Logo
Logo
×

সুস্থ থাকুন

হাইপোফাইব্রিনোজেনেমিয়া

রক্ত জমাট না বাঁধার নীরব ঘাতক

Icon

ডা. মো. কামরুজ্জামান

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রক্ত জমাট না বাঁধার নীরব ঘাতক

ছবি: সংগৃহীত

রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া আমাদের দেহের একটি জীবনরক্ষাকারী ব্যবস্থা। কোনো কারণে দেহ কেটে গেলে বা রক্তক্ষরণ হলে এ প্রক্রিয়া সক্রিয় হয়ে রক্তপাত বন্ধ করে। এ জটিল প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এক ধরনের প্রোটিন, ফাইব্রিনোজেন। যখন এ ফাইব্রিনোজেনের পরিমাণ রক্তে স্বাভাবিকের চেয়ে অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়, তখন সেই অবস্থাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, হাইপোফাইব্রিনোজেনেমিয়া। এটি একটি বিরল কিন্তু গুরুতর রক্তরোগ, যা অকারণে বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। বিস্তারিত লিখেছেন ডা. মো. কামরুজ্জামান

* ফাইব্রিনোজেন কী

ফাইব্রিনোজেন হলো একটি প্রোটিন, যা মূলত আমাদের লিভারে তৈরি হয়। এটি রক্ত জমাট বাঁধার চূড়ান্ত ধাপে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। যখন রক্তক্ষরণ হয়, তখন জমাট বাঁধার অন্য ফ্যাক্টরগুলো একটি ক্যাসকেডের মাধ্যমে সক্রিয় হয়ে শেষ পর্যন্ত থ্রোম্বিন নামক এনজাইম তৈরি করে। এ থ্রোম্বিন ফাইব্রিনোজেনকে ফাইব্রিন-এ রূপান্তরিত করে। ফাইব্রিন অদৃশ্য সুতার মতো একটি জাল তৈরি করে, যা অণুচক্রিকাগুলোকে (প্লেটলেট) ধরে রাখে এবং একটি শক্তিশালী ক্লট বা থ্রম্বাস গঠন করে, ফলে রক্তপাত বন্ধ হয়। তাই, ফাইব্রিনোজেন ছাড়া কার্যকরীভাবে রক্ত জমাট বাঁধা অসম্ভব।

হাইপোফাইব্রিনোজেনেমিয়া হতে পারে দুভাবে : জন্মগত (Congenital) বা অর্জিত (Acquired)।

* জন্মগত হাইপোফাইব্রিনোজেনেমিয়া

এটি একটি বিরল জেনেটিক বা বংশাণুগত রোগ, যা পিতা-মাতা থেকে সন্তানের মধ্যে হয়। এখানে লিভার ফাইব্রিনোজেন তৈরি করতে অক্ষম হয় বা খুবই অল্প পরিমাণে তৈরি করে। এর মধ্যে আরও কয়েকটি উপপ্রকার আছে-

▶ আফাইব্রিনোজেনেমিয়া : এতে রক্তে ফাইব্রিনোজেনের মাত্রা প্রায় শূন্য হয়ে যায়। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক।

▶ হাইপোফাইব্রিনোজেনেমিয়া : এতে ফাইব্রিনোজেনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে, কিন্তু সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থাকে না।

* অর্জিত হাইপোফাইব্রিনোজেনেমিয়া

এটি বেশি সাধারণ এবং অন্যান্য রোগ বা অবস্থার কারণে দেখা দেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :

▶ ডিসেমিনেটেড ইন্ট্রাভাসকুলার কোয়াগুলোপ্যাথি (ডিআইসি) : এটি সবচেয়ে কমন কারণ। ডিআইসিতে শরীরজুড়ে অস্বাভাবিকভাবে ছোট ছোট রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে, যা ফাইব্রিনোজেনসহ অন্যান্য ক্লটিং ফ্যাক্টর নিঃশেষ করে ফেলে, ফলে মারাত্মক রক্তপাত হয়। সেপসিস, ক্যানসার, গর্ভকালীন জটিলতা (যেমন প্লাসেন্টা প্রিভিয়া) ইত্যাদি ডিআইসির কারণ।

▶ লিভারের গুরুতর রোগ : যকৃতের (লিভার) গুরুতর রোগ যেমন সিরোসিস, ফুলমিন্যান্ট হেপাটাইটিস ইত্যাদিতে ফাইব্রিনোজেন উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়।

▶ অতিরিক্ত রক্তপাত : কোনো বড় অপারেশন বা গুরুতর আঘাতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে দেহের সব ফাইব্রিনোজেন ব্যবহৃত হয়ে তার মাত্রা কমে যেতে পারে।

▶ থ্রম্বোলাইটিক থেরাপি : হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কিছু ওষুধ (যেমন : PA) রক্ত জমাট গলিয়ে দিতে দেয়, যা ফাইব্রিনোজেন ভেঙে ফেলে।

▶ কোনো কোনো ধরনের লিউকেমিয়া বা ক্যানসার।

* হাইপোফাইব্রিনোজেনেমিয়ার লক্ষণ

লক্ষণগুলো ফাইব্রিনোজেনের মাত্রার ওপর নির্ভর করে। মাত্রা যত কম হবে, লক্ষণ ততই গুরুতর হবে।

▶ অকারণে বা স্বতঃস্ফূর্ত রক্তপাত : সামান্য আঘাতেই দীর্ঘ সময় ধরে রক্তপাত হওয়া।

▶ মাড়ি বা নাক থেকে রক্ত পড়া।

▶ ত্বকে সহজেই ছোট ছোট লাল দাগ (পেটেকিয়া) বা বড় কালশিটে দাগ (ইকাইমোসিস) দেখা দেওয়া।

▶ পেশি বা জয়েন্টে রক্তক্ষরণ (হেমারথ্রোসিস) যা ব্যথা ও ফোলাভাব তৈরি করে।

▶ অস্ত্রোপচার বা দাঁত তোলার পর নিয়ন্ত্রণহীন রক্তপাত।

▶ মহিলাদের মধ্যে অতিরিক্ত বা দীর্ঘস্থায়ী ঋতুস্রাব (মেনোরেজিয়া)।

▶ জন্মগত ক্ষেত্রে নাভির কর্ড থেকে রক্তপাত হতে দেখা যায়।

▶ ডিআইসির মতো জটিল অবস্থায় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ (যেমন কিডনি, মস্তিষ্ক) ফেইলিউর পর্যন্ত হতে পারে।

* রোগ নির্ণয়

সন্দেহ হলে চিকিৎসক বেশ কয়েকটি রক্ত পরীক্ষার উপদেশ দেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ফাইব্রিনোজেন লেভেল পরিমাপ। এ ছাড়াও PT, APTT, Thrombin Time (TT)-এর মতো পরীক্ষাগুলো সাধারণত অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ হয়।

* চিকিৎসা

চিকিৎসা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে রোগের কারণ ও তীব্রতার ওপর।

▶ অর্জিত হাইপোফাইব্রিনোজেনেমিয়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিক লক্ষ হলো রোগীকে চিকিৎসা করা। যেমন, ডিআইসি হলে তার চিকিৎসা, লিভারের রোগ হলে তার ব্যবস্থাপনা।

▶ ফাইব্রিনোজেন প্রতিস্থাপন : রক্তপাত রোধ বা অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতি হিসাবে সরাসরি ফাইব্রিনোজেন সরবরাহ করা হয়। এটি সাধারণত দেওয়া হয়-

▶ ক্রায়োপ্রেসিপিটেট : এটি রক্তের একটি ঘনীভূত অংশ যাতে ফাইব্রিনোজেন, ফ্যাক্টর VIII এবং অন্যান্য প্রোটিন থাকে।

▶ ফাইব্রিনোজেন কনসেন্ট্রেট : এটি হলো বিশুদ্ধ ফাইব্রিনোজেনের পাউডার, যা স্যালাইনের সঙ্গে মিশিয়ে ইনফিউশন দেওয়া হয়। এটি জন্মগত রোগীদের প্রথম পছন্দ।

* সতর্কতা

জন্মগত হাইপোফাইব্রিনোজেনেমিয়া যাদের আছে, তাদের কোনো অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ওষুধ (যেমন অ্যাসপিরিন, আইবোপ্রোফেন সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে, কারণ এগুলো রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়ায়। তাদের কোনো অস্ত্রোপচার বা দাঁতের চিকিৎসার আগে চিকিৎসককে অবশ্যই জানাতে হবে। গর্ভাবস্থায় ফাইব্রিনোজেনের মাত্রা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু যদি কমে যায়, তবে তা মা ও শিশু উভয়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। এটি গর্ভপাত, প্লাসেন্টা বিচ্ছিন্নতা (abruption) এবং প্রসবোত্তর অতিরিক্ত রক্তপাতের (PPH)-এর আশঙ্কা থাকে। তাই গর্ভবতীর নিয়মিত প্রসবপূর্ব চেকআপের অংশ হিসাবে রক্ত পরীক্ষা করা জরুরি।

* পরিশেষে

হাইপোফাইব্রিনোজেনেমিয়া একটি গুরুতর মেডিকেল কন্ডিশন, যা অগোচরেই থেকে যেতে পারে যতক্ষণ না কোনো বড় আঘাত, অস্ত্রোপচার বা রক্তপাতের ঘটনা ঘটে। সময়মতো শনাক্তকরণ ও যথাযথ চিকিৎসা জীবন বাঁচাতে পারে। যাদের পরিবারে এ ধরনের রক্তরোগের ইতিহাস আছে বা যারা অস্বাভাবিক ও দীর্ঘস্থায়ী রক্তপাতের অভিজ্ঞতা রাখেন, তাদের দেরি না করে হেমাটোলজিস্টের (রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ)-এর পরামর্শ নেওয়া উচিত। সচেতনতাই হলো এ বিরল রোগ মোকাবিলার প্রথম ও প্রধান ধাপ।

লেখক : ইউনিট প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক, হেমাটোলজি বিভাগ ও বিএমটি ইউনিট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম