ইহুদীবাদীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান ইরানের সুন্নি আলেমদের
প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৫, ১০:৩৩ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ইরান শিয়া-অধ্যুষিত দেশ হলেও এদেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সুন্নি মুসলমান বাস করেন। আনুমানিক ৮/১০ শতাংশ ইরানি সুন্নি মাজহাবের অনুসারী, যাদের প্রধান বসবাস সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলোতে বিশেষ করে সিস্তান–বেলুচিস্তান, কুর্দিস্তান, হরমুজগান, পশ্চিম আজারবাইজান, খোরাসান ও গিলান প্রদেশে।
সংবিধানে সুন্নিদের অধিকার
ইরানের সংবিধান অনুযায়ী সুন্নি মুসলমানরা শিয়াদের মতোই ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও আইনগত স্বাধীনতা ভোগ করে। সুন্নি অধ্যুষিত অঞ্চলে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত বিষয়ে সুন্নি ফিকহ (হানাফি/শাফেয়ি) অনুযায়ী বিচার করা হয়।
সংবিধানের ১২তম ধারায় বলা হয়েছে, ‘ইরানের সরকারি মাযহাব হলো ইসনা আশারিয়া (বারো ইমামি) মাজহাব। তবে হানাফি, শাফেয়ি, মালেকি এবং হাম্বলি মাজহাবসমূহ ইসলামি মাজহাব হিসাবে সম্মানিত এবং তাদের অনুসারীদের ব্যক্তিগত আইন (বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ইত্যাদি), ধর্মীয় অনুশাসন ও ধর্মীয় শিক্ষা স্বাধীনভাবে পালন করার অধিকার আছে।
আজ ইরানের উপর হামলা হয়েছে- আগামীকাল তা অন্য যে কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের ওপরও হতে পারে। কারণ, এই যুদ্ধ কেবল একটি ভূখণ্ড বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়-এটি একটি সভ্যতা, একটি দীন এবং একটি উম্মাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
অন্যদিকে, ধারা ১৯-এ লেখা হয়েছে, ‘ইরানি জনগণ, জাতি, গোষ্ঠী, ভাষা বা উপজাতি নির্বিশেষে আইনের দৃষ্টিতে সমান অধিকার রাখে।’
রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সুন্নিদের অংশগ্রহণ
ইরানের সংবিধানে সুন্নি মাজহাবের অধিকারের যে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে তার বাস্তবায়ন দেখা যায় সরকার ও প্রশাসনে। সংবিধান অনুযায়ী সুন্নি নেতারা সব নির্বাচনি এলাকা থেকে স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এবং ভোটে উন্নীত হতে পারেন। বর্তমানে ইরানে সাতজন সংসদ সদস্য সুন্নি মাজহাবের। শুধু তাই নয়, প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আব্দুল করিম হোসেইনজাদে। ইরানের সামরিক বাহিনী, বিশেষত সামরিক পুলিশ, সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও সেনাবাহিনীতেও সুন্নিদের নিয়োগ দেওয়া হয়।
শিয়া-সুন্নি ঐক্য ও ইরানের আদর্শিক অবস্থান
ইরানি নেতারা বারবার বলেছেন, শিয়া ও সুন্নিরা একই ইসলামি উম্মাহর অংশ। সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি নিজেও বহুবার বলেছেন : ‘শিয়া ও সুন্নি ভাই ভাই। বিভাজনের চেষ্টা শত্র“দের ষড়যন্ত্র।’
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতা মুসলমানদের ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। তিনি মুসলমানদেরকে নিজেদের ভেতরে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির জন্যে শত্র“দের মূল হাতিয়ার মাযহাবগত মতপার্থক্যের ফাঁদে পা দিতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ইসলামী মাযহাবগুলোর মাঝে মতানৈক্য সৃষ্টির পরিকল্পনা একটি মারাÍক অপরাধ, আর এই অপরাধের স্রষ্টা হলো তারাই যেসব পরাশক্তি ওই মতপার্ধক্য থেকে ফায়দা হাসিল করে। তারাই এই মতানৈক্যের বীজ মুসলমানদের মাঝে বপন করেছে এবং নিয়মিত তার গোড়ায় পানি ঢেলে পরিচর্যা করে যাচ্ছে। যারা এই বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে চায় তারা না আহলে সুন্নাতের না আহলে শিয়ার অন্তর্ভুক্ত। তারা হলো পরাশক্তিগুলোর মদদপুষ্ট সরকারের কর্মকর্তা।’
ইরানের পররাষ্ট্রনীতিতে মুসলিম ঐক্য
ইমাম খোমেনি (রহ.)-এর দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ইরানের বৈদেশিক নীতি তৈরি হয়েছে। এতে কেবল শিয়া সম্প্রদায়ের স্বার্থে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মুসলিম নিপীড়নের বিরুদ্ধে, মাজহাব নির্বিশেষে, তারা বহুবার সরব ও সক্রিয় ভূমিকা পালন। ফিলিস্তিনের সুন্নি প্রতিরোধ সংগঠন হামাস ও ইসলামিক জিহাদকে ইরান দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে।
১৯৯০-এর দশকে বসনিয়ার মুসলিমদের ওপর সার্ব বাহিনীর গণহত্যার সময় পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ইরান বসনিয়া সরকারকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও কূটনৈতিক সহায়তা দেয়। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের সময়ও ইরান জাতিসংঘ ও ওআইসি-তে জোরালো প্রতিবাদ জানায় এবং বাংলাদেশে আশ্রিত শরণার্থীদের জন্য মানবিক ত্রাণ পাঠায়।
আফগানিস্তানে তালেবান সরকার নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও, ইরান সেখানে কূটনৈতিক যোগাযোগ রক্ষা করেছে এবং বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। একইভাবে ইরাকে আইএসবিরোধী যুদ্ধে ইরান শুধু শিয়া নয়, সুন্নি গোষ্ঠীগুলোকেও সহায়তা করেছে। ইয়েমেন, লেবানন ও অন্যান্য দেশেও ইরান জাতীয় প্রতিরোধের অংশীদার হয়েছে, সেখানে শিয়া-সুন্নি উভয় গোষ্ঠীই ছিল।
এসব উদাহরণ প্রমাণ করে, ইরান মুসলিম নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মাজহাব নয়, বরং ন্যায় ও প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এটি তাদের পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
মূলত এসব কারণেই ইরানের সুন্নি জনগোষ্ঠী ধর্মীয় ও রাজনৈতিকভাবে শিয়াদের সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে সহনশীল ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আসছেন। তারা দেশপ্রেম, জাতীয় স্বার্থ ও ইসলামী মূল্যবোধে সমানভাবে বিশ্বাসী। বিশেষত ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং আমেরিকা ও ইসরাইলের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে বারবার তারা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
ইসরাইলি হামলার পর সুন্নি আলেমদের প্রতিক্রিয়া
গত ১৩ জুন ভোররাতে রাজধানী তেহরানসহ বেশ কয়েকটি শহরে ইহুদিবাদী ইসরাইলের হামলায় বেশ কয়েকজন সামরিক কমান্ডার, বিজ্ঞানী এবং বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। ওই হামলার পর পরই ইরানের সুন্নি আলেমরা নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
গোলেস্তান প্রদেশের গুম্ববাদ-ই কাভোসের জুমার নামাজের সুন্নি ইমাম মোল্লা আব্দুল বাসেত নূরিজাদ বার্তা সংস্থা ইরনার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ইহুদি শাসকগোষ্ঠী এবং তার উগ্র সমর্থকদের জানা উচিত, এ ধরনের আক্রমণ ইরানি জাতির ঐক্য ও সংহতিতে তো কোনো ব্যাঘাত ঘটাতে পারবেই না বরং আঞ্চলিক অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে তাদের দেশকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ঐক্যও আরও শক্তিশালী করবে।’
ইসরাইলের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধ শেষ হয়েছে গত ২৪ জুন। তবে আবারো যুদ্ধের আশঙ্কা দেখছেন সুন্নি আলেমগণ। এ প্রেক্ষাপটে ইরানের সুন্নি সম্প্রদায়ের ১,৩০০ জনেরও বেশি আলেম, চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবী গত রোববার এক যুগান্তকারী বিবৃতি দিয়েছেন। তারা ইরানের বিজয়কে ‘ইসলাম ও মানবতার বিজয়’ হিসাবে অভিহিত করেছেন।
ওই বিবৃতিতে তারা মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান, আলেম, চিন্তাবিদ ও যুবসমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘ইরানের এই বিজয় মূলত সত্যের উপর অসত্যের পরাজয়, কুফরের উপর ইসলামের জয়। আজ সময় এসেছে, ইমান, ঐক্য ও প্রতিরোধের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ সম্মিলিতভাবে ইসরাইল ও তার পৃষ্ঠপোষক পশ্চিমা শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘দুষ্ট ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠী, যার জন্ম ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র ও মার্কিন চক্রান্তের মাধ্যমে এবং এখনও বিদ্যমান, মুসলিম দেশগুলোর শরীরে ক্যানসারের টিউমারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এই রক্তপিপাসু শাসকরা কাফের মিত্রদের সাহায্য ও সমর্থনে জেরুজালেম এবং মুসলমানদের প্রথম কিবলা দখল করেছিল। তারা একটি দিনও অসহায় ফিলিস্তিনি শিশু ও নারীদের হত্যা না করে কাটায়নি। গাজার সংগ্রামী তরুণদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়া পর্যন্ত তাদের নির্লজ্জ অপরাধ চলতে থাকে। ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি সংগ্রামীরা এক অতুলনীয় মহাকাব্য রচনা করে এবং ‘আল-আকসা তুফান অভিযান’-এর মাধ্যমে ইসরাইলের সামরিক, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দেয়।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আর তোমাদের কী হয়েছে? তোমরা কেন আল্লাহর পথে এবং দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুদের জন্য লড়াই করছ না?’- পবিত্র কুরআনের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইসলামী দেশগুলোর মুজাহিদদের একটি অংশ অসহায় ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করছে এবং কাফেরদের সাথে সংঘর্ষে নিজেদের জানমাল বিলিয়ে দিচ্ছে।
ইরানি নেতারা বারবার বলেছেন, শিয়া ও সুন্নিরা একই ইসলামি উম্মাহর অংশ। সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি নিজেও বহুবার বলেছেন : ‘শিয়া ও সুন্নি ভাই ভাই। বিভাজনের চেষ্টা শত্রুদের ষড়যন্ত্র।’
বিবৃতিতে মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করে বলা হয়, আজ ইরানের উপর হামলা হয়েছে- আগামীকাল তা অন্য যে কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের ওপরও হতে পারে। কারণ, এই যুদ্ধ কেবল একটি ভূখণ্ড বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়Ñএটি একটি সভ্যতা, একটি দীন এবং একটি উম্মাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
সুন্নি আলেমগণ আহ্বান জানিয়ে বলেন, সব মুসলিম রাষ্ট্র, আলেম, চিন্তাবিদ, তরুণ, রাজনীতিক ও আন্দোলনকর্মীরা যেন পরস্পরের বিরুদ্ধে নয় বরং একত্রিত হয়ে ‘তারা কাফেরদের প্রতি কঠোর, আর নিজেদের মধ্যে দয়ার্দ্র’- এই নীতিতে অটল থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।
তারা পশ্চিমা দখলদার শক্তির কূটনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক উপস্থিতি-যেমন মার্কিন দূতাবাস, সামরিক ঘাঁটি ও কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণেরও আহ্বান জানান।
ইরানের সুন্নি আলেমদের এই যুগান্তকারী বিবৃতি কেবল একটি রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া নয়-এটি মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি ঐক্য ও সংহতির বার্তা। বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে যে, ইসরাইল ও তার মিত্রদের আগ্রাসন কোনো একক দেশ বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়, বরং সমগ্র ইসলামী সভ্যতা ও মানবতার বিরুদ্ধে। এখন সময় এসেছে বিভেদ ভুলে গিয়ে ইমানি শক্তিতে বলীয়ান হয়ে শত্র“র মোকাবিলা করার। যদি মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ থাকে, তাহলে জালিম শক্তির পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। এই বিবৃতি মুসলিম বিশ্বকে একটি স্পষ্ট বার্তা দেয় ‘আজ ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসন, আগামীকাল তা সবার বিরুদ্ধে। তাই জাগো, ঐক্যবদ্ধ হও এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলো!’
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, রেডিও তেহরান, ইরান

