Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

ওয়াকফ সংশোধনী বিল

ভারতে মুসলিম অধিকার হরণের নতুন ষড়যন্ত্র

Icon

তোফায়েল গাজালি

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভারতে মুসলিম অধিকার হরণের নতুন ষড়যন্ত্র

সম্প্রতি ভারতের বিজেপি সরকার ‘ওয়াকফ সংশোধনী বিল’ বাতিল করেছে, যা নিয়ে ভারতজুড়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম উদ্বেগ ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। অনেকেই বলছেন, এটি একটি সুপরিকল্পিত মুসলিম নিধন নীতির অংশ। এ প্রেক্ষাপটে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশের বরেণ্য আলেম, ইসলামি চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- তোফায়েল গাজালি

-ভারতে সম্প্রতি ওয়াকফ সংশোধনী বিল বাতিল করা হয়েছে। আপনি এ ঘটনাটি কীভাবে দেখছেন?

মাওলানা মহিউদ্দিন ইকরাম : এটি নিঃসন্দেহে ভারতের মুসলিমদের ওপর একটি সরাসরি আঘাত। ওয়াকফ সম্পত্তি মুসলিমদের ধর্মীয়, সামাজিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার মূল উৎস। ওয়াকফ সংশোধন আইনের মাধ্যমে মুসলিমদের দানকৃত মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, খানকা-মাজার ও আশ্রয়কেন্দ্রের মতো ধর্মীয় সম্পদগুলোতে সরকারি হস্তক্ষেপ ও দখলের পথ তৈরি করা হয়েছে। সংশোধনী বিলে ওয়াকফ বোর্ড ও কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলে অমুসলিম ২ জন সদস্য রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা অনেকটাই খর্ব হয়ে যাবে, যা মুসলমানদের জন্য চরম উদ্বেগের বিষয়। এর মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নগ্ন হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা বাড়বে। ভারতে মুসলিম স্বার্থবিরোধী ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাশ বিজেপি সরকারের ধারাবাহিক মুসলিমবিরোধী পদক্ষেপ-বিশেষত ধর্মীয় স্বাধীনতা, মালিকানা ও অধিকার হরণে সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টার নয়া কৌশল। বিজিপির এসব কর্মকাণ্ডই প্রমাণ করে তারা চরম মুসলিমবিদ্বেষী।

-বিজেপির ধারাবাহিক মুসলিমবিরোধী পদক্ষেপ বলতে কী বোঝাতে চাইছেন?

মাওলানা মহিউদ্দিন ইকরাম : বর্তমানে ভারতে প্রায় ৩০ কোটির বেশি মুসলমানের বসবাস। দীর্ঘদিন থেকে বিজেপি সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় ভারতে হাজার বছরের পুরোনো মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নানা কূটকৌশলে ধ্বংস করা হচ্ছে। মুসলমানদের অন্যতম শরিয়তের বিধান ‘তিন তালাক’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। লাভ ম্যারেজের নামে ধর্মান্তর প্রক্রিয়াকে সীমিত করা হয়েছে। গরুর গোশত রাখার অজুহাতে মুসলমানদের প্রায়ই পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। মুসলমানদের বিভিন্ন প্রদেশে ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করা হচ্ছে। এসব বিজিপি সরকারের মুসলিমবিনাশী ষড়যন্ত্রের অংশ। আমরা আশা করি, ভারত সরকার অবিলম্বে ওয়াকফ সংশোধন বিল বাতিল করে ভারতের মুসলমানদের জীবন, সহায়-সম্পত্তিসহ সব স্বার্থরক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং তাদের নিরাপত্তা বিধানে সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে।

-ওয়াকফ সংশোধনী বিলের ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর আর কী প্রভাব পড়বে?

মাওলানা মহিউদ্দিন ইকরাম : ওয়াকফ সংশোধনী বিলের ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের আরও যেসব গভীর ও দূরগামী প্রভাব পড়তে পারে তার মধ্যে প্রথম কথা হলো-এ বিলের মাধ্যমে ওয়াকফের মূল ধর্মীয় ও সমাজকল্যাণমূলক উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ওয়াকফ সম্পত্তি মৌলিকভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের নিজস্ব উদ্যোগে গঠিত হয়েছে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। দ্বীনের খেদমত করার জন্য। অথচ এ সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ এখন মূলত প্রশাসনের হাতে চলে যাচ্ছে, যার ফলে মুসলমানরা এখান থেকে আর আগের মতো সেবা পাবেন না। এতে দ্বীনের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে।

দ্বিতীয় এ বিলের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তিকে অনেকটাই ‘রাজনৈতিক সম্পদ’-এ রূপান্তর করা হতে পারে, যা সরকারি স্বার্থে ব্যবহারের ঝুঁকি বহন করে। এতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার নীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ও অবিশ্বাস বাড়ে।

তৃতীয়ত এ বিল ওয়াকফ সম্পত্তির ডিজিটাল রেকর্ড ও দখলমুক্তকরণ নিয়ে কথা বললেও, বাস্তবে অনেক জায়গায় এর অপপ্রয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। আপনি জেনে থাকবেন, কিছু রাজ্যে ওয়াকফ সম্পত্তি পুনর্দখলের নামে মুসলিম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ওপর প্রশাসনিক চাপ দেওয়া হচ্ছে। শতশত মসজিদ-মাদ্রাসা ভেঙে ফেলা হচ্ছে। এতে মুসলিমদের অধিকার এবং তাদের ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক পরিচয় ক্ষুণ্ন হবে। সর্বোপরি, ওয়াকফ সংশোধনী বিলটি সংখ্যালঘু মুসলিমদের জন্য শুধু একটি আইনগত পরিবর্তন নয়, বরং এটি তাদের পরিচিতি, অধিকার এবং ভবিষ্যৎ সামাজিক নিরাপত্তার ওপর একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করছে। আমি বলব, ওয়াকফ সম্পত্তি সঠিকভাবে ব্যবস্থাপিত হোক, দুর্নীতি বন্ধ হোক কিন্তু সেটা স্থানীয় মুসলিমদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং স্বতন্ত্র বোর্ডের নিরপেক্ষতা বজায় রেখেই হোক, প্রশাসনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে নয়।

-বাংলাদেশসহ ভারতজুড়ে এ বিল বাতিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে। আপনি মনে করেন, এ প্রতিবাদগুলো সফল হবে?

মাওলানা মহিউদ্দিন ইকরাম : বাংলাদেশসহ ভারতজুড়ে ওয়াকফ সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে যেসব প্রতিবাদ হচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রতিবাদগুলো শুধু একটি আইন সংশোধনের বিরুদ্ধেই নয়, বরং ধর্মীয় স্বাধীনতা, সংখ্যালঘু অধিকারের সুরক্ষা এবং শতশত বছর থেকে চলে আসা ওয়াকফ আইনের প্রতি সম্মান রক্ষার আন্দোলনও বটে। ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ যেখানে প্রতিবাদ ও মতপ্রকাশ সাংবিধানিক অধিকার। অতীতেও আমরা দেখেছি, মুসলমানদের শান্তিপূর্ণ ও সংগঠিত বহু আন্দোলন নীতিগত পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। সুতরাং এ প্রতিবাদগুলো বৃথা যাবে না ইনশাআল্লাহ। সবচেয়ে বড় কথা, এ প্রতিবাদের মধ্যে মুসলিম সমাজের আত্মপরিচয়, নিরাপত্তা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার একটি সম্মিলিত আহ্বান রয়েছে যা অবহেলা করা কারও জন্যই কল্যাণকর হবে না।

- এ বিষয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের মুসলমানদের করণীয় কী?

মাওলানা মহিউদ্দিন ইকরাম : আমাদের উচিত ভারতের মুসলিম ভাইদের প্রতি সংহতি জানান। শান্তিপূর্ণভাবে তাদের দাবির সঙ্গে একাত্ম হওয়া, নৈতিক সমর্থন দেওয়া, আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া। কূটনৈতিক পর্যায়ে আওয়াজ তোলা দরকার। দোয়া, মানববন্ধন, প্রতিবাদ যা করা সম্ভব তা করতে হবে। এতে গঠনমূলক সহমর্মিতার বার্তা যাবে।

- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় রাজনৈতিক নেতাদের কী ভূমিকা থাকা উচিত?

মাওলানা মহিউদ্দিন ইকরাম : সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমতা নিশ্চিত করা রাজনীতিকদের দায়িত্ব। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অনেকেই আজ উলটো পথে হাঁটছেন।

-ওয়াকফ শব্দটির ইসলামি ধারণা কী? একজন সাধারণ মুসলিমের জন্য এর গুরুত্ব আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

মাওলানা মহিউদ্দিন ইকরাম : ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী, ‘ওয়াকফ’ হলো কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্থায়ীভাবে তার মালিকানাধীন সম্পদ দান করে দেওয়া যার সুফল সমাজের প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় হয়, কিন্তু মূল সম্পদটি বিক্রি, উত্তরাধিকার বা বদলযোগ্য নয়। ওয়াকফ অর্থই হচ্ছে ‘অবরুদ্ধ করা’ বা ‘বন্ধ রাখা’, অর্থাৎ সম্পদটির মালিকানা আর নিজের নয়, বরং তা এখন আল্লাহর পথে নির্ধারিত। ইতিহাসে আছে নবি করিম (সা.) স্বয়ং সাহাবিদের ওয়াকফ করতে উৎসাহ দিয়েছেন। হজরত উমর (রা.) তার একটি জমি ওয়াকফ করেন এবং নবিজি (সা.) বলেন, ‘মূল সম্পদ রাখা হবে এবং এর ফল সমাজে বিতরণ করা হবে।’ (সহিহ মুসলিম)।

-আপনার মতে, বর্তমান বাংলাদেশে ওয়াকফ প্রথা কতটা সচল বা জীবন্ত? বাস্তব প্রয়োগে এর বাধাগুলো কী?

মাওলানা মহিউদ্দিন ইকরাম : বাংলাদেশে ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে বাহ্যিক কোনো সমস্যা না থাকলেও এর কার্যকারিতা ব্যাহত হচ্ছে দুর্নীতি, প্রশাসনিক জটিলতা ও সচেতনতার অভাবে। এ প্রথা যদি সঠিকভাবে ব্যবস্থাপিত হয়, তবে এটি হতে পারে দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক ন্যায়ের এক বিশাল শক্তি।

-আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

মাওলানা মহিউদ্দিন ইকরাম : আপনাকেও ধন্যবাদ।

ভারত ওয়াকফ সংশোধনী বিল

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম