হাদিসের আঙিনায় জ্যোতির্ময় নাম
মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল বুখারি (রহ.)
সুলতান মাহমুদ সরকার
প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ইমাম বুখারি (রহ.)-এর জীবন অধ্যবসায়, সাধনা ও গবেষণার এক অমর মহাকাব্য। ৮১০ খ্রিষ্টাব্দে (১৯৪ হিজরি) বুখারা নগরীতে তার জন্ম। পিতা ইসমাইল ছিলেন স্বনামধন্য আলেম, আর তার মা ছিলেন ধার্মিক ও বিদুষী নারী। কথিত আছে, শৈশবেই ইমাম বুখারি দৃষ্টিশক্তি হারান; কিন্তু মায়ের অবিরাম দোয়া ও আল্লাহর রহমতে তার দৃষ্টি ফিরে আসে। ঘটনাটি তার জীবনে এক বিস্ময়কর প্রভাব ফেলে। যেন তিনি বুঝতে শেখেন, কুদরত যাকে বেছে নেন, তার কাছে বড় বড় কাজ কঠিন নয়।
দশ বছর বয়সে তিনি হাদিস মুখস্থ করা শুরু করেন, আর মাত্র ষোলো বছর বয়সে তিনি তার শিক্ষকের সামনে হাজার হাজার হাদিস নিখুঁতভাবে আবৃত্তি করেন। তার স্মৃতিশক্তি ছিল অলৌকিক পর্যায়ের। ইতিহাসে বর্ণিত আছে, তিনি একবার বসরায় গিয়েছিলেন, যেখানে হাদিস শিক্ষকরা ইচ্ছাকৃতভাবে হাদিসের সনদ ও মতন অদল-বদল করে তাকে ভুল ধরার জন্য পরীক্ষা নেন। কিন্তু তিনি একে একে সব ভুল শনাক্ত করে সঠিক সনদ ও মতন তাদের সামনে তুলে ধরেন। সেই দিন থেকেই মানুষ বুঝতে পারে এ যুবকই একদিন হাদিসের সমুদ্রকে কল্যাণের জন্য সুবিন্যস্ত করে মানবতার সামনে উপস্থাপন করবেন।
তার জ্ঞানার্জনের পথ ছিল দুরূহ ও দুঃসাহসে পূর্ণ। তিনি সমগ্র ইসলামি ভূখণ্ডে সফর করেছেন-বুখারা, নিশাপুর, বাগদাদ, কুফা, মিশর, হিজাজ, দামেস্ক যেখানে যে বিশ্বস্ত আলেম ছিলেন, তিনি সেখানে গেছেন। কখনো দুর্ভিক্ষ, কখনো নিঃস্বতা, কখনো দীর্ঘ পথের কষ্ট কিছুই তাকে থামাতে পারেনি। রাতে অন্ধকারে উঠানে বসে প্রদীপের ক্ষীণ আলোয় তিনি হাদিসের বর্ণনাগুলো লিখেছেন, বাছাই করেছেন, যাচাই করেছেন। কখনো কখনো ঘুমাতে গিয়ে একটি সনদ তার মনে এলে ঘুম ভেঙে উঠে আবার কলম ধরেছেন। এ পরিশ্রম আর আল্লাহর প্রতি তীব্র আস্থাই তাকে তৈরি করেছে ইসলামি জ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রক্ষক হিসাবে।
হাদিস সংগ্রহে তার পদ্ধতি ছিল অবিশ্বাস্য কঠোর। তিনি এক লাখেরও বেশি মানুষের কাছ থেকে হাদিস শুনেছেন; প্রায় ছয় লাখের বেশি হাদিস সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু বাছাই করার সময় তার শর্ত এত কঠোর ছিল যে, সেখান থেকে মাত্র সাত-আট হাজার (পুনরাবৃত্তি বাদ দিলে প্রায় চার হাজার) হাদিস তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল-জামি’ আস-সাহিহ বিশ্বজোড়া পরিচিত সহিহ বুখারিতে সংকলন করেন। তার পদ্ধতি ছিল এমন কঠোর যে, আজকের পৃথিবীর কোনো গবেষণার ক্ষেত্রেই এমন গভীর যাচাই দেখা যায় না। তিনি বর্ণনাকারীর চরিত্র, সততা, স্মৃতিশক্তি, জীবনাচরণ, ভ্রমণের তথ্য সবকিছু পরীক্ষা করতেন। কোনো ব্যক্তির সম্পর্কে সামান্য শঙ্কাও থাকলে তিনি তার বর্ণিত হাদিস গ্রহণ করতেন না। একবার তিনি একটি হাদিস নিতে গিয়েছিলেন এক ব্যক্তির কাছে। দূর থেকে দেখে তিনি বুঝলেন লোকটি তার গাধাকে ধরার জন্য ঝুড়িতে খাবার আছে-এমন ভান করছে। এ ছোট প্রতারণা দেখে ইমাম বুখারি তার কাছ থেকে একটিও হাদিস গ্রহণ করেননি। তার এ সততার মাপকাঠি হাদিসকে যে নির্ভুল উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে তা মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিরল।
সহিহ বুখারির রচনা পদ্ধতি ছিল শুধু বাছাই-সংগ্রহ নয়; বরং তা ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক, ভাষাতাত্ত্বিক, শাস্ত্রগত ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের এক মহাগ্রন্থ। তিনি অধ্যায় বিন্যাসে অনন্য দক্ষতা দেখিয়েছেন। প্রতিটি অধ্যায়ের শিরোনাম তিনি এমনভাবে রচনা করেছেন, যা আলেমদের কাছে নিজেই একটি গবেষণার বিষয়। তার বইয়ের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি কাঠামোতে রয়েছে গভীর চিন্তার ছাপ। এজন্য সহিহ বুখারি আজ শুধু একটি হাদিসগ্রন্থ নয় বরং এটি একটি বিশ্বমানের গবেষণাপদ্ধতি, একটি জ্ঞানের স্থাপত্য।
এর গুরুত্ব ও মর্যাদা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, আলেমরা এক বাক্যে একে সংজ্ঞায়িত করেছেন-‘কুরআনের পর সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য, সবচেয়ে নির্ভুল গ্রন্থ হলো সহিহ বুখারি।’ এ মর্যাদা কোনো দাক্ষিণ্য নয়; এটি সেই কঠোরতা, গবেষণা, সততা ও আল্লাহভীতির বাস্তব স্বীকৃতি। সহিহ বুখারি কুরআনের পরে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ-এই শ্রদ্ধা শুধু মুসলমানদের আবেগ নয়; বরং এটি যুগে-যুগে হাজারো আলেমের গবেষণার ফল।
ইমাম বুখারির ব্যক্তিজীবন ছিল এক অনিন্দ্য নৈতিক চরিত্রের প্রতিফলন। তিনি কখনো রাজনীতি, ক্ষমতা বা দুনিয়াবি লাভের দিকে যায়নি। তিনি ছিলেন নির্লোভ, বিনয়ী, মেধাবী, ধ্যানমগ্ন মানুষ। যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উৎসর্গ করেছেন সত্যের অন্বেষণে। তার তাকওয়া এত গভীর ছিল যে, তিনি গবেষণা শুরু করার আগে দুই রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন, যাতে তিনি কোনো ভুল হাদিস সংকলন না করে ফেলেন। তার চরিত্রের পবিত্রতা তার গ্রন্থের মতোই নির্মল।
তার ছাত্রদের মধ্যেও আছেন ইতিহাসের কিংবদন্তিরা, ইমাম তিরমিজি, ইমাম মুসলিম, ইমাম নাসায়ী প্রমুখ মহান মুজতাহিদ ও হাদিস বিশারদ। বিশেষত ইমাম মুসলিম তার প্রতি এমন শ্রদ্ধা পোষণ করতেন যে, বলেছেন-‘তোমার মতো আর কেউ নেই পৃথিবীতে; তুমি হাদিস বিজ্ঞানের প্রকৃত নেতা।’ তার ছাত্ররা শুধু তার জ্ঞানই নয়, তার নৈতিকতা ও গবেষণার আদর্শও উত্তরাধিকারসূত্রে গ্রহণ করেন। তাই হাদিসশাস্ত্রের পরবর্তী প্রজন্মগুলোও তার প্রভাব বহন করে।
হাদিসশাস্ত্রে ইমাম বুখারির সামগ্রিক অবদান শুধু একটি বই রচনা নয়; তিনি হাদিসকে সংরক্ষণের একটি বিজ্ঞান হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি বর্ণনাকারীর সততা যাচাইয়ের মানদণ্ড তৈরি করেছেন, সনদের শুদ্ধতা নির্ধারণ করেছেন, বর্ণনাসম্ভাবনা যাচাইয়ের পদ্ধতি দিয়েছেন এবং জ্ঞানের স্বচ্ছতা কীভাবে রক্ষা করা যায় তা শিখিয়েছেন। আজকের সময়ে গবেষণা, তথ্য যাচাই বা বৈজ্ঞানিক কড়াকড়িগুলো যেভাবে হয় ইমাম বুখারির পদ্ধতি ছিল তারও শত শত বছর আগের উন্নত রূপ। এটি কেয়ামত পর্যন্ত প্রজন্মকে পথ দেখাবে।
ইমাম বুখারির জীবনের শেষ অধ্যায়ও তার কর্মযজ্ঞের মতোই শান্ত, মর্যাদাপূর্ণ ও গাম্ভীর্যে পূর্ণ ছিল। জীবনের শেষ সময়ে তিনি বুখারা ত্যাগ করে সামরকন্দের নিকটবর্তী খারতাঙ্ক গ্রামে অবস্থান নেন, যেখানে তিনি মানুষের ঈর্ষা ও রাজনৈতিক চাপে নির্জনতা বেছে নিয়েছিলেন। ২৫৬ হিজরির শাওয়ালের শেষ রাতে তিনি সূরা ইয়াসিন তিলাওয়াত করতে করতে নিশ্চুপভাবে ইহলোক ত্যাগ করেন। গ্রামের মানুষ ভিড় করে তার জানাজায় অংশ নেয় এবং তাকে সেখানেই কবরস্থ করা হয়। আজও সেই কবরস্থান ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে তার জ্ঞান, আত্মত্যাগ ও আমানতের প্রতি অসীম নিষ্ঠার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
