Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

আল মাহমুদের সুফি মানস

Icon

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আল মাহমুদের সুফি মানস

মুসলমান বাবা-মায়ের ঘরে জন্ম নেওয়া সন্তান সমাজের চোখে মুসলমান হিসাবেই বেড়ে ওঠে। জন্মসূত্রে নাগরিকের মতো এটাকে বলা হয় জন্মগত মুসলমান। কিন্তু সত্যিকার মুসলমান হতে হয় কর্ম করে। কর্মগত মুসলমান যাকে বলে। কার কোথায় জন্ম হলো এটা দিয়ে মুক্তি নিশ্চিত হয় না। এতে কোনো বুজুর্গিও নেই। আসল বুজুর্গি আমলে।

দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আমরা বেশির ভাগই জন্মগত মুসলমান। বাবা-মা মুসলমান ছিলেন বলে ইসলাম ধর্মের আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়েছি। এ ছাড়া আমাদের আচার-আচরণ, লেনদেন, চিন্তাভাবনা, পোশাক কোনো কিছুইতেই ইসলামের ছাপ নেই। বিষয়টা অনেকটা রাস্তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড কুড়িয়ে পেয়ে গলায় ঝুলিয়ে নিজেকে সর্বোচ্চ জ্ঞানপীঠের ছাত্র পরিচয় দেওয়ার মতোই হ্যাস্যকর। কুড়িয়ে পাওয়া আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে যেমন সত্যিকারের ছাত্র হওয়া যায় না, তেমনি মুসলমানের ঘরে জন্ম নিলেই খাঁটি মুসলমান হওয়া যায় না।

খাঁটি মুসলমান হতে হয় আমল দিয়ে। আমলের জন্য প্রয়োজন এলেম। কুরআনের এলেম। কুরআনের এলেম যার যত বেশি, সে তত বেশি পরহেজগার মুসলমান। কবি আল মাহমুদ ছিলেন সত্যিকারের পরহেজগার মুসলমান। জীবনের শুরুর দিকে তিনিও জন্মগত মুসলমান ছিলেন। তবে বিশ্বাস ছিল ভিন্ন আদর্শের। যে কারণে মুসলমানের আইডি কার্ড গলায় থাকলেও কুরআনের মুসলমান তিনি হয়েছেন অনেক পরে। কবি খ্যাতি পাওয়ার অনেক পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন জীবনাদর্শ হিসাবে। তিনি যখন নিজেকে মুসলমান বলে ঘোষণা করলেন তখন বুদ্ধিজীবী মহলে বেশির ভাগ মুসলমানের সন্তানই ধর্মের আইডি কার্ডটি বুক পকেটে লুকিয়ে রাখতেন।

তখন বাংলাদেশের সাহিত্যজগৎ ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক। কলকাতার বাবুরা আমাদের কবিতা না ছাপালে এদেশে কবি খ্যাতি পাওয়া যেত না। এমন একটা সময়ে নিজেকে কর্মগত মুসলমান দাবি করে এপারে-ওপারে রীতিমতো হইচই ফেলে দেন আল মাহমুদ।

১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, মৌড়াইল মোল্লাবাড়িতে জন্ম নেন বাংলাভাষার শক্তিমান কবি আল মাহমুদ। পুরো নাম মীর আবদুর শুকুর আল মাহমুদ। প্রতিবছর জুলাই এলেই সাহিত্য অঙ্গনে আল মাহমুদকে আলাদা করে স্মরণ করা হয়। তার বিস্তর সাহিত্য আর বর্ণিল জীবন ছাপিয়ে ধর্ম বিশ্বাস নিয়েও বিশেষ আলোচনার প্রয়োজন।

কবি আত্মজীবনীর শুরুর লাইনটিই লিখেছেন এভাবে-‘সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট ও উত্তর কুমিল্লা দখলে আনারও প্রায় দুই শতাব্দী পর আমার পূর্বপুরুষরা একটি ইসলাম প্রচারক দলের সঙ্গে বাংলাদেশে ভাটি অঞ্চলে প্রবেশ করেন’। ওই দলে মীর খান্দানের আউলিয়ারা ছিলেন আল মাহমুদের পূর্বপুরুষ। কুমিল্লায় ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে এ মীর পরিবারের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।

আল মাহমুদের লেখা থেকে জানা যায়, মীর আবদুল গনি তার বংশের ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ। তার তাকওয়ার বয়ান দিতে গিয়ে আল মাহমুদ লেখেন, তার প্রপিতামহ মীর মুনশি নোয়াব আলী খান্দানের পীরানি সিলসিলা থেকে বের হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হওয়ার অপরাধে চিরতরে তাকে বাড়ি ছাড়তে হয়। পীরানি সিলসিলার শিক্ষাব্যবস্থা ছিল খানকাকেন্দ্রিক। সে সিলসিলা ভাঙার বিষয়টি সাধু পুরুষ আবদুল গনি সহজভাবে নিতে পারেননি। ব্যাপারটা তাকে এতটাই মর্মাহত করে যে, মৃত্যুশয্যায় ইংরেজি শিক্ষিত ছেলে শেষবারের মতো তাকে দেখতে এলেও তিনি ছেলের হাতে এক চামচ পানি গ্রহণ করতেও অসম্মতি জানিয়ে মারা যান।

আল মাহমুদের প্রপিতামহ পড়াশোনা শেষ করে স্থানীয় আদালতে চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। আর তার পিতামহ মীর আবদুল ওহাব ছিলেন কবি ও সংগীত বিশেষজ্ঞ। পিতা মীর আবদুর রব জাঁদরেল ব্যবসায়ী। এমন বংশধারা থেকে প্রবাহিত রক্তের সন্তান আল মাহমুদ একইসঙ্গে বাংলাভাষার খ্যাতিমান কবি এবং সুফি মানস লালন করার পেছনে জিনগত প্রভাবের কথা উঠে আসতেই পারে। তবে তিনি নিজেকে বংশীয় বা জন্মগত মুসলমানের মধ্যে আটকে না রেখে বিপ্লবী মুসলমান হিসাবে প্রমাণ করতে পেরেছেন। অর্থাৎ তিনি জন্মগত নয় কর্মগত মুসলমানও ছিলেন।

মার্কসীয় আদর্শে বিশ্বাসী আল মাহমুদের জীবনের মোড় ঘুরে যায় কুরআনের ভেতরে ডুব দিয়ে। কুরআন অধ্যয়নে তিনি দেখতে পেয়েছেন, মানবতার জন্য বিধ্বংসী দুটি বিপরীতমুখী অর্থব্যবস্থা তথা পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের বাইরে বাস্তবসম্মত অর্থনৈতিক দর্শন ইসলামকে চিরকালীন ধর্ম হিসাবে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরিয়ে দিয়েছে। এখানে পুঁজিবাদের মূল অস্ত্র সুদ হারাম করার পাশাপাশি জাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন করে ব্যর্থ সামন্তবাদের কাঠামোও ভেঙে দিয়েছে কঠোরভাবে। বিষয়টি তাকে এতটাই প্রভাবিত করল যা, কোনো ধরনের দ্বিধা ছাড়াই নতুন করে ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি।

এ কারণে এক জায়গায় নিজেকে তিনি ‘নও মুসলিম’ বলে উল্লেখ করেছেন। সমসাময়িক মুসলমান কবি-সাহিত্যিকরা যখন মুসলমান পরিচয় দিতে লজ্জা পেত, ঠিক সে মুহূর্তে কেন তিনি নিজেকে মুসলমান ঘোষণা করলেন তা নিয়ে বিস্তর লিখেছেন নিজেই। এক লেখায় তিনি বলেছেন, ‘এবার কলকাতায় বেড়াতে গিয়ে আমার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিলাম। আমার দু-একজন অতি অন্তরঙ্গ বন্ধু-বন্ধবী ছাড়া অনেকেই আমাকে ঠিকমতো চিনতে পারছিলেন না। যেন ঠিকমতো ঠাহর করতে অনেকেরই অসুবিধা হচ্ছিল। ভাবটা এমন, আরে মাহমুদ ভাই না? আপনাকে তো একদম চেনাই যায় না। চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে কিনা। তা ছাড়া আজকাল নাকি মদ্যপানও ছেড়ে দিয়েছেন? আচ্ছা, এটা কীভাবে হলো? ডাক্তারের নিষেধ নাকি?’

ইমান যখন কারও হৃদয়ের গভীরে গেঁথে যায় তখন এ ধরনের পরিস্থিতি তাকে আরও শক্তি জোগায়। তাই তো এমন সব টিপ্পনী কাটা প্রশ্নের জবাবে আল মাহমুদের সরল জবাব ছিল, কুরআনে মদ হারাম হওয়ার কারণেই আমি আর মদ পান করি না। নবীজি দাড়ি রেখেছেন বলেই আর দাড়িতে হাত লাগাই না। এ ধরনের সরল জবাব দেওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি যে সত্যিই মুসলমান হয়ে গেছি এতে কারও কারও আক্ষেপ থাকলেও সন্দেহ থাকে না’। আসলেই আমাদের সমাজে এ ধরনের সত্যি মুসলমানের বড় অভাব। হে আল্লাহ! কবিকে আপনি জান্নাতে নিজের পাশে জায়গা করে দিন। আমিন।

লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর

www.selimayadi.com

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম