Logo
Logo
×

সারাদেশ

অভিশপ্ত শৈশব পেরিয়ে নতুন স্বপ্নের পথে মণি ও মুক্তা

Icon

একরাম তালুকদার, দিনাজপুর ও আব্দুর রাজ্জাক, বীরগঞ্জ

প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২৫, ০৭:১১ পিএম

অভিশপ্ত শৈশব পেরিয়ে নতুন স্বপ্নের পথে মণি ও মুক্তা

এক সময় সমাজের চোখে তারা ছিল ‘অভিশপ্ত’। জন্মের পরই কুসংস্কার, অপবাদ আর মানুষের দয়া বঞ্চনার ছায়া পড়েছিল মনি-মুক্তার ওপর। কেউ কেউ বলেছিলেন, এ জোড়া শিশু হবে সাধারণ জীবনের বাইরে।

তবু সেই ভয়াল প্রতিকূলতা ও অন্ধকারের মাঝেই জন্ম নেওয়া দুই কন্যা আজ হয়ে উঠেছে সাহস, স্বপ্ন আর অধ্যবসায়ের উজ্জ্বল উদাহরণ।

বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানে আলোচিত ও নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে ১৭ বছরে পা দেওয়া মনি-মুক্তার জীবন আজ অনুপ্রেরণার প্রতীক। দেশে প্রথম সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জোড়া লাগানো শিশুর সফল পৃথকীকরণের ইতিহাস হলো দিনাজপুরের মনি ও মুক্তা।

শুক্রবার (২২ আগস্ট) তাদের জন্মদিন। দেশের মানুষের কাছে দোয়া চেয়ে মনি-মুক্তা বলেন, আমরা চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করতে চাই। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি। দেশবাসীর দোয়া ও সহযোগিতা পেলে অবশ্যই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে। তবে প্রতি বছর আত্মীয়স্বজন, সহপাঠীদের ও পাড়া-প্রতিবেশীদের নিয়ে জন্মদিন পালন করলেও এবার ঘরোয়াভাবে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আমরা জন্মদিন পালন করব।

২০০৯ সালের ২২ আগস্ট দিনাজপুরের পার্বতীপুরের ল্যাম্ব হাসপাতালে জন্ম নেয় মনি ও মুক্তা। জন্মের পরই বিস্ময় ছড়িয়ে পড়ে, কারণ তারা ছিল একে অপরের পেট জোড়া লাগানো যমজ। কেউ কেউ এটিকে সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ ভেবে পরিবারের ওপর কটু কথা বলত।

অনেকেই বলেছিল- শরীর জোড়া লাগানো এই শিশু দুটিকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলাদা করার ইতিহাস বাংলাদেশে নেই। এমন চিকিৎসক বাংলাদেশে নেই। অনেকে বলছিল- তাদের আলাদা করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হলে বিদেশে নিতে হবে।

দরিদ্র পরিবারে অভাব অনটন থাকায় বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য না থাকলেও বাবা জয় প্রকাশ পাল ও মা কৃষ্ণা রাণী পাল হাল ছাড়েননি। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিতে থাকেন সন্তানদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য।

অবশেষে রংপুরের চিকিৎসকদের পরামর্শে শরণাপন্ন হন ঢাকার শিশু হাসপাতালে। ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শিশু হাসপাতালে শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. এআর খানের নেতৃত্বে সম্পন্ন হয় জটিল অস্ত্রোপচার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে সেই দুঃসাহসিক অস্ত্রোপচার। অবশেষে মনি-মুক্তাকে সফলভাবে আলাদা করা হয়। ভিন্ন সত্ত্বা লাভ করে মনি ও মুক্তা।

এ সফল অস্ত্রোপচার বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় হিসেবে লেখা হয়। দেশে প্রথম অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জোড়া লাগানো শিশুর সফল পৃথকীকরণের ইতিহাস হলো মনি ও মুক্তা। বাবা-মায়ের দৃঢ় মনোবল ও দেশে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সফলতা জয় প্রকাশ পাল ও কৃষ্ণা পালের পরিবারের সেই অন্ধকার পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। অন্ধকার পরিস্থিতি পাল্টে আলোচিত হয়ে ওঠে সারা দেশে।

দেশজুড়ে আলোচিত সেই মনি ও মুক্তা আজ বেড়ে উঠছে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার শতগ্রাম ইউনিয়নের পালপাড়া গ্রামে। দুজনেই স্থানীয় ঝাড়বাড়ী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। প্রতিদিন তারা ৩ কিলোমিটার পথ বাইসাইকেলে করে স্কুলে যায়। শুধু পড়াশোনা নয়, নাচ, গান, ছবি আঁকা ও কাপড়ে পেইন্টিংয়ে তারা সমান দক্ষ। স্থানীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাদের নাম উচ্চারণ করা হয় গর্বের সঙ্গে।

বাবা জয় প্রকাশ পাল বলেন, মনি-মুক্তা পড়াশোনায় মনোযোগী, পাশাপাশি নাচ, গান ও আঁকাআঁকিতে তাদের প্রতিভা গ্রামের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দিয়েছে। আমি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই তারা যেন মানুষের মতো মানুষ হয়ে দেশের সেবা করতে পারে।

মা কৃষ্ণা রাণী পাল বলেন, জন্মের পর সমাজের নানা কুসংস্কার আমাদের একঘরে করে দিয়েছিল; কিন্তু সৃষ্টিকর্তা ও চিকিৎসকদের আশীর্বাদে আজ তারা স্বাভাবিকভাবে বেঁচে আছে। আমরা চাই, বড় হয়ে তারা মানুষের পাশে দাঁড়াক। যাদের এক সময় সমাজ ‘অভিশপ্ত’ বলেছিল, আজ তারা গ্রামের মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।

মনি-মুক্তা প্রমাণ করেছেন শিক্ষা, পারিবারিক সাহস আর সামাজিক সহযোগিতা থাকলে অসম্ভব কিছু নেই। তাদের স্বপ্ন চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা প্রতিদিন তাদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

মনি-মুক্তার জীবন গল্প শুধুই ব্যক্তিগত সাফল্যের গল্প নয় এটি সাহস, অধ্যবসায় ও মানবিকতার এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত। ১৭ বছরে এরা দেখিয়েছে, প্রতিবন্ধকতা যতই বড় হোক, স্বপ্ন আর পরিশ্রম থাকলে এগিয়ে যাওয়ার পথ সবসময় খোলা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম