন্দি হয়ে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। বৃহত্তর রাজশাহীর তিনটি জেলা-রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোরে এ ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। এ ধরনের মৃত্যু নিয়ে অবশ্য সরকারি কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এমন ঘটনা রাজশাহী অঞ্চলে বেশি ঘটছে। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোর জেলায় ১১ জন আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। গত ৫ দিনে শুধু রাজশাহীর দুটি উপজেলাতেই ছয়জনের মৃত্যু ঘটেছে। ঋণ আর অভাবের কারণে ১৫ আগস্ট গভীর রাতে স্ত্রী, ছেলে ও শিশুকন্যাকে হত্যার পর রাজশাহীর পবা উপজেলার বামনশিকড় গ্রামের মিনারুল ইসলামের আত্মহত্যার ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ মর্মান্তিক ঘটনার আগে মিনারুল দুই পাতার একটি চিরকুট লিখে যান। পুলিশ সেই চিরকুট তার ঘর থেকে উদ্ধার করে। 

চিরকুটে তিনি লেখেন, ঋণের চাপে ও খাবারের অভাবে তিনি একে একে স্ত্রী মনিরা, ছেলে মাহিম এবং তিন বছরের কন্যা ছোট্ট মিথিলাকে হত্যার পর নিজে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।


মিনারুলের প্রতিবেশী পারিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাঈদ আলী মুর্শেদ বলেন, ‘আমার এলাকায় মিনারুলের ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। মিনারুল টিএমএসএস এবং গাব নামে দুটি এনজি থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিল। কাজকর্ম না থাকায় শোধ করতে পারছিল না। ঋণ শোধের জন্য চাপ ছিল।’

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে টিএমএসএসের খড়খড়ি শাখার ব্যবস্থাপক মশিউর রহমান বলেন, ‘মিনারুলকে টাকার জন্য চাপ দেওয়া হয়নি। এ ধরনের অভিযোগ ভিত্তিহীন। কাউকেই আমরা চাপ দিই না।’

এনজিওগুলোর বিষয়ে নজরদারির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে চেয়ারম্যান মোর্শেদ বলেন, এলাকায় ৩০-৩৫টি এনজিও ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। এসব এনজিও কীভাবে পরিচালিত হয়, সেটি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর দেখা উচিত।

এদিকে মিনারুলের এ ঘটনার রেশ না কাটতেই সোমবার (১৮ আগস্ট) সকালে জেলার মোহনপুর উপজেলার খাড়ইল গ্রামের পানবরজ থেকে আকবর শাহ (৫০) নামের এক কৃষকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। আকবরের বাড়িতে তার স্ত্রীর নামে পাওয়া গেছে ব্র্যাক, আশা ও প্রশিকাসহ ১১টি এনজিওর পাশ বই। আকবর দফায় দফায় স্ত্রীর নামে এসব এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। মোহনপুর থানার ওসি আতাউর রহমান বলেন, ‘বাড়িতে পাওয়া পাশ বইয়ের মধ্যে ছয়টির ঋণ ছিল। সপ্তাহে ৫ হাজার টাকা কিস্তি লাগত। কিস্তি দিতে না পারার কারণে মানসিক চাপে আকবর আত্মহত্যা করতে পারেন বলে আমাদের ধারণা।’

এর আগে ১৪ আগস্ট রাতে একই উপজেলার বেলনা গ্রামের বাসিন্দা ফজলুর রহমান (৫৫) নামে এক রিকশাচালককে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কেশরহাট পৌরসভা সদরে পাওয়া যায়। উদ্ধারের পর তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে পরদিন তার মৃত্যু হয়। 

স্বজনদের দাবি, কেশরহাট এলাকার সুদ কারবারি ধুলু মিয়ার (৪৫) কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা ধার নেন ফজলুর রহমান। সুদসহ ৪৩ হাজার টাকা শোধ করলেও আরও টাকা দাবি করছিলেন তিনি। টাকা না দেওয়ায় ধুলুসহ কয়েকজন ফজলুরকে হাত-পা বেঁধে ঘাস মারার বিষ খাইয়ে ফেলে রেখে যায়।

এর আগে ১৬ জুলাই পবার নওহাটা কলেজ মোড় এলাকার একটি ছাত্রাবাসে মো. শামসুদ্দিন (৩২) নামের এক সিএনজি অটোরিকশাচালক আত্মহত্যা করেন। তার বাড়ি তানোর উপজেলায়। ঋণের বোঝা টানতে না পেরে তিনি এলাকা ছেড়ে নওহাটায় থাকছিলেন। শামসুদ্দিনের স্ত্রী শিলা খাতুনের ভাষ্য, স্বামীর ঋণ পরিশোধে তিনি নিজেও টেক্সটাইল মিলে শ্রমিকের কাজ করছিলেন। এর মধ্যেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তার স্বামী।

এছাড়া ২০২৩ সালের ২৩ মার্চ জেলার দুর্গাপুর উপজেলার শ্যামপুর গ্রাম থেকে রেন্টু পাইক (৫০) নামের এক কৃষকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। সেদিন তার ৫ হাজার টাকা কিস্তি দেওয়ার কথা ছিল। তিনি আত্মহত্যা করেন কিস্তির টাকা জোগাড় করতে না পেরে। রেন্টু পাইকের বাড়ি থেকে ১৮টি এনজিওর পাশ বই উদ্ধার করেছিল পুলিশ। এর মধ্যে অর্ধেকের ঋণ পরিশোধিত থাকলেও বাকিগুলোর ঋণ চলমান ছিল।

২ জুন নাটোরের লালপুরে আর্থিক অনটন এবং ঋণের চাপে রউফুল ইসলাম এবং তার স্ত্রী ফাতেমা খাতুন আত্মহত্যা করেন। মে মাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বালিয়াডাঙায় গ্রামে বিভিন্ন এনজিওর ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে নূর মোহাম্মদ নামের এক যুবক আত্মহত্যা করেন। 

অপরদিকে ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে রুরাল রিকনস্ট্রাকশন ফাউন্ডেশন (আরআরএফ) নামের একটি এনজিওর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর শাখা থেকে ঋণ নিয়েছিলেন জহুরুল ইসলাম (৫৫)। বিদেশে গিয়ে ছেলে দুর্ঘটনায় পড়লে তিনি দুটি কিস্তি পরিশোধ করতে পারেননি। এনজিওর মাঠকর্মীরা বারবার বাড়িতে গিয়ে চাপ দিচ্ছিলেন। উপায় না পেয়ে রাজশাহী শহরে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে আত্মগোপন করেন তিনি। কিন্তু ২৯ এপ্রিল সেখানে গিয়ে জহুরুলকে খুঁজে বের করেন আরআরএফের কর্মীরা। 

অপমান করেন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতেই। তখন বানেশ্বরে এনজিওর কার্যালয়ে গিয়ে জহুরুল বলেছিলেন, এভাবে চাপ দিলে আত্মহত্যা ছাড়া তার পথ থাকবে না। তাতেও মন গলেনি কর্মকর্তাদের। ফলে সেদিন দুপুরে ঘাস মারা বিষ কিনে নিয়ে গিয়ে এনজিও কার্যালয়েই পান করেন জহুরুল। এরপর দীর্ঘ সময় হাসপাতালে থাকলেও এখনো তিনি সুস্থ হতে পারেননি।

এদিকে সম্প্রতি রাজশাহীর চারঘাটের মুংলি ও কালুহাটি গ্রামের বেশ কয়েকটি পরিবার ঋণের দায়ে বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এছাড়া পার্শ্ববর্তী বাঘা উপজেলার পীরগাছা, মাঝপাড়া, দিঘা ও বাউসসহ কয়েকটি গ্রামের অন্তত ২০টি পরিবারের লোকজন পালিয়ে গেছেন। এসব গ্রামে ঋণগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বৃহত্তর রাজশাহীর অন্য উপজেলাগুলোতে একই অবস্থা বিরাজ করছে।

রাজশাহীতে বরেন্দ্র উন্নয়ন প্রচেষ্টা নামের একটি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ফয়েজুল্লাহ বলেন, এ অঞ্চলে যারা এনজিও থেকে ঋণ নেন তাদের অধিকাংশই কৃষিতে বিনিয়োগের জন্য নেন। কিন্তু ওই টাকা তারা কাজে লাগাতে পারেন না। আবার অনেকে ঋণ নিয়ে অভাবের তাড়নায় খরচ করে ফেলেন। 

তিনি আরও বলেন, এনজিওগুলো সুদের হার ১৪ শতাংশ বললেও বাস্তবে নেয় ৩০ শতাংশ। এছাড়া বিনিয়োগ করে আয়ের আগেই প্রতি সপ্তাহে কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। ফলে যে টাকা হতদরিদ্র মানুষ ঋণ নেন, তা আর শোধ করতে পারেন না। ঋণের জালে ফেঁসে যান। অন্যদিকে এনজিওগুলো ঋণ শোধের জন্য মানসিক যন্ত্রণা শুরু করে। একপর্যায়ে ভুক্তভোগী মানুষগুলো আত্মহননের পথ বেছে নেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য এবং অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ খান গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্ষুদ্রঋণ ইস্যুতে মাঠে কাজ করেন। 

শিক্ষার্থীদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, মানুষকে ঋণ দেওয়ার জন্য এনজিওগুলো তাদের কর্মীদের নির্দিষ্ট একটি টার্গেট দেয়। কর্মীরা চাকরি বাঁচাতে এই টার্গেট পূরণের জন্য যাচাই না করেই ঋণ দেন। আবার যারা ঋণ নেন, তারা সুনির্দিষ্ট খাতে টাকা বিনিয়োগ না করে সাংসারিক কাজে ব্যয় করে ফেলেন। সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। সব মিলিয়ে এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালাতে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) অনুমোদন প্রয়োজন হলেও তা অনেকেই মানছেন না। কর্তৃপক্ষ জানেই না তাদের কত প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালাচ্ছে। জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মনিরা খাতুন জানান, তাদের মোট নিবন্ধিত সংস্থা এক হাজার ১০০। তবে সক্রিয় আছে ৭১৩টি। এদের মধ্যে কারা ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালায়, সে তথ্য তার কাছে নেই। 

মনিরা খাতুন আরও বলেন, কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পেয়েছি। কিন্তু এসব ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার কর্তৃপক্ষ আমরা নই। ঋণ কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দিয়ে থাকে এনজিও ব্যুরো, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি ও মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। 

সার্বিক বিষয়ে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ ইয়াকুব হোসেন বলেন, ঋণের টাকা সঠিকভাবে বিনিয়োগ হলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু অপব্যবহার হলে সমস্যা হয়। আমরা এনজিওগুলোকে পরামর্শ দিয়ে থাকি, যেন তারা যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেয় এবং টাকাটা সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয়েছে কিনা তা দেখে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম