Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

মসজিদ : জ্ঞান ও সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র

Icon

মুহাম্মদ মনজুর হোসনে খান

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মসজিদ : জ্ঞান ও সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র

বিশ্ব ইতিহাসে মধ্যযুগকে প্রায় এক হাজার বছরব্যাপী একটি বিশেষ সময়কাল হিসাবে দেখা হয়। ইউরোপের দৃষ্টিতে এটি ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যের পতন থেকে ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এ সময় ইউরোপে রেনেসাঁ যুগের সূচনা, নতুন ভূখণ্ডের আবিষ্কার এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটে। মধ্যযুগকে অনেক সময় ‘অন্ধকার যুগ’ বা আধ্যাত্মিক যুগ বলা হলেও, একই সময়ে ইসলামের আবির্ভাব ও মুসলিম সভ্যতার সোনালি অধ্যায় সূচিত হয়।

৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে পবিত্র মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)। ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নবুয়তপ্রাপ্ত হন এবং ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় হিজরত করে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। জাহেলিয়াতের কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি আল কুরআনের শিক্ষা ও নিজ সুমহান চরিত্রের মাধ্যমে মানব ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেন। তার নেতৃত্ব, নৈতিকতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি মনোযোগ ইসলামের সোনালি যুগের ভিত্তি স্থাপন করে।

ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাসে খোলাফায়ে রাশেদা, উমাইয়া, আব্বাসী, ফাতেমী এবং ১৯২২ সালে উসমানীয় খেলাফতের পতন অন্তর্ভুক্ত। এ দীর্ঘ সময়কালে মুসলমানরা শুধু সামরিক বিজয় অর্জন করেননি বরং শিক্ষা, বিজ্ঞান ও জ্ঞানচর্চায় বিশাল অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কে ইসলামি সোনালি যুগ হিসাবে গণ্য করা হয়।

আল কুরআনে বারবার জ্ঞান অর্জনের তাগিদ এসেছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই মুসলমানরা জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত হন। মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় মসজিদকে শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করা হতো। মসজিদ শুধু উপাসনালয় ছিল না; সেখানে শিক্ষাদান, সামাজিক কার্যক্রম, আদালত ও বিচারসভাও অনুষ্ঠিত হতো। ইতিহাসবিদ ড. আহমদ আমীন উল্লেখ করেছেন, ‘মসজিদ তখন বিদ্যার সর্ববৃহৎ অঙ্গন ছিল। মক্কা ও মদিনার হারাম, কুফা, বসরা, মিশরের আমের মসজিদ প্রভৃতি জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র হিসাবে কাজ করত।’

উমাইয়া যুগের পরও মসজিদগুলো গ্রন্থাগার ও শিক্ষা কেন্দ্র হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কায়রোর তুলুন মসজিদ, আলেপ্পোর জামে মসজিদ, তিউনিসার জায়তুন মসজিদ, বাগদাদের যায়দিয়া মসজিদ, আল আজহার মসজিদ, মরক্কোর আল কায়রোয়ান, সিরিয়ার দামেস্ক মসজিদ প্রভৃতি জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসাবে সুপরিচিত।

মহানবী (সা.)-এর অনুসারীরা কুরআন, হাদিস ও সিরাত সংরক্ষণের পাশাপাশি ইতিহাসচর্চায় মনোযোগ দেন। এ প্রেক্ষাপটে গণিত, ভূগোল, ইতিহাস, চিকিৎসা, মহাকাশবিদ্যা প্রভৃতি শিক্ষার বিকাশ ঘটে। এক শতাব্দীর মধ্যে মুসলিম সভ্যতা স্পেন থেকে ভারতের সিন্ধু নদ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে ওঠে। তারা শুধু অঞ্চল জয় করেননি, বরং বিজিত এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গ্রন্থাগার ও জ্ঞানচর্চার পরিবেশ তৈরি করেছেন।

ইসলামের সোনালি যুগে মুসলমানরা গ্রিক ও ল্যাটিনসহ বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ সংগ্রহ করে আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। এর ফলে বিশ্বের বহু বিজ্ঞানী, গবেষক ও দার্শনিকের আবির্ভাবের পথ তৈরি হয়। বাগদাদ, কায়রো, বোখারা, সমরকন্দ, নিশাপুর, বসরা, ইস্পাহান, শিরাজ, কর্ডোভা প্রভৃতি শহরে সুপরিচিত গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে।

আব্বাসী যুগ (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.) জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ হিসাবে পরিচিত। আব্বাসী খলিফারা এশিয়া ও ইউরোপের বিস্তৃত অংশে বৃহৎ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। আব্বাসী খলিফা আল মানসুর ৭৬২ খ্রিষ্টাব্দে বাগদাদকে রাজধানী ঘোষণা করেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষার প্রসার ও পুস্তকপ্রীতি বৃদ্ধি পায়।

খলিফা হারুনুর রশিদ এবং তার ছেলে আল মামুন বাইতুল হিকমা প্রতিষ্ঠা করেন, যা বিশ্বের প্রথম বৃহৎ রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগার ও গবেষণাকেন্দ্র। বাইতুল হিকমায় বিভিন্ন দেশের পণ্ডিতরা কাজ করতেন এবং ফার্সি, গ্রিক, মিসরীয়, কালদীয়, ভারতীয় প্রভৃতি ভাষার গ্রন্থ এখানে অনুবাদ করা হতো।

বীজগণিতের জনক মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খারেজমি এখানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি ‘হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালা’ রচনা করেন। বাইতুল হিকমা বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রন্থাগার ও গবেষণাকেন্দ্র হিসাবে পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। খলিফা আল মামুন বিদেশি পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ ও গ্রন্থ অনুবাদে নিযুক্ত করেছিলেন। স্থপতি, প্রকৌশলী, চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদরা এখানে কাজ করতেন।

সংক্ষেপে, ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত মসজিদ ও গ্রন্থাগার মুসলমানদের জ্ঞানচর্চা ও বিকাশের প্রধান কেন্দ্র হিসাবে কাজ করেছে। আব্বাসী যুগের শিক্ষাব্যবস্থা ও গবেষণার মাধ্যমে মুসলমানরা বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ইসলামি সভ্যতা মধ্যযুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক সোনালি অধ্যায় রচনা করেছে, যা আজও অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে স্বীকৃত।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম