ঐতিহ্যে ইসলাম
মসজিদে কিবলাতাইন
সুহাইল আহমদ
প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মদিনার পশ্চিম প্রান্তে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে এক অমূল্য স্মৃতিধর মসজিদ, মসজিদে কিবলাতাইন, যে মসজিদ একসঙ্গে বহন করছে দুই কিবলার ইতিহাস। ইসলামের শুরু থেকেই এ মসজিদ যেন সাক্ষ্য রেখে চলেছে আল্লাহর হুকুমের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্য, উম্মতের ঐক্য এবং আসমানি ওহির জীবন্ত বাস্তবতার।
মসজিদটি একসময় পরিচিত ছিল মসজিদে বনু সালামা নামে। হিজরতের পর নবী করিম (সা.) প্রায় ১৬ মাস বায়তুল মাকদিসমুখী হয়ে নামাজ আদায় করেন। এটি ছিল হাজারো নবীর কিবলা-হজরত আদম (আ.) থেকে ইসা (আ.) পর্যন্ত। সেই প্রাচীন কিবলার দিকেই দাঁড়িয়ে মুসলমানরা দোয়া-নিবেদন করতেন, সিজদায় অশ্রু ঝরত।
কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হৃদয়ে ছিল আরেকটি গভীর আকুলতা-পবিত্র কাবা যেন মুসলমানদের চিরস্থায়ী কিবলা হয়। কারণ তিনি ছিলেন হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর উত্তরসূরি; মিল্লাতে ইবরাহিমের পুনর্গঠন তার মহান দায়িত্ব। অন্যদিকে ইহুদিদের কপট অপপ্রচার দিনদিন বেড়েই চলছিল, ‘যেহেতু মুসলমানরা আমাদের কিবলার দিকেই মুখ করে, তবে ধর্মের ক্ষেত্রেও তাদের উচিত আমাদেরই অনুসরণ করা!’ এ অপপ্রচার ও অন্তরের গোপন বাসনা নবীজি (সা.)কে বারবার আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে বাধ্য করত কাবার দিকে মুখ করার ইশারা আসে কি না, এ ব্যাকুল প্রত্যাশায়।
হিজরি দ্বিতীয় সনের রজব বা শাবান মাস। রাসূলুল্লাহ (সা.) কয়েকজন সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে বনু সালামায় বিশর ইবনে বারা (রা.)-এর আতিথ্যে পৌঁছালেন। জোহর বা আসরের নামাজের সময় তিনি ইমামতি শুরু করলেন মসজিদে বনু সালামায়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাকাতের মাঝামাঝি, ঠিক সেই মুহূর্তে আসমানের দরজা যেন খুলে গেল। জিবরাইল (আ.) ওহি নিয়ে নেমে এলেন : ‘হে নবী! আপনি আপনার মুখ মসজিদুল হারামের দিকে ফিরিয়ে নিন। আর তোমরা যেখানেই থাক, কাবার দিকেই নিজেদের মুখ ফিরাবে।’ এক মুহূর্তের দেরি নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) সঙ্গে সঙ্গে কাবার দিকে ফিরে দাঁড়ালেন। সাহাবায়ে কেরামও (রা.) বিনা প্রশ্নে ইমামের অনুসরণ করলেন।
এ ঘটনা শুধু একবার, শুধু এক মসজিদে, শুধু এক উম্মতের সঙ্গেই ঘটেছিল। এ কারণে এ মসজিদই পেল নতুন নাম মসজিদে কিবলাতাইন, অর্থাৎ দুই কিবলার মসজিদ।
মসজিদটির সূচনা রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর হাত ধরে। এরপর বিভিন্ন যুগে মসজিদটি বারবার সংস্কার ও পুনর্গঠনের মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়েছে। ১০০ হিজরিতে খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) মসজিদটি নবভাবে নির্মাণ করেন। ৮৯৩ হিজরিতে মসজিদে নববীর খাদেম শুজায়ি শাহিন আল জামালি ছাদসহ মসজিদটিকে নতুন রূপ দেন। ৯৫০ হিজরিতে উসমানীয় সুলতান সুলাইমান আল কানুনি আগের তুলনায় বৃহত্তর আয়তনে মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করেন।
মসজিদে দীর্ঘদিন ছিল দুটি মেহরাব, একটি বায়তুল মাকদিসমুখী, অন্যটি কাবামুখী। নবী যুগের সেই দুই দিকের স্মৃতি ধারণ করেই মসজিদটি ছিল অনন্য। পরে সংস্কারের সময় বায়তুল মাকদিসমুখী মেহরাবটি অপসারণ করা হলেও ইতিহাসের সুবর্ণ সাক্ষ্য আজও উজ্জ্বল। আজকের মসজিদে কিবলাতাইন ঐতিহ্যবাহী আরবীয় স্থাপত্যশৈলীতে দৃষ্টিনন্দন। শ্বেতপাথরের গম্বুজদ্বয় যেন ইতিহাসের দুই কিবলার দুই দিকের প্রতীক। স্থাপত্যের শান্ত সরলতায় মসজিদটি চোখে যেমন স্নিগ্ধ, তেমনি হৃদয়ে জাগায় সময়ের গভীরতম স্মৃতি।
