বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম। ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কেউ যদি জানতে চান, আমার বিবেচনায় পত্রিকা হিসাবে যুগান্তরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য কী, তাহলে নির্দ্বিধায় বলব-দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ পত্রিকার অবস্থান। প্রশাসনের উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে দেশের যেখানে যত ধরনের দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাটের ঘটনা ঘটছে-তা যুগান্তরে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয় সব সময়। যুগান্তরের এক সপ্তাহের লিড-নিউজগুলোর দিকে তাকালেই এর প্রমাণ মিলবে। আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে পত্রিকাটির এ শক্ত অবস্থান নেওয়ার পেছনে কাজ করছে যমুনা গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান ও যুগান্তরের স্বপ্নদ্রষ্টা নুরুল ইসলামের ইচ্ছা, তার নির্দেশনা। কোথায়, কোন্ প্রতিষ্ঠানে কী ধরনের অনিয়ম হচ্ছে, লুটপাট হচ্ছে, সেসব খুঁজে বের করে রিপোর্ট করার নির্দেশ দিতেন তিনি। আজও যুগান্তর সেই ধারা বজায় রেখেছে। এটিই যুগান্তরের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
দুর্নীতি এ দেশের এক নম্বর সমস্যা। প্রশাসন, সরকারি সংস্থা, বেসরকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ ও রাষ্ট্রের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে দুর্নীতি বাসা বাঁধেনি। ব্যবসার কথাই যদি বলি, এক্ষেত্রে জালিয়াতি, খেলাপি ঋণ, অর্থ পাচার এখন নিত্য ঘটনা। যমুনা গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম ছিলেন এসব থেকে মুক্ত। তাই তিনি হতে পেরেছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাই তিনি কাউকে ভয় পেতেন না, কাউকে পরোয়া করতেন না। তাই তিনি তার প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানটি তৈরি করে গেছেন।
তিনি ঋণখেলাপি ছিলেন না। তিনি অর্থ পাচার করেননি। স্বচ্ছতা ছিল তার ব্যবসায়িক জীবনের অন্যতম নিয়ামক। অথচ এর বিপরীতে আমরা দেখি এক শ্রেণির শিল্পমালিক বা ব্যবসায়ী কীভাবে ঋণের টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করছেন আর ঋণখেলাপি হয়ে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করছেন। সংবাদপত্রের পাতা ওলটালেই আজকাল এসব খবর চোখে পড়ে। গত কিছুদিন ধরে বিভিন্ন ঘটনা থেকে প্রকাশ পাচ্ছে দেশে দুর্নীতি কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। কদিন আগেও যাদের হাতে ছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশে আইনের প্রয়োগ ঘটানোর এখতিয়ার, তাদের নিজেদেরই অকল্পনীয় দুর্নীতির তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। একের পর এক বেরিয়ে আসছে বিভিন্ন ক্ষেত্রের অনিয়মের চিত্র; আর এসবের পেছনে যারা কলকাঠি নেড়েছে তাদের মুখাবয়ব।
এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ ও হতাশাগ্রস্ত সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে দেশের তরুণ সমাজ। তারা দেখছে সর্বত্র অনিয়ম; সৎ উপায়ে, স্বাভাবিক নিয়মে কোনো কাজই যেন সম্পাদন হয় না এদেশে। এ পটভূমিতে মনে হয়, একজন নুরুল ইসলাম, যিনি নিজ চেষ্টা ও দৃঢ় মনোবল দিয়ে দেশের একজন অন্যতম প্রধান শিল্পোদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছিলেন, তিনি হতে পারতেন তরুণদের আদর্শ।
আমার মনে হয়, একমাত্র তরুণরাই এ দেশকে ভয়াবহ দুর্নীতির রাহু থেকে মুক্ত করতে পারে। কারণ এজন্য যে সাহস, আত্মত্যাগী মনোভাব ও দৃঢ় সংকল্প প্রয়োজন, তা তরুণদের মাঝেই থাকা সম্ভব। শুধু তাদের সামনে থাকতে হবে দৃষ্টান্ত। আজকাল তরুণদের অনেকেই উদ্যোক্তা হচ্ছেন। তারা সৎভাবে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে চান। তারা যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা নুরুল ইসলামের জীবন থেকে শিখতে পারেন কীভাবে সৎ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সফল ব্যবসায়ী হওয়া সম্ভব।
নুরুল ইসলাম একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ছিলেন দুঃসাহসী ও কঠোর পরিশ্রমী শিল্পোদ্যোক্তা, বিশাল শিল্পগোষ্ঠী যমুনা গ্রুপের কর্ণধার। তিনি মাত্র ৪ দশকে গড়ে তুলেছেন ৪১টি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নের একজন আইকন তিনি। বেসরকারি শিল্প খাত আধুনিকায়নের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। অবশ্যই তিনি একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব।
অনেক দিন আগে মালয়েশিয়া সফরে গিয়ে দেখেছিলাম, রাস্তার পাশে বিভিন্ন স্থানে সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে দুটি শব্দ, যার অর্থ ‘আমরা পারি’। আধুনিক মালয়েশিয়া দেখিয়ে দিয়েছিল তারা নিজেরাই অনেক কিছু তৈরি করতে পারে এবং সে কথা তারা বড়াই করে বলত সাইনবোর্ডে লিখে রেখে। সে দেশে বন ও পর্বতের মাঝখানে গেনটিং হাইল্যান্ড বলে একটি স্থান আছে, যেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল এক থিম পার্ক। সেখানে একইসঙ্গে রয়েছে শপিংমল, বিভিন্ন রাইডসহ বিনোদন পার্ক ও হোটেল। যেন অন্যরকম এক জগৎ! তখন মনে হয়েছিল, আহা, বাংলাদেশেও যদি এমন একটি স্থান থাকত! ২০১৩ সালে আমাদের রাজধানী ঢাকার বারিধারা-কুড়িল এলাকায় যমুনা ফিউচার পার্ক যখন চালু হলো, তখন দেখলাম-আরে, এ তো অনেকটা গেনটিং হাইল্যান্ডের বিনোদন জগতের আদলে তৈরি!
আসলে এমন একটি স্থাপনা নির্মাণের জন্য সবার আগে যা প্রয়োজন, তা হলো স্বপ্ন, অনেক বড় স্বপ্ন। বিপুল অর্থবিত্ত অনেকেরই থাকে; কিন্তু তেমন স্বপ্ন থাকে কজনের? আবার সবার বা অনেকের কাছে যা অসম্ভব, কারও কারও কাছে সেটা সম্ভব। স্বপ্নকে সম্ভব করার সেই মানুষ ছিলেন যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা নুরুল ইসলাম। তিনি এ দেশে যে নজরকাড়া স্থাপনাটি নির্মাণ করে গেছেন, তার প্রতিষ্ঠিত আরও অনেক কিছুর মতো এটিও তাকে মনে রাখার জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
আসিফ রশীদ
উপসম্পাদক, যুগান্তর
