নিজভূমে পরবাসী: আসামে জন্মেও ‘বিদেশি’ অপবাদে উচ্ছেদ বাঙালি মুসলিমদের
তোরা আগরওয়াল, রয়টার্স
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৫, ০১:৩৯ পিএম
আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে বাস্তুচ্যুত নারীরা। ছবি: সাহিবা চৌধুরী/রয়টার্স, ১৮ জুলাই ২০২৫, ভারত।
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসাম রাজ্যে নির্বাচনের আগে বাঙালি মুসলিমদের ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়ে উচ্ছেদ এবং তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ঘটনা ঘন ঘন ঘটছে। সম্প্রতি আসামের গোলপাড়া জেলায় এক খোলা মাঠে নীল ত্রিপলের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন শত শত মুসলিম নারী, পুরুষ ও শিশু—যাদের বাড়ি সরকারি জমিতে ‘অবৈধভাবে’ বসবাসের অভিযোগে গুঁড়িয়ে দিয়েছে প্রশাসন।
এ ঘটনাগুলো এমন এক সময় ঘটছে, যখন আসামে আগামী বছর শুরুতেই রাজ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি পুনর্নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রচার চালাচ্ছে।
গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হাজার হাজার মুসলিম পরিবারকে ঘরছাড়া করা হয়েছে। আসামের এই অভিযানকে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় উচ্ছেদ কর্মসূচি বলা হচ্ছে। এসব মুসলিমকে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করে বিতাড়নের কাজ চলছে। বিশেষ করে, ২০২৪ সালের আগস্টে ঢাকায় ভারতঘনিষ্ঠ সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকেই এই ধরপাকড় আরও তীব্র হয়েছে।
গোলপাড়ায় উচ্ছেদের শিকার ৫৩ বছর বয়সি আরান আলি বলেন, ‘সরকার বারবার আমাদের হয়রানি করে। আমরা আসামের জন্মসূত্রে বাসিন্দা হয়েও আমাদের বিদেশি বলা হয়।’
ভারতের ৪০৯৭ কিমি দীর্ঘ সীমান্তের মধ্যে আসামেই রয়েছে ২৬২ কিমি সীমান্ত, যা বাংলাদেশ ঘেঁষা। আসাম বরাবরই অভিবাসনবিরোধী মনোভাবের জন্য পরিচিত। অনেকের আশঙ্কা, বাংলাদেশ থেকে হিন্দু-মুসলিম উভয় ধরনের বাঙালি অভিবাসীদের আগমন স্থানীয় সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে ‘দখল’ করে ফেলবে।
‘মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের’ বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা: হিমন্ত বিশ্ব শর্মা
বিজেপির উগ্রপন্থি নেতা ও আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা দাবি করেছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে অব্যাহত মুসলিম অনুপ্রবেশ ভারতের জাতীয় পরিচয়কে হুমকির মুখে ফেলেছে। আমরা সাহসের সঙ্গে এই অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি।’
তিনি দাবি করেন, ২০১১ সালের আদমশুমারির ভিত্তিতে আসামে মুসলিম অভিবাসীরা বর্তমানে প্রায় ৩০% জনসংখ্যা গঠন করে, এবং আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই সংখ্যা ৫০%-এ পৌঁছে যাবে। শর্মা অবশ্য রয়টার্সের মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেননি।

৫০ হাজার উচ্ছেদ, লক্ষ্যবস্তু শুধু মুসলিমরাই
২০২১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে শর্মার সরকার ৫০ হাজারের বেশি মানুষকে উচ্ছেদ করেছে—যাদের প্রায় সবাই বেঙ্গলি মুসলিম। গত এক মাসেই পাঁচটি অভিযানে ৩,৪০০টি বেঙ্গলি মুসলিম পরিবারের বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগ
আন্তর্জাতিক সংকট বিশ্লেষক গ্রুপের সিনিয়র বিশ্লেষক প্রভীন দন্তি বলেন, ‘আইনগতভাবে বৈধ হলেও বেঙ্গলি ভাষাভাষী মুসলিমরা এখন ভারতের ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলোর জন্য সহজ টার্গেট হয়ে উঠেছে।’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক এলেইন পিয়ারসন বলেন, ‘ভারত সরকার অভিবাসীদের হান্ট করার নামে হাজার হাজার অসহায় মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলছে। এটা আসলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর বৈষম্যমূলক নীতির অংশ’।
রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মীয় মেরুকরণ
ভারতের বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করেছে, বিজেপি ভোটের আগে ধর্মীয় মেরুকরণ তৈরি করতে এসব উচ্ছেদ ও বিতাড়নের পথ বেছে নিয়েছে। আসামের বিধানসভার সদস্য এবং বিরোধী নেতা অখিল গগৈ বলেন, ‘এই পদক্ষেপগুলো বিজেপির জন্য রাজনৈতিকভাবে লাভজনক।’
আসামের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস ঘোষণা করেছে, তারা ক্ষমতায় ফিরে এলে উচ্ছেদ হওয়া বাড়িগুলো পুনর্নির্মাণ করবে এবং যারা সেগুলো ধ্বংস করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
‘পুশব্যাক’ নীতির শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ
কিছু রাজ্য বাঙালি মুসলিমদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর (‘পুশব্যাক’) পদক্ষেপ নিয়েছে। যদিও কয়েকজনকে আবার ফিরিয়ে আনতে হয়েছে কারণ তাদের ‘বিদেশি’ ঘোষণা করার বিরুদ্ধে আদালতে আপিল বিচারাধীন ছিল।
আসাম সরকারের তথ্যমতে, রাজ্যের বিদেশি ট্রাইব্যুনালগুলো প্রায় ৩০ হাজার ব্যক্তিকে বিদেশি হিসেবে ঘোষণা করেছে। এদের অনেকেই বহু বছর ধরে ওই অঞ্চলে পরিবার ও জমিজমাসহ বাস করলেও দারিদ্র্যের কারণে আদালতে লড়াই করতে পারেন না।
২০১৬ সালে নয়াদিল্লি ঘোষণা করেছিল, প্রায় ২ কোটি ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ ভারতে বসবাস করছে। সর্বশেষ ২০২৫ সালের মে মাসে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, তারা বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য ২,৩৬৯ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছে এবং ঢাকা সরকারকে দ্রুত যাচাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবিষয়ে রয়টার্সের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।
জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় বিভাজনের জোট
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক প্রভীন দন্তি বলেন, ‘আসামের পুরনো জাতিগত জাতীয়তাবাদ বিজেপির ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিশে গেছে। ফলে লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে বাঙালি ভাষাভাষী মুসলিমরা।’
বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ এবং শেখ হাসিনার পতনের প্রেক্ষাপটে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলো ‘অনুপ্রবেশ প্রতিহত করার’ নামে মুসলিমবিরোধী প্রচারণা আরও জোরদার করেছে—যার ভুক্তভোগী হচ্ছে হাজারো গরিব, প্রান্তিক ও নিপীড়িত মানুষ।
