অবশেষে সমঝোতায় পৌঁছাল বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র
পণ্য রপ্তানিতে ২০% শুল্ক
৭ আগস্ট থেকে নতুন হার কার্যকর * যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই; তবে ২০ শতাংশের নিচে প্রত্যাশা করেছিলাম-বাণিজ্য উপদেষ্টা
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অবশেষে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছেছে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের বড় অর্থনৈতিক অংশীদারের সঙ্গে মাসব্যাপী চলা অচলাবস্থার অবসান হলো। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশে ২০ শতাংশ শুল্কের নতুন হার ঘোষণা করেছে। সর্বশেষ বাংলাদেশকে চিঠি দিয়ে ৩৫ শতাংশ পালটা শুল্কের কথা জানিয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। এরপর তৃতীয় দফা বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক ১৫ শতাংশ কমিয়ে নতুন হার ঘোষণা করা হলো, যা কার্যকর হবে ৭ আগস্ট থেকে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঐতিহাসিক এই বাণিজ্য চুক্তির প্রশংসা করে বলেছেন, এটি আমাদের কূটনৈতিক অঙ্গনে একটি উল্লেখযোগ্য বিজয়। প্রসঙ্গত, ট্রাম্প আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ও বিশ্ব অর্থনীতি পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান অংশীদারদের ওপর শুল্ক আরোপ করেছেন। এরই মধ্যে বাংলাদেশের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং ভিয়েতনামসহ অনেক দেশের সঙ্গে শুল্ক চুক্তি করেছেন ট্রাম্প।
ট্রাম্পের নতুন শুল্কহারের নির্বাহী আদেশ হোয়াইট হাউজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ ছাড়াও কয়েক ডজন দেশের ওপর মার্কিন শুল্কের হার তুলে ধরা হয়েছে। অন্য দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের ওপর ১৯ শতাংশ, আফগানিস্তান ১৫, ভারত ২৫, ব্রাজিল ১০, ইন্দোনেশিয়া ১৯, মালয়েশিয়া ১৯, আলজেরিয়া ৩০, মিয়ানমার ৪০, ফিলিপাইন ১৯, শ্রীলংকা ২০, ক্যামেরুন ১৫ এবং ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ওয়াশিংটন।
পালটা শুল্ক ইস্যুতে দরকষাকষির নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। শুক্রবার সকাল ৭টায় যোগাযোগ করলে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে তিনি যুগান্তরকে বলেন, আজ নতুন করে ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপের বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানাবেন। তবে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। সবকিছু ফলপ্রসূ হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা জানান, ‘বাণিজ্য উপদেষ্টা তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় আমরা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় থাকব। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে আমরা ২০ শতাংশের নিচে প্রত্যাশা করেছিলাম।’
এদিকে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বলেছেন, ‘আজ আমরা সম্ভাব্য ৩৫ শতাংশ পালটা শুল্ক এড়াতে সফল হয়েছি। এটা আমাদের পোশাক খাত এবং এ খাতের ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ মানুষের জন্য সুসংবাদ।’ তৃতীয় দফার আলোচনা শেষে ১৫ শতাংশ কমিয়ে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রতিক্রিয়ায় এ কথা বলেন খলিলুর রহমান। বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আমাদের পোশাকশিল্পকে সুরক্ষা দেওয়া ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তবে আমরা মার্কিন কৃষিপণ্য কেনার প্রতিশ্রুতিতেও গুরুত্ব দিয়েছি। এতে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্য পূরণে সহায়তা মিলবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপ্রধান অঙ্গরাজ্যগুলোর সঙ্গে সদ্ভাব গড়ে উঠবে। আমরা আমাদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতাও ধরে রেখেছি এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভোক্তাবাজারে প্রবেশের নতুন সুযোগ তৈরি করেছি।’ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি থেকে দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ড. খলিলুর রহমানের এসব কথা উল্লেখ করা হয়। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
গত বছর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য ছিল ১০ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র পণ্য আমদানি হয়েছে ৮.৪ বিলিয়ন ডলার। এই ঘাটতিই হলো ট্রাম্পের মূল পয়েন্ট। তিনি বলেছেন, এই বাণিজ্য সম্পর্কের মানে হলো যুক্তরাষ্ট্র ক্ষতির শিকার হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বড় ধরনের শুল্ক আরোপ হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হতো তৈরি পোশাকশিল্প। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে যেসব পণ্য কিনছে এর ৮০ শতাংশ হচ্ছে তৈরি পোশাক।
বাংলাদেশ বলেছে, আমেরিকান বোয়িং কোম্পানি থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনা হবে। দেশটি থেকে বছরে ৭ লাখ টন গম আমদানির জন্য সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এছাড়া সয়াবিন, তেলবীজ, ডাল, চিনি, বার্লি, এলএনজি ও সামরিক সরঞ্জাম আমদানির মাধ্যমে বছরে বাণিজ্য ঘাটতি দেড় বিলিয়ন বা ১৫০ কোটি ডলার কমিয়ে আনার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক প্রায় শতভাগ প্রত্যাহারের পক্ষেও সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এর আগে চলতি বাজেটে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত ৬২৬টি পণ্যে শুল্ক ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে ১১০টি পণ্যের আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের অন্য নেতারা নতুন চুক্তিকে সতর্কতার সঙ্গে স্বাগত জানিয়েছেন। যদিও আগের চেয়ে উচ্চ হারে শুল্ক বাণিজ্যকে ব্যয়বহুল ও চ্যালেঞ্জিং করে তুলবে। কারণ, বর্তমান ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানি করছেন দেশের উদ্যোক্তারা। ৭ আগস্ট থেকে নতুন করে ২০ শতাংশ হার কার্যকর হলে সবমিলে মোট শুল্কহার দাঁড়াবে ৩৫ শতাংশ।
ওয়াশিংটন ডিসির বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা বলেছেন, বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপে একটি স্বস্তিদায়ক অবস্থায় আছে। কারণ প্রতিযোগী দেশ-ভিয়েতনাম ও ভারতসহ অন্য দেশগুলোর সঙ্গে টিকে থাকতে সমস্যা হবে না। তবে বাংলাদেশের প্রত্যাশা ছিল শুল্কহার আরও কমাবে; কিন্তু সেটি হয়নি। বাংলাদেশ বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে।
২ এপ্রিল বাণিজ্য ঘাটতির কথা উল্লেখ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর উচ্চ হারে পালটা শুল্ক আরোপ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তখন বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। পরে ৯ এপ্রিল বিভিন্ন দেশের ওপর ওই শুল্ক ৩ মাসের জন্য স্থগিত করা হয়। এ সময় শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন দেশকে আলোচনার সুযোগ দেয় ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের ৩ মাসের সময়সীমা ৯ জুলাই শেষ হয়। এর আগের দিন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়ে ট্রাম্প জানান, বাংলাদেশের পালটা শুল্ক ২ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও ৯ জুলাইয়ের পর পালটা শুল্ক কার্যকর করেনি মার্কিন প্রশাসন। শুল্কের হার কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তির জন্য ৩১ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন দেশকে সময় দেওয়া হয়। সেই সময়সীমা শেষে আজ (১ আগস্ট) থেকে নতুন শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা। সে হিসাবে আজ থেকে বাংলাদেশকে বর্তমানের গড় ১৫ শতাংশ এবং নতুন পালটা শুল্ক ২০ শতাংশ, অর্থাৎ মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করতে হবে। পালটা শুল্ক নিয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছে। শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে টানা ৩ দিন আলোচনা করেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। মঙ্গল ও বুধবারের পর বৃহস্পতিবার তৃতীয় দিনের মতো আলোচনা করা হয়। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। এছাড়াও দলে ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী।
পালটা শুল্ক কার্যকরে নতুন সময়সূচি : নতুন ঘোষণা অনুযায়ী, ৭ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ হারে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক কার্যকর হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া সর্বশেষ নির্বাহী আদেশে বিভিন্ন দেশের ওপর আরোপিত নতুন শুল্কহার কার্যকর হওয়ার এ সময়সূচিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর আগে ট্রাম্প ১ আগস্টের মধ্যে বাণিজ্যচুক্তি সম্পন্ন করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। তখন তিনি বলে দিয়েছিলেন, এ সময়ের মধ্যে চুক্তিতে না পৌঁছালে চড়া শুল্ক আরোপ করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বৃহস্পতিবার নতুন নির্বাহী আদেশে ৭০টির বেশি দেশের ওপর নতুন পালটা শুল্কহার ঘোষণা করেছেন। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সেগুলো ৭ দিনের মধ্যে কার্যকর হবে। যেসব পণ্য ৭ আগস্টের মধ্যে জাহাজে তোলা হবে বা বর্তমানে যাত্রাপথে রয়েছে এবং সেগুলো যদি ৫ অক্টোবরের আগে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে যায়, তবে সেগুলোর ক্ষেত্রে শুল্ক প্রযোজ্য হবে না।
রপ্তানি কমতে পারে ৩৫ শতাংশ: আনোয়ার উল আলম চৌধুরী
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ মনে করেন, ২০ শতাংশ শুল্ক বাংলাদেশের প্রতিযোগী সক্ষমতা হয়তো ধরে রাখবে; কিন্তু এ বর্ধিত শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চাহিদা কমে যাবে। তখন বাংলাদেশের গার্মেন্ট মালিকদের মধ্যে টিকে থাকার অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। তিনি বলেন, ২০ শতাংশ শুল্কের কারণে বাংলাদেশে প্রতিযোগী সক্ষমতা টিকে থাকবে। প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা যাবে। কিন্তু এই বাড়তি শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের চাহিদা কমে যাবে প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশ। এটি যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকদের তথ্য। এ কারণে আগামী এক-দেড় বছরে যুক্তরাষ্ট্রে এক্সপোর্ট কমবে। রপ্তানি কমলে বিদেশি ক্রেতা ও ব্র্যান্ড বাংলাদেশকে পণ্যের দাম কমাতে চাপ দেবে। তখন বাংলাদেশি উৎপাদকদের মধ্যেই অসম প্রতিযোগিতা দেখা দেবে। সরকারের উচিত হবে, যারা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কাজ করে, তাদের কীভাবে ফিন্যান্সিয়ালি একটু সাপোর্ট দেওয়া যায়, সেটা খুঁজে বের করা।
উৎপাদন খরচ কমিয়ে এনে সহায়তা করা সম্ভব হলেও সেই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না-এমন মন্তব্য করে পারভেজ বলেন, দেশে উৎপাদন খরচ কমানোর সম্ভাবনা নেই। কেউ এ বিষয় নিয়ে চিন্তাও করে না। উদাহরণস্বরূপ, কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই পোর্ট চার্জ বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার কনটেইনার জট কমাতে পোর্টে ১৫ শতাংশ কম জাহাজ আনার কথা শুনছি। এ কারণে জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাবে। এটা (পোর্ট চার্জ) কমালে আমরা অন্য দেশের তুলনায় উপকৃত হব, এটি কেউ ভাবছে না। মূল্যস্ফীতি কমানোর চিন্তা করে ব্যাংক ঋণের সুদ বাড়ানো হলো, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খরচ ৩ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হলো-এসব নিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে বর্তমান সরকারকেও চিন্তা করতে দেখছি না।
লেখক : সভাপতি, বিসিআই
পোশাকশিল্পের জন্য আপাতত স্বস্তিদায়ক: মাহমুদ হাসান খান
যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক শুল্ক নিয়ে পোশাকশিল্পের মালিকরা অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলেন। গত দুই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা অর্ডার স্থগিত রাখায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আরও বৃদ্ধি পায়। শেষ পর্যন্ত শুল্ক ৩৫ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে, যেটা আপাতত স্বস্তিদায়ক বললেন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান। তিনি বলেন, ২০ শতাংশ শুল্ক আপাতত স্বস্তিদায়ক এজন্য যে, প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের ট্যারিফ সমান। ভারতের তুলনায় আমাদের ট্যারিফ কম, পাকিস্তানের তুলনায় ১ শতাংশ বেশি। ভিয়েতনামের সমান, এটি বড় স্বস্তির জায়গা। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভিয়েতনামই বাংলাদেশের বড় প্রতিযোগী। যদি ট্যারিফ অন্যদের চেয়ে ১০-১৫ শতাংশ বেশি হতো, তাহলে আমরা প্রতিযোগী সক্ষমতায় থাকতে পারতাম না। তখন ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে পারত।
আপাতত স্বস্তিদায়ক বলার কারণ ব্যাখ্যা করে মাহমুদ হাসান খান বলেন, পৃথিবীর সব দেশের পণ্যের শুল্কহার বাড়ানো হলে সেটি ভোক্তার ওপর বর্তায়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য। দেশগুলোর ওপর গড়ে ২০ শতাংশ বাড়ানোয় স্বভাবতই পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। তখন বাজার কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, এর ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের অবস্থান। যদি যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা ক্রয় কমিয়ে ফেলেন, তবে চাহিদা কমে যাবে। তখন পণ্য রপ্তানিতেও এর প্রভাব পড়বে। তবে এ বিষয়ে এখনই সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না। এজন্য অপেক্ষা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, নতুন শুল্কহার চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা স্থগিত করে রাখা অর্ডারগুলো নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। বাংলাদেশের পোশাক খাতের গতিপ্রকৃতি নির্ভর করবে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের ওপর। অতিরিক্ত ২০ শতাংশ ট্যারিফের কারণে পোশাক যদি ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তখন ভোগ কমে যাবে। দিনশেষে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তার প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটার জন্য তো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক : সভাপতি, বিজিএমইএ
টিকে থাকতে পারলে লাভবান হবে বাংলাদেশ: ফজলে শামীম
বাড়তি শুল্কের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টিকে থাকতে পারলে বাংলাদেশ লাভবান হবে। দীর্ঘমেয়াদে চীন ও ভিয়েতনাম থেকে অর্ডার বাংলাদেশে স্থানান্তরের সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেন নিটপণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র চীন ছাড়া বাংলাদেশের অন্য প্রতিযোগী দেশগুলোর জন্য প্রায় সমান হারে শুল্ক নির্ধারণ করেছে, এটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা রক্ষা পেয়েছে।
তিনি বলেন, শুল্ক কমানোয় আমরা মার্কিন প্রশাসনকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই, যারা সব ধরনের অবাণিজ্যিক জটিল শর্ত এড়িয়ে একটি ন্যায্য এবং প্রায় সমতাভিত্তিক শুল্ক কাঠামো প্রণয়ন করেছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন টিমের অক্লান্ত প্রচেষ্টাও প্রশংসার দাবিদার। তাদের দক্ষতা ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞার জন্যই বাংলাদেশ অন্যান্য প্রধান পোশাক রপ্তানিকারক দেশেগুলোর সমান সুযোগ পেয়েছে। তবে এ সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য আমাদের উদ্যোক্তাদের আরও দক্ষ ও সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে পোশাকের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে মার্কিন ক্রেতাদের বোঝাতে হবে যে, আমদানি শুল্ক আমদানিকারকদের বহন করতে হয় এবং পরিশেষে এটি চূড়ান্তভাবে ভোক্তাকেই বহন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বাড়তি শুল্কের কারণে পণ্যের মূল্য কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে, যা বিক্রি হ্রাসের সম্ভাবনা তৈরি করবে। এ পরিস্থিতিতে অর্ডার কিছুটা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ক্রেতারা অন্যায্যভাবে দাম কমানোর চেষ্টা করতে পারেন। তবে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর জন্যও শুল্কের হার প্রায় একই রকম বা এর চেয়ে বেশি হওয়ায় এ মুহূর্তে শক্তিশালী দরকষাকষিই একমাত্র উপায়। কারণ, ক্রেতারা অন্য যে দেশেই যাক, তাদের কমপক্ষে আমাদের সমান শুল্ক দিতেই হবে। বরং আমাদের এখানে ক্রয়াদেশ দিলে চীন বা ভারত থেকে শুল্ক বিবেচনায় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। আমরা যদি বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টিকে থাকতে পারি, তবে ভবিষ্যতে চীন ও ভিয়েতনাম থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অর্ডার বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
লেখক : নির্বাহী সভাপতি, বিকেএমইএ
ব্র্যান্ড-বায়ারদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা উচিত: মাশরুর রিয়াজ
বাড়তি শুল্কের বোঝা শুধুই কি ভোক্তা বহন করবে, নাকি আমদানিকারকের দায়বদ্ধতা আছে-এ বিষয়ে এখনই যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ড ও বায়ারদের সঙ্গে পোশাকশিল্পের মালিকদের আলোচনায় বসা উচিত বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ। তা না হলে চাহিদা কমে নতুন ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। মাশরুর রিয়াজ বলেন, এই প্রাপ্তিকে (২০ শতাংশে নেমে আসা) স্বাগত জানাই। কেননা, দীর্ঘ ২ মাস আলোচনা করে আমরা শুধু ২ শতাংশ শুল্ক কমাতে সক্ষম হয়েছিলাম, যা ব্যাপক উদ্বেগ ও ঝুঁকির সৃষ্টি করেছিল। পরবর্তী সময়ে বাণিজ্য উপদেষ্টার নেতৃত্বে টিম আলোচনার মাধ্যম ২০ শতাংশে কমিয়ে আনতে পেরেছে। এক্ষেত্রে নেগোসিয়েশন টিমের প্রস্তুতি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
তিনি বলেন, ২০ শতাংশ শুল্ক ভালো না খারাপ-এখন এটা আলোচ্য বিষয়। যদি শুরুর দিকের ৩৭ শতাংশ শুল্ক ভিত্তি ধরা হয়, তাহলে ২০ শতাংশ শুল্ক ভালো। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ওভেন খাতে আমাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ভারত এবং ডেনিমে পাকিস্তান। এই সব দেশেরই শুল্কহার কাছাকাছি। তুলনামূলক বিশ্লেষণে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের জন্য অসুবিধাজনক কিছু হয়নি। কারণ, ভারতের শুল্ক বাংলাদেশের চেয়ে বেশি, ভিয়েতনাম বাংলাদেশের সমান। আর কম্বোডিয়া ও পাকিস্তানের এক শতাংশ কম। সুতরাং বাংলাদেশ প্রতিযোগী দেশগুলার তুলনায় প্রতিযোগিতার সক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে। তবে এই প্রাপ্তিতে একেবারে খুশি হওয়া বা হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। কারণ, স্থানীয়ভাবে ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের একটা শর্ত ছিল বলে আমরা জানতে পেরেছিলাম। এটি এখন বাংলাদেশের জন্য বড় ব্যাপার। কারণ, ওভেন খাতে বাংলাদেশ ৪০ শতাংশ ভ্যালু এডিশন করে না এবং যুক্তরাষ্ট্রে মোট রপ্তানির ৯০ শতাংশই ওভেন খাতের। সুতরাং সেই জায়গায় আমরা কোনো অসুবিধায় পড়ব কি না, এটি আরও একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে জানতে হবে।
তিনি আরও বলেন, শুল্ক বাড়লে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যের আমদানির ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। এ ব্যয়কে কীভাবে সমন্বয় করবে, সেটা বড় ব্যাপার। যদি ভোক্তার ওপর পুরো শুল্কের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে চাহিদা কমে যাবে। চাহিদা কমে গেলে বাংলাদেশের রপ্তানিও কমে যাবে। সুতরাং বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের এখনই বিদেশি ক্রেতা, আমদানিকারক ও ব্র্যান্ডের সঙ্গে কৌশলী আলোচনায় বসতে হবে। যাতে ২০ শতাংশ বাড়তি শুল্কের বোঝা সবাই বহন করে।
গোপনীয় শর্ত প্রকাশের আহ্বান জানিয়ে মাশরুর রিয়াজ বলেন, যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ট্যারিফ চুক্তি চূড়ান্ত হয়ে গেছে, সেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সরকার নন ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারে। কারণ, এই চুক্তির ভেতরে জাতীয় স্বার্থ বা সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের বিষয় আছে কি না, তা জনগণের জানা দরকার।
লেখক : নির্বাহী চেয়ারম্যান, পলিসি এক্সচেঞ্জ

