|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশের বিনোদন অঙ্গনে সাম্প্রতিক সময়ে একটি নতুন দুশ্চিন্তার নাম ইউটিউবভিত্তিক ‘ভুয়া সাক্ষাৎকার’। জনপ্রিয় তারকা কিংবা পরিচিত শিল্পীর নাম ব্যবহার করে অনেকে ক্লিকবেইট শিরোনাম বানিয়ে দিচ্ছে বিভ্রান্তিকর ভিডিও, যা দর্শকদের ভুল পথে পরিচালিত করছে। শুধু তাই নয়, এসব অসত্য কনটেন্টের কারণে শিল্পীদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আর বিনোদন সাংবাদিকতার প্রতি মানুষের আস্থা কমছে। বিস্তারিত রয়েছে এ প্রতিবেদনে।
ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও স্মার্ট ফোনের দুনিয়ায় এখন অনলাইনে আয় করার দ্বার খুলেছে। সহজ ও দ্রুত আয় করার বাসনা সবার মনে। এতে করে কনটেন্ট বানানোর দিকেই ঝুঁকছে তরুণ প্রজন্ম। এদিকে এ সুযোগের অপব্যবহারও হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একদল কনটেন্ট ক্রিয়েটর দ্রুত অর্থ আয়ের বাসনা থেকে ইউটিউবে গড়ে তুলেছেন তারকাদের ভুয়া ভিডিও সাক্ষাৎকারের বাজার। ট্রেন্ড বুঝে তারা ব্যবহার করছেন শিল্পীদের পুরোনো ভিডিও। এতে ক্লিকবেইট শিরোনাম করে দর্শকদের করছেন বিভ্রান্ত। বিষয়টি নিয়ে শিল্পীরা বিভিন্ন সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
শিল্পীরা অভিযোগ করে জানান, কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই তাদের পুরোনো ভিডিও, লাইভ বা টিভি সাক্ষাৎকার থেকে অংশ কেটে নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে নতুন ‘এক্সক্লুসিভ’। অনেক ক্ষেত্রে তারা কখনো বলেননি এমন বক্তব্যও শিরোনামে ব্যবহার করা হয়। কোনো সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত নেই, কোনো প্রশ্নোত্তর পর্ব নেই, তবু ভিডিওটি এমনভাবে সাজানো হয় যেন সেটি সাম্প্রতিক একটি রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার। দর্শকের নজর কাড়তে শিরোনাম হয় ‘অমুক তারকার চাঞ্চল্যকর স্বীকারোক্তি’, ‘তালাকের আসল কারণ ফাঁস করলেন অমুক নায়িকা’, ‘কান্নায় ভেঙে পড়লেন অমুক নায়ক’ ইত্যাদি। এসব শিরোনামের অধিকাংশই তারকার বাস্তব বক্তব্যের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না। তবুও দর্শক আগ্রহ নিয়ে ভিডিও খুলে দেখে, আর কনটেন্ট নির্মাতারা ভিউ থেকে আয় করে যায়।
ইউটিউবের এমন বিভ্রান্তিকর ভিডিও সাম্প্রতিক সময়ে অনেক আলোচনা তৈরি করেছে। কয়েকজন তারকা প্রকাশ্যেই ক্ষোভ জানিয়েছেন। কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, তারা যেন নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন! কারণ কোনো বিতর্ক বা গুজব ছড়ালেই দ্রুত কয়েকটি ইউটিউব চ্যানেল ওই বিষয়কে ঘিরে অসংখ্য ভুয়া ভিডিও আপলোড করে দেয়। এর ফলে তারকার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তৈরি হয় জটিলতা, দর্শকের মধ্যেও ছড়ায় ভুল ধারণা। অনেক সময় পরিবার-পরিজনের জন্যও বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। একটি ভিডিওতে বলা হলো ‘কেউ তালাক দিয়েছেন’, আরেকটিতে বলা হলো ‘তিনি সন্তানকে দেখেন না’-এসবই ক্লিকবেইটের অংশ। তারকাদের ভাষ্য, তাদের কোনো বক্তব্য যাচাই না করেই ইউটিউব চ্যানেলগুলো এসব সাজিয়ে বলে হাজারো মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়।
এদিকে শোবিজের যে কোনো অনুষ্ঠানে মূলধারার গণমাধ্যমের চেয়ে, ইউটিউব কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের উৎপাত বেশি লক্ষ করা যায়। এতে অনুষ্ঠানের শৃঙ্খলাও নষ্ট হয়। আয়োজকরা জানান, বিনা দাওয়াতেই এরা উপস্থিত হন। এসব অসুস্থ মনমানসিকতার ক্রিয়েটরদের কারণে তারকারাও এখন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে নিরাপদ মনে করেন না। কারণ, ক্রিয়েটররা সেখানে আপত্তিকরভাবে ভিডিও ধারণ করে। এমনকি তারকার অনুমতি ছাড়া এমন সব স্থির চিত্র ও ভিডিও নিয়ে রিল তৈরি করে সেসব ইউটিউব ও ফেসবুকে প্রকাশ করছেন, যা প্রকাশযোগ্য নয়। এতে শিল্পীরা পড়ছেন বেকায়দায়। অনলাইনের এ কন্টেন্ট নির্মাতারা কারও বিরক্তি বা আতঙ্কের কারণ হতো না, যদি তাদের একাংশ অধিক ভিউয়ের আশায় মিথ্যা তথ্য ও গুজব ছড়িয়ে শিল্পী ও সংবাদকর্মীদের ভাবমূর্তি নষ্ট না করত।
কয়েক বছর আগেই এক ইউটিউবারের সঙ্গে বাগ্যুদ্ধে জড়িয়েছিলেন প্রয়াত চিত্রনায়ক মান্নার স্ত্রী শেলী মান্না। কারণ ওই ইউটিউবার ‘এফডিসির দারোয়ানের হাতে মার খেয়েছিলেন মান্না’ এমন শিরোনামে একটি ভিডিও কন্টেন্ট নির্মাণ করে গুজব ছড়িয়েছিলেন। সময়ের ব্যস্ততম নায়ক শাকিব খান। তিনিও গুজব ছড়ানো এসব ইউটিউবারদের নামে একবার হামলা করার হুমকি দিয়েছিলেন। তিনি সেসময় বলেন, ‘অনেক হয়েছে ভিউজের ব্যবসা আর নয়।’ ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা মিমকে নিয়েও গতবছর জুলাই আন্দোলনের পর মিথ্যা এক ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভিডিওটিতে দাবি করা হয়েছে, তিনি একটি পার্লার উদ্বোধন করতে গিয়ে উগ্রবাদীদের আক্রমণের শিকার হন। সেসময় মিম জানান, এ তথ্য সম্পূর্ণ মিথ্যা।
ভিডিওটি পুরোনো একটি জুয়েলারি শোরুম উদ্বোধনের সময়ের। ওই অনুষ্ঠানে একটি ক্যামেরার বিস্ফোরণের কারণে জোরে শব্দ ও ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। এর ফলেই উপস্থিত ব্যক্তিরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ভিডিওটি নিয়ে একটি গোষ্ঠী মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করতে চেয়েছিল বলে অভিযোগ করেন মিম।
অভিনেত্রী বলেন, ‘একটি ভিডিওতে কাটছাঁট করে আমাকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা আমাকে বিব্রত করছে। মিথ্যা তথ্য প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা ঠিক নয়। যা ঘটেনি, তা নিয়ে আলোচনা বা ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া অন্যায়।'
এ ছাড়া এরকম করে অনেক শিল্পীদের হেয় করছেন কিছু ইউটিউবার। এ বিড়ম্বনায় পড়েছেন শোবিজের আরও একাধিক তারকা। সাম্প্রতিক সময়েই বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন আজমেরী হক বাঁধন, মেহজাবীন চৌধুরী, অপু বিশ্বাস, মিশা সওদাগর, মিষ্টি জান্নাত, মিথিলা, নাজনীন নিহাসহ অনেকেই। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়েই অনেক শিল্পী মুখ খুলেছেন।
অভিনেতা ওমর সানী এ প্রসঙ্গে ফেসবুকে এক পোস্টে ক্ষোভ ঝাড়েন। সেখানে তিনি লিখেন, ‘কতগুলো অথর্ব কানা বেয়াদব, ছাগল-পাগল যা ইচ্ছা বলছে ইউটিউবে, শুধু কয়েকটা ডলারের লোভে। সবাই নয় (শিল্পী ছাড়া আর কোনো সাবজেক্ট নেই)। সবাইকে ইতিবাচক হওয়ার অনুরোধ করছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব ইউটিউবাররা নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে শোবিজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেন। গণমাধ্যম কর্মীরাও তাদের উৎপাতে সঠিকভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। অনেক সময় ইউটিউবারদের আতঙ্কে সাংবাদিকদের বাইট দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন শিল্পীরা।
বিনোদন সাংবাদিকরা বলছেন, ইউটিউবারদের এসব কর্মকাণ্ডে আঘাত আসছে মূলধারার মিডিয়ার ওপর। পেশাদার সাংবাদিকতার যেখানে যাচাই-বাছাই, তথ্য নিশ্চিত করা এবং সম্পাদনার প্রক্রিয়া রয়েছে, সেখানে ইউটিউবের অসংখ্য চ্যানেল এসব নীতি মানে না। যে কেউ মোবাইল ফোনে সম্পাদনা সফটওয়্যার ব্যবহার করে চটজলদি বানিয়ে দেয় তথাকথিত সাক্ষাৎকার। এতে সাধারণ দর্শক ‘কোন ভিডিও সত্য আর কোনটি মিথ্যা’, তা বুঝতে না পেরে বিভ্রান্ত হয়। ফলে সর্বোপরি বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট দেখা দেয় পুরো বিনোদন সাংবাদিকতায়।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ভিউনির্ভর অর্থনৈতিক কাঠামোই এ অরাজকতার মূল কারণ। ইউটিউবে প্রচুর ভিউ হলে অর্থ আসে বিজ্ঞাপন থেকে। ফলে খুব দ্রুত ভিউ বাড়ানোর জন্য যারা সংবাদ বা বিনোদনের নামে ভিডিও বানাচ্ছেন, তারা তথ্যের সত্যতা বা নৈতিকতা নিয়ে একেবারেই ভাবেন না। ভিডিওর দৈর্ঘ্য, সাউন্ড, রিলেটেড ট্যাগ-সবকিছুর লক্ষ্য থাকে শুধু ভিউ বাড়ানো। ইউটিউবের পরামর্শ সিস্টেমও এ ভিডিওগুলোকে দর্শকদের সামনে এগিয়ে দেয়, ফলে জনপ্রিয়তার ছায়ায় ছড়িয়ে পড়ে অসত্য তথ্য। পেশাদার মিডিয়া হাউসের তৈরি কনটেন্টও অনেক সময় পেছনে পড়ে যায় এসব ক্লিকবেইট শিরোনামের ভিড়ে।
শিল্পী এবং সাংবাদিকদের একটি অংশ বলছেন, এখানে দর্শকের সচেতনতা প্রয়োজন। যাচাই না করে যেন কেউ ভিডিওর তথ্য বিশ্বাস না করে। শিল্পী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও ভুয়া সাক্ষাৎকারবিরোধী প্রচারণা চালানো দরকার। কারণ, সমস্যাটি শুধু তথ্য বিভ্রান্তি নয়, বরং শিল্পীর ব্যক্তিগত মর্যাদা, সম্মান ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এর বড় প্রভাব পড়ছে।
ইউটিউবে ভুয়া সাক্ষাৎকার এখন শুধু বিনোদন জগতের সমস্যা নয়, বরং সমগ্র তথ্য জগতের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর আঘাত। তারকারা যত বেশি জনপ্রিয় হচ্ছেন, তাদের নামে তৈরি মিথ্যা কনটেন্টও তত বেশি বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে। তাই এ পরিস্থিতি সামাল দিতে ইউটিউব প্ল্যাটফর্ম, সাংবাদিক, দর্শক ও শিল্পী-সবাইকেই একসঙ্গে সচেতন হতে হবে। অন্যথায় ক্লিকবেইটের স্রোতে সত্যিকারের সাংবাদিকতা হারিয়ে যাবে, আর তারকারা প্রতিদিনই নতুন নতুন ‘ভুয়া সাক্ষাৎকার’-এর মুখোমুখি হবেন।
