Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

মনের সুস্থতাকেও গুরুত্ব দিতে হবে

Icon

ডা. আনিস আহমেদ

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মনের সুস্থতাকেও গুরুত্ব দিতে হবে

প্রতিবছর ১০ অক্টোবর যখন বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হয়, তখন উন্নত বিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশেও এ আলোচনার ঢেউ লাগে। বিশ্বজুড়ে মানসিক সুস্থতার গুরুত্ব নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে এবং মানসিক অসুস্থতার কারণে সৃষ্ট সামাজিক কুসংস্কার দূর করতে এই দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মতো জনবহুল এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল দেশে এ দিবসটির তাৎপর্য আরও গভীর। এখানে মানসিক স্বাস্থ্য শুধু একটি স্বাস্থ্যগত বিষয় নয়, বরং এটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চ্যালেঞ্জের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্য এবং বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ (প্রায় ১৭ শতাংশ বা প্রায় ৩ কোটি মানুষ) কোনো না কোনো ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বা রোগে ভুগছেন। এদের মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বেগজনিত সমস্যা, সিজোফ্রেনিয়া এবং শিশু-কিশোরদের মধ্যে আচরণগত সমস্যা (Conduct Disorder) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এই বিপুলসংখ্যক মানুষের তুলনায় আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো অত্যন্ত অপ্রতুল। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী ও কাউন্সেলরের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। অধিকাংশ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এখনো রাজধানী বা বিভাগীয় শহরকেন্দ্রিক। ফলে গ্রামাঞ্চলের মানুষ, যারা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে, তারা কার্যত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত থাকেন। এছাড়া আমাদের দেশে মানসিক রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হলো চিকিৎসার খরচ এবং সহজলভ্যতার অভাব। অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং মানসিক স্বাস্থ্যবিমার অনুপস্থিতির কারণে অনেক পরিবার চাইলেও তাদের প্রিয়জনের সঠিক চিকিৎসা করাতে পারে না।

সামাজিক কুসংস্কার ও কুসংস্কারের বোঝা : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সমাজের গভীরে প্রোথিত কুসংস্কার (Stigma) এবং ভুল ধারণা। মানসিক অসুস্থতাকে এখনো অনেকে ‘পাগলামি’, ‘ভূতের আছর’ বা ‘পূর্বজন্মের পাপের ফল’ হিসাবে গণ্য করেন। এই কুসংস্কারের কারণে যে সমস্যাগুলো এখনো বিদ্যমান তা হলো :

১. মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে বা চাকরি হারানোর আশঙ্কায় তাদের কষ্টের কথা গোপন রাখেন এবং পেশাদার সাহায্য নিতে ভয় পান। ২. অনেকে মানসিক রোগের চিকিৎসা না করে কবিরাজ, ঝাড়-ফুঁক বা অপচিকিৎসার আশ্রয় নেন, যা রোগীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা আরও খারাপ করে তোলে। ৩. অনেক পরিবার মানসিক রোগীকে বোঝা মনে করে অবহেলা করে, যা রোগীর আরোগ্যের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এই কুসংস্কার এমন এক অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি করে, যা রোগী ও সঠিক চিকিৎসার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস আমাদের এই দেওয়াল ভাঙার সুযোগ করে দেয়।

দেশের প্রেক্ষাপটে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কারণগুলো বেশ জটিল। যেমন-১. শিক্ষাঙ্গনের চাপ : প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা, ভালো ফল করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং বাবা-মায়ের অতিরিক্ত প্রত্যাশা শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে চরম মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। ২. কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ : দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, কাজের অতিরিক্ত চাপ, কর্মীদের প্রতি কর্তৃপক্ষের অসংবেদনশীলতা এবং হয়রানি (বুলিং) কর্মজীবী মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা ও উদ্বেগের হার বাড়াচ্ছে। ৩. দারিদ্র্য ও অসমতা : দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং সামাজিক অসমতা মানুষের মনে গভীর হতাশা ও মানসিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। ৪. ডিজিটাল আসক্তি : ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং সাইবার হয়রানি তরুণ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য কেবল একটি দিনের সচেতনতা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সরকারের, বেসরকারি সংস্থাগুলোর এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদি ও সমন্বিত উদ্যোগ। যেমন-১. প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্তিকরণ : মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে গ্রাম পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, যাতে সাধারণ চিকিৎসকরাও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রাথমিক ধারণা পান এবং প্রয়োজনে রোগীকে বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করতে পারেন। ২. সচেতনতা ও কুসংস্কার দূরীকরণ : গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রচার করতে হবে।

মানসিক স্বাস্থ্যকে দুর্বলতা নয়, বরং স্বাস্থ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে তুলে ধরতে হবে। ৩. কর্মী ও বাজেট বৃদ্ধি : মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো এবং বিশেষজ্ঞ মনোবিজ্ঞানী ও কাউন্সেলরের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি করার জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে জোর দিতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রগুলোতে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা উচিত। ৪. আইন ও নীতি প্রণয়ন : মানসিক স্বাস্থ্য আইন ২০১৮-এর সঠিক বাস্তবায়ন এবং কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ কমানোর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন করা জরুরি।

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসাবে কাজ করতে পারে। এই দিনে আমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে, আমরা শুধু শারীরিক সুস্থতাকে নয়, বরং মনের সুস্থতাকেও সমান গুরুত্ব দেব। সমাজের প্রতিটি স্তরে সহানুভূতি ও সমর্থন নিশ্চিত করার মাধ্যমেই শুধু মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নামক এই নীরব মহামারির মোকাবিলা করা সম্ভব।

ডা. আনিস আহমেদ : মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও প্রাবন্ধিক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম