|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দপ্তরের টেবিল খালি, চেয়ার ধুলোয় ঢাকা, অথচ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমছে বেতন—এই চিত্র আর কল্পকাহিনি নয়, বাস্তবের প্রশাসনিক নষ্টামির এক মর্মস্পর্শী প্রতীক।
দুই বছর ধরে অফিসের চৌকাঠ না মাড়িয়েও প্রায় ৩৭ লাখ টাকার বেতন তুলেছেন ভারতের এক সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী, আর সেই ভুয়া হাজিরার অনুমোদন দিয়েছেন কর্মকর্তা নিজেই। এমন কাণ্ডে এখন চরম আলোড়ন দেখা দিয়েছে প্রশাসনিক অন্দরে।
তদন্তে জানা গেছে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের অধীন তথ্যপ্রযুক্তি দপ্তরের যুগ্ম অধিকর্তা পদে ছিলেন প্রদ্যুম্ন দীক্ষিত। সরকারি পদে থেকে তিনি দুই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান—ওরিয়নপ্রো সলিউশন্স ও ট্রিজেন সফটওয়ার লিমিটেডকে সরকারি টেন্ডার পাইয়ে দেন। এর বিনিময়ে তার স্ত্রী পুনম দীক্ষিতকে ওই সংস্থাগুলোর কর্মী হিসেবে দেখিয়ে বেতন চালানো হয়।
জানুয়ারি ২০১৯ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত পুনমের পাঁচটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে ৩৭ লাখ ৫৪ হাজার ৪০৫ টাকা, অথচ তিনি কখনোই অফিসে যাননি, কোনো কাজ করেননি, কোনো প্রকল্পে অংশ নেননি।
প্রদ্যুম্ন নিজেই স্বাক্ষর করেছেন স্ত্রীর উপস্থিতি রিপোর্টে—এ যেন সরকারি দপ্তরকে নিজের পরিবারের শেয়ার বাজারে পরিণত করার এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত।
তদন্তের নথি বলছে, ওরিয়নপ্রো পুনমকে দেখিয়েছে সংস্থার কর্মী হিসেবে, আর ট্রিজেন দেখিয়েছে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে। দুই দিক থেকেই নিয়মিত টাকা এসেছে। একই সময়ে দুই সংস্থার হাতে গেছে কোটি টাকার সরকারি প্রকল্প।
তদন্তকারীরা বলছেন, এটি মূলত ‘ঘুষের নতুন ফর্মুলা’ কাগজে-কলে বেতন, বাস্তবে প্রকল্পের বিনিময়ে অর্থ ফেরত। প্রদ্যুম্নের স্ত্রী কেবল নামেই কর্মী, কিন্তু বেতনটা এসেছে সরকারি চুক্তির আড়ালে। প্রশাসনের ভেতরে এমন সুচারু প্রতারণা চলতে পারে, তা সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারছে না।
এই ঘটনার সূত্রপাত হয় এক নাগরিকের পিটিশন থেকে। রাজ্য হাই কোর্ট সেই আবেদনের ভিত্তিতে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। তদন্ত শুরু হতেই বেরিয়ে আসে একের পর এক অস্বচ্ছ আর্থিক লেনদেনের চিত্র।
জানা যায়, প্রদ্যুম্ন দীক্ষিত নিজের প্রভাব ব্যবহার করে সরকারি নজরদারি ও নিরীক্ষা বিভাগকে পাশ কাটিয়ে এই অপকর্ম দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে গেছেন। এমনকি তদন্তের শুরুতে তিনিও এবং তাঁর স্ত্রী দুজনেই তদন্তকারীদের সামনে উপস্থিত হতে অস্বীকার করেন।
পরে যখন ডেকে পাঠানো হয়, তারা দায় চাপান “ভুল বোঝাবুঝি” ও “ব্যবস্থাগত বিভ্রান্তি”-র উপর। কিন্তু তদন্তকারী দল বলেছে, সমস্ত ব্যাংক ট্রানজ্যাকশন, ইমেল রেকর্ড, অনুমোদিত কাগজপত্র তাদের হাতে আছে—যা প্রমাণ করে এটি কোনো ভুল নয়, বরং সুপরিকল্পিত দুর্নীতির ফাঁদ।
প্রশাসনিক মহলে এই ঘটনার পর শুরু হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। বহু কর্মকর্তা বলছেন, এটি কেবল একজন অফিসারের অপরাধ নয়, বরং গোটা প্রশাসনিক কাঠামোর নৈতিক পতনের প্রতিচ্ছবি।
যেখানে দায়িত্বের পরিবর্তে সুবিধা, এবং ন্যায়ের জায়গায় ব্যক্তিস্বার্থ মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রীয় অর্থের উৎস হচ্ছে সাধারণ মানুষের করের টাকা, আর সেই টাকাই যদি এমনভাবে বেসরকারি চক্র ও প্রভাবশালী অফিসারদের পকেটে যায়, তবে জনগণ কীসের উপর আস্থা রাখবে?
তদন্তকারীরা বলছেন, দুই সংস্থা সরকারি টেন্ডার পেতে প্রদ্যুম্ন দীক্ষিতের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পেয়েছিল। ওই সময় তাঁর অনুমোদনে প্রকল্প অনুমোদন, আর্থিক ছাড়পত্র, এবং ফাইল অগ্রসর করার কাজ দ্রুত হয়। পরিবর্তে পুনম দীক্ষিতের নামে চলতে থাকে “কৃত্রিম বেতন প্রকল্প”। প্রশাসনের এক উচ্চপদস্থ সূত্রের ভাষায়, “এটি দুর্নীতির এমন এক পরিশীলিত রূপ, যেখানে ঘুষের টাকা সোজাসুজি দেওয়া হয় না, বরং চাকরির কাগজপত্রের মাধ্যমে বৈধ করে নেওয়া হয়।”
জনমনে ক্ষোভ এখন তীব্র। সামাজিক মাধ্যমে শুরু হয়েছে প্রশ্ন—যখন সাধারণ কর্মচারীকে সামান্য বিলম্বের জন্য চাকরি হারাতে হয়, তখন এমন প্রভাবশালী দম্পতি কীভাবে বছরের পর বছর আইন ভাঙতে পারে? এই এক ঘটনার মধ্যেই যেন ফুটে উঠেছে রাষ্ট্রযন্ত্রের সেই অন্ধকার মুখ, যেখানে ক্ষমতা মানেই ছাড়পত্র, আর আইন কেবল গরিবের জন্য কার্যকর। নাগরিকরা বলছেন, প্রশাসনের এই চেহারা বদলাতে না পারলে ভবিষ্যতে আর কেউ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে বিশ্বাস রাখতে পারবে না।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এ ধরনের দুর্নীতির প্রভাব কেবল রাজস্ব ক্ষতিই নয়, এটি রাষ্ট্রের নৈতিক দেউলিয়াপনার প্রতীক। সরকারি টেন্ডার ব্যবস্থার প্রতি ব্যবসায়িক আস্থাও ধাক্কা খায়।
এক বিশেষজ্ঞের ভাষায়, “যখন অফিসে না গিয়েও কেউ বেতন পায়, তখন সেটি শুধু আর্থিক প্রতারণা নয়, এটি কর্মসংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক নীরব হত্যাযজ্ঞ।”
তদন্ত চলছে, তবে এখনই স্পষ্ট—এই ঘটনা প্রশাসনিক স্বচ্ছতার অভাব ও নজরদারির ব্যর্থতার ফল। প্রদ্যুম্ন দীক্ষিতের মতো প্রভাবশালী কর্মকর্তারা যে কেবল নিজের জন্য নয়, পরিবারের জন্যও ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন, তা রাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলছে।
দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা জানিয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে এটি স্পষ্টভাবে “দায়িত্বের অপব্যবহার ও আর্থিক প্রতারণা”, এবং প্রমাণ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু জনমনে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে—আইনের জালে কি সত্যিই বড় মাছ ধরা পড়বে, না আবার কোনো অদৃশ্য প্রভাবে সবকিছু ধামাচাপা পড়ে যাবে?
দপ্তরের টেবিল খালি, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ভরা—এই দুইয়ের ফারাকটাই এখন রাষ্ট্রের চিত্র হয়ে উঠেছে। এমন এক সময়ে, যখন সাধারণ মানুষ মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধিতে জর্জরিত, তখন রাষ্ট্রীয় পদে থাকা ব্যক্তিরা যদি নিজেদের স্বার্থে জনগণের করের টাকা লুণ্ঠন করেন, তবে সেই সমাজে ন্যায়ের ভিত্তি আর কোথায়?
মানুষ দেখছে, দুর্নীতির এই গল্প এখন আর খবর নয়, এটি নিত্যদিনের বাস্তবতা, আর সেটাই সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়।
