Logo
Logo
×

অর্থনীতি

সাক্ষাৎকার

লক্ষ্য এখন ডিজিটাল লেনদেনকে আরও সহজ করা ও খরচ কমানো

ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওমর ফারুক খাঁন

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:২৮ এএম

লক্ষ্য এখন ডিজিটাল লেনদেনকে আরও সহজ করা ও খরচ কমানো

ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওমর ফারুক খাঁন।

যুগান্তর : দেশে ক্যাশলেস লেনদেন বাস্তবায়নে কী কী উদ্যোগ নিচ্ছেন?

মো. ওমর ফারুক খাঁন : আমরা ক্যাশলেস বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্যাশলেস লেনদেনের প্রসারে সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করে যাচ্ছি। আমাদের নিজস্ব ডিজিটাল পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম-সেলফিন, আই-ব্যাংকিং অ্যাপ ও এমক্যাশ আপগ্রেড করছি। এমক্যাশকে ইতোমধ্যে ইন্টারঅপারেবল সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে, ফলে গ্রাহকরা ক্যাশ-আউট ছাড়াই অন্য যে কোনো মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসে সহজে টাকা পাঠাতে পারছেন। সরকারি ফি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফি এমনকি বড় করপোরেট পেমেন্টগুলো ডিজিটাল চ্যানেলে আনার জন্য আমরা নিয়মিত সমঝোতা চুক্তি করছি। মাস্টারকার্ডের সহযোগিতায় বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ইতোমধ্যে পূর্ণাঙ্গ ক্যাশলেস ক্যাম্পাস হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে ক্যাফেটেরিয়া, লাইব্রেরি ও অ্যাডমিন অফিস সব জায়গায় বাংলা কিউআরভিত্তিক ডিজিটাল লেনদেন সম্ভব হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় আমরা রোড শো, সেমিনার আর প্রদর্শনীর আয়োজন করেছি যাতে সাধারণ মানুষ কিউআর, কার্ড এবং ডিজিটাল ওয়ালেট ব্যবহারে আরও আÍবিশ্বাসী হয়। এসব উদ্যোগ মিলেই ২০২৭ সালের জুলাইয়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ক্যাশলেস ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার জাতীয় লক্ষ্যকে এগিয়ে নিচ্ছে।

যুগান্তর : ভারত, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের মতো বিদেশি অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হচ্ছে কিনা?

মো. ওমর ফারুক খাঁন : বাংলাদেশ বিদেশি অভিজ্ঞতা ব্যবহার করছে কিন্তু নিজের বাস্তবতা মেনে। ভারত, শ্রীলংকা আর পাকিস্তান—তিন দেশের দিকেই আমরা নজর রাখছি, কারণ প্রতিটি দেশই নিজেদের মতো করে সফল একটি মডেল তৈরি করেছে। ভারতের ইউপিআই আমাদের জন্য বড় শেখার জায়গা। রিয়েল-টাইম ইন্টারব্যাংক ট্রান্সফার, মোবাইল ওয়ালেট ইন্টারঅপারেবিলিটি আর একীভ‚ত কিউআর সবই ‘ন্যাশনাল ডিজিটাল পেমেন্টস রোডম্যাপ ২০২২-২০২৫’-এ রেফারেন্স হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এখান থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আমরা বিনিময়কে আরও শক্তিশালী করার দিকে হাঁটছি, যাতে দেশের ভেতরেও ইউপিআই-এর মতো সিমলেস লেনদেন সম্ভব হয়। শ্রীলংকার অভিজ্ঞতাও কাজে এসেছে। ছোট অর্থনীতিতেও কীভাবে একটি একীভ‚ত কিউআর কোড সিস্টেম চালু করা যায় লঙ্কা কিউআর তার একটি উদাহরণ। আমরা বাংলা কিউআর-কে সেই পথ ধরে আরও বিস্তৃত করছি, যেন শহর-গ্রাম নির্বিশেষে সবাই একই কোড ব্যবহার করতে পারে। পাকিস্তানের রাষ্ট্র আমাদের আরেকটা শিক্ষা দেয়—কম খরচে দ্রুত পিটুপি ও মার্চেন্ট পেমেন্ট কীভাবে জনপ্রিয় করা যায়। বাংলাদেশও বিইএফটিএন/আরটিজিএস আরও সহজ ও ব্যয়সাশ্রয়ী করার পথে আছে। বিশেষ করে লো-কস্ট ডিজিটাল ট্রানজেকশনের মডেলটিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং বলা যায়, অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হচ্ছে। কিন্তু অন্ধ নকল নয়। লক্ষ্য একটাই—নগদ নির্ভরতা কমিয়ে সবার জন্য সহজ, দ্রুত, নিরাপদ ডিজিটাল লেনদেন তৈরি করা।

যুগান্তর : ভারতে ক্যাশলেস পেমেন্ট সফল হওয়ার অন্যতম কারণ হলো সেখানে পিটুপি ট্রান্সফার ও অধিকাংশ কিউআর লেনদেনে কোনো চার্জ নেই। পাকিস্তানে পিটুপি ট্রান্সফারে কোনো খরচ নেই। এসব ফলো করা হচ্ছে কিনা?

মো. ওমর ফারুক খাঁন : ভারতে ক্যাশলেস পেমেন্ট দ্রুত জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল পিটুপি ট্রান্সফার আর বেশির ভাগ কিউআর লেনদেন সম্পূর্ণ ফ্রি রাখা। পাকিস্তানও একই পথ নিয়েছে। ওদের সিস্টেমে পিটুপি লেনদেনে কোনো চার্জ নেই। এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কি সেই মডেল ফলো করছে? আমি বলব, আমরাও একই মডেল অনুসরণ করতে পারি। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সম্প্রতি সময়ে এক নির্দেশনায় ইন্টারঅপারেবিলিটির চার্জ সর্বোচ্চ কত হবে তা নির্ধারণ করে দিয়েছে। যেমন এমএফএস থেকে ব্যাংকে চার্জ হাজার টাকায় সর্বোচ্চ ৮.৫০ টাকা, ব্যাংক থেকে এমএফএস-এ হাজার টাকায় সর্বোচ্চ ১.৫০ টাকা। এখানে সর্বোচ্চ চার্জই নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যাংক কিংবা এমএফএস প্রদানকারী চাইলে ফি কম বা শূন্য রাখতে পারে। ফি শুধু প্রেরক পক্ষকে দিতে হবে, প্রাপকের থেকে কোনো চার্জ নেওয়া যাবে না। এছাড়া মার্চেন্টদের জন্যও আলাদা কোনো চার্জ নেই। এখতিয়ার সার্ভিস প্রোভাইডরদের। তারা নিজেদের সক্ষমতা, সেবার মান ও বাজার প্রতিযোগিতায় চার্জ ধাপে ধাপে কমাবে। সরল কথায়, আমরা বিদেশি অভিজ্ঞতা নিচ্ছি, কিন্তু ভারত বা পাকিস্তানের মতো পুরোপুরি ফ্রি মডেলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। এখানকার লক্ষ্য ধীরে ধীরে খরচ কমানো এবং ডিজিটাল লেনদেনকে আরও সহজ করা। 

যুগান্তর : সেবার মান ও নিরবচ্ছিন্ন কার্যকারিতার জন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে? 

মো. ওমর ফারুক খাঁন : ক্যাশলেস ইকোসিস্টেম টিকিয়ে রাখতে হলে শুধু অ্যাপ চালু করলেই হয় না—বিশ্বস্ত, নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিতে হবে। আমাদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম সেলফিন, আই-ব্যাংকিং ও এমক্যাশে সেবার মান বৃদ্ধি ও নিরবচ্ছিন্ন কার্যকারিতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সেলফিনের সহজ ও দ্রুত ব্যবহারের সুবিধার কারণে বর্তমানে ৫৭ লাখ গ্রাহক দৈনিক ৪০০ কোটি টাকা লেনদেন করছেন। এছাড়া ১৩ লাখ গ্রাহক এমক্যাশ ব্যবহার করছেন যার মধ্যে ৩ লাখ নারী। আমরা সেলফিন অ্যাপকে একটি মাল্টিফাংশনাল অ্যাপে পরিণত করছি, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারী ব্যাংকের প্রায় সব কাজ ঘরে বসেই হাতের স্পর্শে সম্পন্ন করতে পারেন। ১৩.৯০ টাকায় এমক্যাশ থেকে ক্যাশ আউট করার ব্যবস্থা করেছি। ওয়েব-বেজড রেমিট্যান্সের পিন ব্যবহার করে এমক্যাশে রেমিট্যান্স সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছি। এমক্যাশ থেকে অন্যান্য এমএফএস ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ফান্ড ট্রান্সফার সুবিধা চালু করেছি। আমাদের লক্ষ্য গ্রাহকদের হাতে এমন ব্যাংকিং সুবিধা পৌঁছে দেওয়া, যাতে তারা শাখায় না গিয়েও লেনদেন সম্পন্ন করতে পারেন। দেশের প্রথম জেনারেটিভ এআই-চালিত ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট—সেলফিন ইকো আমরা চালু করেছি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট আগামীতে ব্যাংকিং সেবাকে অনন্য শিখরে নিয়ে যাবে। গ্রাহকের ভয়েস কমান্ডে পরিচালিত হবে ব্যাংকে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম। এছাড়া শিগগিরই শুধু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ঘরে বসেই অ্যাকাউন্ট খোলা, বিনিয়োগের কিস্তি আদায় ও বিনিয়োগ আবেদন প্রক্রিয়া চালু করতে যাচ্ছি। 

যুগান্তর : মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস), ইন্টারনেট ব্যাংকিং, কার্ড পেমেন্ট ও অন্যান্য ডিজিটাল চ্যানেলের কী কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে? 

মো. ওমর ফারুক খাঁন : মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, কার্ড পেমেন্ট সব ক্ষেত্রেই অগ্রগতি ভালো, কিন্তু চ্যালেঞ্জও কম নয়। এমএফএসে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো নেটওয়ার্ক নির্ভরতা আর এজেন্টভিত্তিক অপারেশন। ব্যস্ত সময়ে লেনদেন আটকে যাওয়া, ওটিপি দেরি করে আসা কিংবা অ্যাপের প্রতিনিয়ত আপডেট—এগুলো ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতাকে দুর্বল করে। ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাঝুঁকি বেশি। ফিশিং লিংক, নকল ওয়েবসাইট আর অপর্যাপ্ত সাইবার সচেতনতা এখনো বড় বাধা। কার্ড পেমেন্টে সমস্যাটা অন্য জায়গায়—যেমন পিওএস টার্মিনালের অভাব, ব্যাংকভেদে আলাদা চার্জ আর আন্তর্জাতিক কার্ডে জটিল ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া। এসবের বাইরে সব ডিজিটাল চ্যানেলের আরেকটি সাধারণ চ্যালেঞ্জ হলো সিস্টেমের স্কেলিং। উৎসব বা বেতন—সময়ের চাপ সামলাতে অনেক প্ল্যাটফর্ম এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। ফলে নির্বিঘ্ন সেবা নিশ্চিত করা এবং গ্রাহকের আস্থা ধরে রাখা এখনো বড় পরীক্ষা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম