Logo
Logo
×

শেষ পাতা

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

অ্যানথ্রাক্সে আতঙ্ক নয় সতর্ক থাকতে হবে

প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠছেন প্রায় সবাই * আক্রান্তের লক্ষণ দেখলেই যেতে হবে নিকটস্থ হাসপাতালে * সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়; উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে রয়েছে অ্যান্টিবায়োটিকসহ পর্যাপ্ত ওষুধ

Icon

শিপন হাবীব (ঢাকা) ও মাহবুব রহমান (রংপুর)

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অ্যানথ্রাক্সে আতঙ্ক নয় সতর্ক থাকতে হবে

ফাইল ছবি

দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা রংপুরে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত অনেকে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন। অ্যানথ্রাক্স মোকাবিলায় সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে এর চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকসহ পর্যাপ্ত ওষুধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তাই তারা আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। আক্রান্ত গবাদিপশু তথা গরু ছাগল মহিষ জবাই না করা এবং আক্রান্ত পশুর মাংস না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। অ্যানথ্রাক্সের লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালের চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। ইতোমধ্যে ১১ জনের শরীরে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। এদিকে, পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্স আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসাবে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু করেছে।

পীরগাছা উপজেলার অন্তরাম বড়বাড়ির বাসিন্দা আবুল কাশেম (৫৫) বলেন, প্রথমে বুঝতে পারিনি এটি অ্যানথ্রাক্স রোগ। শরীরের বিভিন্ন অংশে কালো দাগ ও ক্ষত তৈরি হয়ে সেখানে পচন শুরু হয়। এরপর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিই। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. তানভীর হাসনাত রবিন চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র লিখে দেন। প্রতিদিন প্রায় তিন প্রকারের ওষুধ খেতে হয়েছে দুই মাস ধরে। আবুল কাশেম জানান, তার নিজের পালিত একটি ছাগল অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হলে তিনি এটাকে বাড়িতে জবাই করে মাংস খান। এভাবে তিনি সংক্রমিত হয়েছেন।

একই গ্রামের বাসিন্দা দুলাল মিয়া (৩৫) জানান, তার একটি গরু ওই রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করে দেড় মাস পর তিনি সুস্থ হয়েছেন। ওই গ্রামের প্রতিবেশী সাবিনা বেগম (২৫) অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত হয়েছেন তার পালিত গরু থেকে। গরুটি অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত ছিল, তিনি বুঝতে পারেননি। তিনিও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন। আক্রান্তরা বলেন, চিকিৎসক তাদের অ্যান্টিবায়োটিকসহ দুই প্রকার ওষুধ দিয়েছিলেন।

মিঠাপুকুরের আমাইপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক (৪০) অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত একটি গরু নিজের হাতে জবাই করে মাংস বানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, গরুটি আমরা কয়েকজন মিলে কেটেছিলাম। তারপর আমার হাতে কয়েক জায়গায় ফুলে ওঠে, হালকা জ্বর অনুভব হয়। আমি প্রতিবেশী সোহরাব আলীকে আমার বিষয়ে জানাই। তারও একই অবস্থা। এভাবে মনির হোসেন (৫৫) ও মজিবর মিস্ত্রির (৪৮) কাছে গেলে তাদেরও শরীরে একই উপসর্গ দেখতে পাই। পরে আমরা চিকিৎসকের কাছে গেলে এটি অ্যানথ্রাক্স রোগ বলে জানান। আমাইপুর গ্রামে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা দিয়েছে নয়জনের। তারা হলেন-সোহরাব আলী (৪৭), আব্দুর রাজ্জাক (৪৩), নাছিমা বেগম (৪০), মনির হোসেন (৫৫), জাহাঙ্গীর ইসলাম (৩৫), আব্দুর রহিম (৪৫), শফিকুল ইসলাম (৪৫), মজিবর রহমান (৫৫), মৌসুমী বেগম (২৬)। একই গ্রামে এই মানুষগুলোর শরীরে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা দেওয়ায় এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। কারণ ওই আক্রান্ত গরুর মাংস গ্রামের অনেক মানুষই খেয়েছেন।

ইমাদপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম বলেন, আমাইপুর গ্রামে অ্যানথ্রাক্স উপসর্গ নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। আমি গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা (রোগ নিয়ন্ত্রণ) এমএ হালিম লাবলু বলেন, ওই গ্রামে যাদের আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে পাঁচজনের শরীরে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা দিয়েছিল। তাদের নমুনা সংগ্রহের পর পরীক্ষায় একজনের অ্যানথ্রাক্স পজিটিভ পাওয়া গেছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের যুগান্তরকে বলেন, অ্যানথ্রাক্সের বিষয়ে আমরা সতর্কাবস্থানে আছি। স্থানীয়ভাবে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, প্রশাসন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখছে। সচেতনতা সৃষ্টি করছে। ভ্যাকসিন প্রদান করা হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ডিজি সার্বক্ষণিক বিষয়টি দেখছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, টিম এলাকায় পাঠানো হচ্ছে। আতঙ্কের কিছু নেই, সবাইকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থানে থাকতে হবে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরামর্শক ডা. মুশতাক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, অ্যানথ্রাক্স মানুষের জন্য ভয়ংকর কিংবা প্রাণঘাতী রোগ নয়। তবে গবাদিপশুর বেলায় এটি খুবই ভয়াবহ রোগ। অ্যানথ্রাক্স আমাদের দেশে নতুন নয়, পুরাতন রোগ। আতঙ্ক নয়, সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকতে হবে। কোনো পশু-পাখি, হাঁস-মুরগি তথা গবাদিপশু অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হলে ওই পশুকে গভীর মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে-আক্রান্ত গবাদিপশু ও পাখি কোনোক্রমেই জবাই করা যাবে না। জবাই করা মাংস ফ্রিজে রাখা, খাওয়া যাবে না। এককথায় ধরাছোঁয়া থেকে দূরে থাকতে হবে।

ডা. মুশতাক হোসেন আরও বলেন, পশু আক্রান্ত হলেই এলাকার মানুষ জবাই দিতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সস্তায় মাংস বিক্রির হিড়িক পড়ে। সাধারণ মানুষ সস্তায় বেশি করে মাংস কিনে ফ্রিজে সংরক্ষণ করেন। এমন বিষয়গুলো বন্ধ করতে পারলে মানুষ অ্যানথ্রাক্স থেকে বেঁচে যাবে। তাছাড়া আমরা তো নিজেরাই অ্যানথ্রাক্সের টিকা তৈরি করি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট সবাইকে সর্বোচ্চ সজাগ থাকতে হবে। কোনো পশু আক্রান্ত হলে ওই পশুর নির্ধারিত স্থান থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় সব পশুকে অ্যানথ্রাক্স ভ্যাকসিন প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি বলেন, সতর্কতা অবলম্বন করলে অ্যানথ্রাক্স রোগ থেকে সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে। নিজেদের মধ্যে লক্ষণ দেখামাত্রই স্থানীয় হাসপাতালে চলে যেতে হবে। যথাযথ চিকিৎসায় অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। যারা মাংস কাটার শ্রমিক তাদের নিয়মিতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। তাদের শরীরে, চামড়ায় কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কি না। অ্যানথ্রাক্স শুধু রংপুর নয়, প্রতিবছর সিরাজগঞ্জ-মেহেরপুর এলাকায়ও দেখা যায়। অ্যানথ্রাক্স জীবাণুর আবরণটি খুবই শক্ত। এটি মাটির নিচে হোক, ওপরে হোক বহু বছর পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে। আগুনে পোড়া হলে ওই জীবাণুর বিনাশ হয়।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো. আবু সুফিয়ান যুগান্তরকে বলেন, আতঙ্কিত না হয়ে সবাই মিলে সমস্যার সমাধান করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই আক্রান্ত পশু-পাখি জবাই করা যাবে না। আর কোনো মানুষ যদি আক্রান্ত হয়, দ্রুত সময়ের মধ্যে স্থানীয় হাসপাতালের চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। আক্রান্ত এলাকায় আমরা চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ টিম পাঠাচ্ছি। ইতোমধ্যে ১ লাখ ৭০ হাজার ভ্যাকসিন প্রদান করা হয়েছে। আমরা আরও টিকা দিচ্ছি। মানুষকে সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত একটি পশু বা পাখিকে মাটির নিচে পুঁতে রাখলেও সেই জীবাণু প্রায় ৭০ বছর পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে।

এদিকে রংপুর জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন রুহুল আমিন জানান, প্রতিটি উপজেলাকে সতর্ক করা আছে এবং অ্যানথ্রাক্স চিকিৎসার গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে। এটার জন্য যে অ্যান্টিবায়োটিক বা চিকিৎসাব্যবস্থা, সেটাও পর্যাপ্ত আছে। অ্যানথ্রাক্স রোগ বাংলায় তড়কা রোগ নামে পরিচিত। এটি তীব্র ও গুরুতর সংক্রামক রোগ। ব্যাসিলাস অ্যান্থ্রাসিস ব্যাকটেরিয়ার কারণে এ রোগ শরীরে বাসা বাঁধে।

এদিকে পীরগাছা (রংপুর) প্রতিনিধি জানান, পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্স আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসাবে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু করেছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন হাট-বাজারে জবাইখানা বা কসাইখানায় পশু জবাইয়ের আগে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছে। অ্যানথ্রাক্স/তড়কা সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ, উঠান বৈঠক, পথসভা কর্মসূচি চলমান রেখেছে উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ।

তিন প্রকার অ্যানথ্রাক্স রোগের লক্ষণ : ত্বকের অ্যানথ্রাক্স (কিউটেনিয়াস অ্যানথ্রাক্স)-চুলকানিযুক্ত ছোট ফোসকা দেখা দেয়। পরে একটি ব্যথাহীন কালো ঘা হয়। হাতে, মুখে বা কাঁধের চামড়ায় কালো দাগ হয়।

ফুসফুসের অ্যানথ্রাক্স (ইনহেলেশনাল অ্যানথ্রাক্স) : জ্বর, ঘাম, বমি বমি ভাব, শ্বাসকষ্ট, অস্থিরতা, বুকে ব্যথা এবং কাশি।

অন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স : বমি বমি ভাব, বমি। ডায়রিয়া এবং পেটে ব্যথা। হালকা জ্বর, মাংসপেশিতে ব্যথা, গলা ব্যথা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম