এসএমই খাতে আধুনিক প্রযুক্তির প্রবাহ আটকা ৫ প্রতিবন্ধকতায়
কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা
প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫, ০৭:১৮ পিএম
প্রতীকী ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশের ১ কোটি ১৮ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) উদ্যোক্তার ৯০ শতাংশই ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। নিজের মোবাইল ফোন থেকে কিংবা প্রতিষ্ঠানে কোনো না কোনোভাবে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অংশই উন্নত প্রযুক্তি ও ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)’ ব্যবহারের বাইরে রয়েছে।
কেন এসএমই খাত প্রযুক্তি এবং এআই ব্যবহারে পিছিয়ে- যুগান্তরের অনুসন্ধানে পাঁচটি প্রতিবন্ধকতা বেরিয়ে এসে খুঁজে পাওয়া গেছে। সেগুলো হচ্ছে-অজ্ঞতা (প্রযুক্তিগত) ও প্রশিক্ষণের অভাব, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে উচ্চ ব্যয় (বিনিয়োগ), ভাষাগত সীমাবদ্ধতা (সফটওয়্যারের ভাষা ইংরেজি), ডিজিটাল অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা (মফস্বলে) এবং নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহারে অনীহা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য গবেষণা দরকার হলেও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এখাতে খুব বেশি টাকা খরচ করছে না। বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫ শতাংশ এবং এসএমই খাতে ১-২ শতাংশ গবেষণা খাতে ব্যয় করছে। এটি শঙ্কা তৈরি করছে এসএমই খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৮২ শতাংশ উদ্যোক্তা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন নন, আর ৬৬ শতাংশ জানেন না কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকস বা আইওটি ব্যবসায় কাজে লাগতে পারে।
তবে প্রযুক্তির ছোঁয়া ও এআইর ব্যবহার হলে বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এসএমই খাতের অবদান যেখানে ৩০ শতাংশ আছে, সেটি আরও বেড়ে যেত। বিশ্বব্যাংকের ভিন্ন একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, এসএমই খাতে প্রযুক্তির ঘাটতিতে প্রতিবছর ৩-৫ শতাংশ উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে।
এদিকে এসএমই খাতে প্রযুক্তি ব্যবহারে নীতিগত সহায়তাও খুব কম। জাতীয় ‘এসএমই নীতিতে’ প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়নের কথা থাকলেও বাস্তবে তা ভিন্ন। উদ্যোক্তারা জানেন না কী প্রযুক্তি প্রয়োজন, কোথায় পাবেন, কীভাবে শুরু করবেন। এছাড়া প্রযুক্তি ব্যবহার আরও কঠিন হয়ে গেছে কারণ আইসিটির ২৭ খাত করমুক্ত থাকলেও চলতি অর্থবছরে তা ১৯-এ নেমেছে। কর-ভ্যাটের অভাব এবং অব্যাহতির সংকোচন প্রযুক্তি খাতে অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিয়েছে।
ডিজিটাল অবকাঠামো তৈরিতে দাতা সংস্থার কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। সেটি পাওয়া গেলে এসএসই খাতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে জানান, ডিজিটাল অবকাঠামো তৈরিতে দাতা সংস্থার কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। সেটি পাওয়া গেলে এসএসই খাতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এসএমই খাতের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ খাত উন্নয়নে প্রযুক্তির ব্যবহারকে আরও প্রাধান্য দিতে হবে। তাহলে অর্থনীতিতে আরও ভূমিকা রাখতে পারবে এসএমই।
প্রসঙ্গত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) শব্দটি যতটা ছোট, এর গভীরতা অনেক বেশি। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সংক্ষিপ্ত রূপ হলো এআই। সফটওয়্যারের মাধ্যমে এটি ব্যবহারে মানুষের মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করে উন্নত থেকে উন্নত পরিসরে নেওয়া যায়। এসএমই খাতে এআই ব্যবহার ছোট পরিসরে কিছুটা শুরু হলেও বড় অংশ এর বাইরে রয়েছে। এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মুসফিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এআই-এর সম্পৃক্ততা বাড়াতে ছোট ব্যবহারের ওপর উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ে উদ্যোক্তাদের ভেতর এক ধরনের ভয় কাজ করে, যা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অনেকটা দূর হচ্ছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এসএমই খাতের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ খাত উন্নয়নে প্রযুক্তির ব্যবহারকে আরও প্রাধান্য দিতে হবে। তাহলে অর্থনীতিতে আরও ভূমিকা রাখতে পারবে এসএমই
আদিলুর রহমান খান
বৈশ্বিক এসএমই খাতে প্রযুক্তি ও এআই ব্যবহারের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইউরোস্ট্যাটের তথ্যমতে-ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোয় ক্ষুদ্র শিল্পে ১১.২১ শতাংশ এবং মাঝারি শিল্পে ২০.২৯ শতাংশ এআই ব্যবহার হচ্ছে। ডেনমার্ক সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। তাদের হার ২৭.৫৮ শতাংশ, বেলজিয়ামে ২৪.৭১ শতাংশ, রোমানিয়ার মতো দেশেও ৩.০৭ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে এআই। এছাড়া থাইল্যান্ডে ৪০ শতাংশ এসএমই এরই মধ্যে আইওটি ও স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় ডিজিটাল স্কিলস প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ‘এন্টারপ্রাইজ সার্ভে’ অনুযায়ী, দেশে মাত্র ১২% এসএমই ডিজিটাল টুল ব্যবহার করছে। তা-ও শুধু বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমিত। গ্রাম ও শহরতলির বেশির ভাগ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এখনো রয়ে গেছেন পুরনো পদ্ধতির মধ্যে।
প্রযুক্তির ব্যবহার দেখতে ২৩ মে সরেজমিন দুটি এসএমই প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করা হয়। ওইদিন দুপুর ১২টা, বেশ গরম বাতাসের প্রবাহ ছিল। ঢাকার পশ্চিমের শেষপ্রান্তে হাজারীবাগ বেড়িবাঁধসংলগ্ন ‘ঢাকা মোটরস’ ওয়ার্কশপে কর্মীদের ব্যস্ত সময় চলছে। ভেতরের একপাশে চারজন কর্মী টয়োটা নোয়াহ গাড়ির ইঞ্জিন খুলে বের করতে গলদ্ঘর্ম হচ্ছেন। ওয়ার্কশপটি বেশ পুরোনো। লোকাল এবং এনালগ (প্রযুক্তিবিহীন) ভিত্তিতে পরিচালনা করছেন তাহের উদ্দিন।
সড়কের ঠিক অপর পাশে (৩৮২/বি ঝাউচর, হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ বাসস্ট্যান্ড আরএস সিএনজি ফিলিং স্টেশনসংলগ্ন) বিশাল শেডের নিচে ‘এআর মোটরস’ চারটি অত্যাধুনিক লিফট স্থাপন করে কয়েকজন কর্মী দিয়ে কাজ করছেন খায়রুল এনাম। তিনি জানান, প্রযুক্তি আমার অপচয় কমিয়েছে, মান ঠিক রেখেছে, আর সেবাগ্রহীতাদের বুঝতে শিখিয়েছে। এতে আমার ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধিও ভালো হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মধ্যে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর ওয়ার্কশপ দুটির মধ্যে একটি তার। তার মতে, এসএমই উদ্যোক্তাদের একটি বড় অংশ এখনো প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার থেকে দূরে থাকলেও যারা এগিয়ে গেছেন, তারা পেয়েছেন উৎপাদনশীলতা, অর্থ সাশ্রয় এবং সম্প্রসারণের সুযোগ।
দুটি ওয়ার্কশপের মধ্যে গুণগত পার্থক্য হচ্ছে-একটি প্রযুক্তির মাধ্যমে পুরোপুরি পরিচালিত, অপরটি প্রযুক্তিবিহীন লোকালভাবে পরিচালিত।
অবশ্য বাংলাদেশ সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) গবেষণা মতে, যারা প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, তাদের বিক্রি ও সেবা বেড়েছে গড়ে ১৭ শতাংশ।
আমাদের প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে। বিশেষ করে এআই ব্যবহার করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ভালো সুযোগ রয়েছে
ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর
এদিকে এসএমই খাতে কিছু প্রতিষ্ঠানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়া পড়তে শুরু করেছে। এসএমই খাত ‘কিফিয়া টেকনোলজি একটি ‘ক্রেডিট স্কোরিং পদ্ধতি’ নিয়ে এসেছে। এআই-এর মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করে এসএমই খাতে নারীদের জামানতবিহীন ঋণ দিতে এ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারবে ব্যাংকগুলো। এআই প্রযুক্তি দিয়ে এসএমই খাতের নারী উদ্যোক্তাদের আর্থিক সক্ষমতা, জামানত ও গ্যারান্টির স্কোর নির্ধারণ করা হবে। এটি উদ্বোধন করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আমাদের প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে। বিশেষ করে এআই ব্যবহার করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ভালো সুযোগ রয়েছে।
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান কিফিয়া ফাইন্যান্সিয়াল টেকনোলজির সিইও মুনির দুরি বলেন, এসএমই উদ্যোক্তাদের জামানতবিহীন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক (এআই) ঋণমান নির্ধারণ পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এতে নারী উদ্যোক্তারা উপকৃত হবেন। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো জামানত, গ্যারান্টি ও আর্থিক রেকর্ডের ওপর নির্ভরশীল। এসব শর্ত পূরণ করতে না পারায় ঋণ পেতে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় নারী উদ্যোক্তাদের। সে সমস্যা অনেকটা কেটে যাবে।
বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরী যুগান্তরকে বলেন, এশিয়ান মিরাকল দেশ হিসাবে খ্যাত চীন, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, জাপান-এসব দেশের অর্থনীতির ডায়নামিক খাত হচ্ছে এসএমই। তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করেই এগিয়ে যাচ্ছে। এখন রোবট, এআই-এসব উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার না করলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। ফলে এসএমই খাতে প্রযুক্তিকে অবহেলা করা যাবে না
সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরী যুগান্তরকে বলেন, এশিয়ান মিরাকল দেশ হিসাবে খ্যাত চীন, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, জাপান-এসব দেশের অর্থনীতির ডায়নামিক খাত হচ্ছে এসএমই। তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করেই এগিয়ে যাচ্ছে। এখন রোবট, এআই-এসব উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার না করলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। ফলে এসএমই খাতে প্রযুক্তিকে অবহেলা করা যাবে না।
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনোয়ার হোসেন চৌধুরী মনে করেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মার্কেটিংয়ে কিছুটা এআই ব্যবহার হচ্ছে। কিছু প্লাস্টিক শিল্প এআই ব্যবহার শুরু করেছে। সেভাবে ফাউন্ডেশন থেকে প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে।

