Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ (সা.) এলোরে দুনিয়ায়

Icon

মাহমুদ আহমদ

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ (সা.) এলোরে দুনিয়ায়

বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত এবং নবীকুলের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদের (সা.) আগমন হয়েছিল বিশ্ববাসীর জন্য রহমত রূপে। মহানবীর জীবন অতিবাহিত হয়েছে মানুষের মুক্তি সাধন, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা, ঐক্য বিধান ও মানুষকে সুসভ্য হিসাবে গড়ে তোলার জন্য। তাই তো মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমাকে সাদা-কালো নির্বিশেষে সবার জন্য পাঠানো হয়েছে’ (মুসনাদে আহমদ)। তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মাঝে ক্ষমার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

মহানবীর (সা.) আদর্শ এতটাই অতুলনীয় যে, তিনি ইহুদির লাশকেও সম্মান দেখিয়েছেন। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, একবার এক ইহুদির লাশ বিশ্বনবীর (সা.) সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর এতে মহানবী (সা.) সেই লাশের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে ছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না লাশটি তার সামনে থেকে চলে যায়। পাশ থেকে হজরত জাবের (রা.) বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটি তো ইহুদির লাশ। এতে আল্লাহর রাসূল উত্তর দিয়েছিলেন, সে কি মানুষ ছিল না? (সহিহ বোখারি, হাদিস নং ১৩১১)। কতই না অতুলনীয় ছিল মহানবীর (সা.) জীবনাদর্শ! হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.) বর্ণনা করেন, ‘একদা মসজিদে এক মরুচারী বা বেদুইন আসে আর সেখানেই প্রস্রাব করতে বসে পড়ে। লোকজন তার দিকে ধেয়ে আসে। মহানবী (সা.) লোকদের বারণ করে বলেন, একে ছেড়ে দাও আর সে যেখানে প্রস্রাব করেছে, সেখানে বালতির পানি ঢেলে দাও। তোমরা লোকদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সৃষ্ট হয়েছ, কাঠিন্যের জন্য নয়।’ (বোখারি)

এরপর দেখুন, মহানবীর (সা.) ঘরে এক ইহুদির অতিথি হওয়া ও এরপর মহানবীর (সা.) আপ্যায়নের ঘটনা খুবই বিখ্যাত। রাসূলের (সা.) উদারতা ও আদর্শে মুগ্ধ হয়ে সে ইসলামও গ্রহণ করে। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ঐতিহাসিক উদার চরিত্রকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে, ‘তোমার ধর্মে অবিশ্বাসীদের তুমি ঘৃণা নাহি করে/আপনি তাদের করিয়াছ সেবা ঠাঁই দিয়ে নিজ ঘরে।’

এরপর দেখুন, মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির বেশ কটি ধারা ছিল মুসলিম স্বার্থবিরোধী। তা সত্ত্বেও সুদূরপ্রসারী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহানবীর (সা.) নামের সঙ্গে ‘রাসূলুল্লাহ’ লেখা যাবে না মর্মে আপত্তি জানিয়ে বলা হয়েছিল, আমি যদি সাক্ষ্য দিতাম যে, আপনি আল্লাহর রাসূল, তাহলে তো আর আপনার সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ হতো না, আপনাকে বায়তুল্লাহ যেতে বাধা দিতাম না। তখন রাসূল (সা.) সন্ধির লেখক আলীকে (রা.) বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দটি কেটে দিয়ে ওর ইচ্ছানুযায়ী শুধু আমার নাম লেখো। এতে আলী (রা.) অপারগতা প্রকাশ করলে রাসূল (সা.) জিজ্ঞেস করেন কোথায় লেখা আছে, এরপর নিজ হাতেই তা কেটে দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও উদারতার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত পেশ করেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ৪/৬১, ইফাবা, ২য় সংস্করণ: ২০০৮ খ্রি.)

ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (সা.) বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করলে কুরাইশদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মহানবী (সা.) বিজিত শত্রুদের প্রতি কোনো ধরনের দুর্ব্যবহার তো দূরের কথা, কিঞ্চিৎ পরিমাণও প্রতিশোধস্পৃহা প্রকাশ করেননি, বরং শত্রুদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন। তিনি কুরাইশদের বলেছেন, ‘হে কুরাইশরা! আমি তোমাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করব বলে তোমরা মনে করো?’ তারা বলল, আপনি আমাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করবেন বলে আমাদের ধারণা। আপনি দয়ালু ভাই। দয়ালু ভাইয়ের পুত্র। অতঃপর রাসূল (সা.) বললেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে সেই কথাই বলছি, যে কথা হজরত ইউসুফ (আ.) তার ভাইদের উদ্দেশে বলেছিলেন, আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। যাও তোমরা সবাই মুক্ত।’ (আর-রাখিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা : ৪৩৯)

ক্ষমা ও মহানুভবতার অনুপম দৃষ্টান্ত মহানবীর (সা.) জীবনে আমরা উজ্জ্বলভাবে দেখতে পাই। মক্কায় আল্লাহতায়ালার তৌহিদ প্রচার করার ব্যাপারে কিছুটা নিরাশ হয়ে তিনি তায়েফ নগরীতে গমন করেন। মহানবী (সা.) ভাবলেন, তায়েফবাসী হয়তো বা তার কথায় কান দেবে। কিন্তু আল্লাহতায়ালার তৌহিদের বাণী তায়েফবাসী শোনা তো দূরের কথা, বরং তার (সা.) ওপর অমানবিক জুলুম-অত্যাচার করল।

তায়েফবাসী বখাটেদের মহানবীর (সা.) পেছনে লেলিয়ে দেয় এবং তারা পাথর নিক্ষেপ করে তার জ্যোতির্ময় পবিত্র দেহকে রক্তাক্ত করে দেয়। আত্মরক্ষার্থে মানব দরদি রাসূল (সা.) দ্রুত পদে তায়েফ ত্যাগ করেন। তিনি যখন তায়েফের উপকণ্ঠে পৌঁছেন, তখন আল্লাহতায়ালার তরফ থেকে ফেরেশতা এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যদি চান, তাহলে এ জালিম শহরবাসীদের আল্লাহ তাদের পাপের দরুন ধ্বংস করে দেবেন।’ ফেরেশতার কথার জবাবে মানবপ্রেমী রাসূল (সা.) আল্লাহতায়ালার দরবারে দুই হাত তুলে এ দোয়াই করলেন, ‘হে খোদা! তারা অজ্ঞ, তাই আমার ওপর জুলুম করেছে। তুমি এদের ক্ষমা কর এবং হেদায়াত দাও।’

নবুয়ত লাভের পর মক্কী জীবনে তিনি (সা.) ও তার সাহাবিরা (রা.) যে পৈশাচিক জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, তার ইতিহাস আমরা সবাই জানি, আবু জাহেল ও আবু লাহাবের দল তার ওপর কী ভয়াবহ জঘন্য শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছিল! কয়েক বছর মহানবী (সা.) ও সাহাবিদের নির্বাসিত জীবনযাপন করতে হয়েছিল। বহু নিরপরাধ মুসলমানকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল। অবশেষে জালিমদের জুলুম-নির্যাতনে প্রিয় নবী মাতৃভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় চলে গেলেন।

যেদিন তিনি মহাবিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন, সেদিন মক্কাবাসী ভেবেছিল, আজ নিশ্চয়ই তাদের নিস্তার নেই। তারা ভয়ানক শাস্তির প্রতীক্ষা করছিল। কিন্তু রহমতুল্লিল আলামিন, মানবদরদি রাসূল সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করলেন। তিনি বললেন, আজ যারা বিলালের পতাকার নিচে এসে দাঁড়াবে, তাদের সবাইকে ক্ষমা করা হবে। মহান আল্লাহতায়ালার রহিমিয়াত ও রহমানিয়াতের গুণে পরিপূর্ণরূপে গুণান্বিত না হলে এমন সাধারণ ক্ষমা করা কি সম্ভব?

তিনি (সা.) সেই মানবদরদি রাসূল, যিনি বিচলিতচিত্তে এক ইহুদি শিশুকে তার মৃত্যুশয্যায় দেখতে যান এবং দরদভরা হৃদয়ে তাকে তৌহিদের বাণী শোনান এবং তিনি সেই মানবপ্রেমিক রাসূল, যিনি উৎকণ্ঠিত হয়ে ওই বৃদ্ধাকে দেখতে যান, যে তার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত। এই তো সেই রহমতুল্লিল আলামিন, যিনি মানবতার সম্মানে ইহুদির লাশ দেখে দাঁড়িয়ে যান। তিনিই সেই ক্ষমাশীল রাসূল, যার মহান ক্ষমায় তারই সামনে নিবেদিত হয়ে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় হাজার হাজার বিধর্মী আশ্রয় গ্রহণ করে।

তিনি সেই পরম স্নেহময় রাসূল, যার অকৃত্রিম স্নেহের স্পর্শে পালিতপুত্র যায়েদ (রা.) স্বীয় পিতামাতার কাছে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায় এবং স্নেহময় রাসূলের কাছে সারা জীবন কাটিয়ে দেয়। তিনি সেই বাদশাহ রাসূল, যিনি তার সবকিছু দুহাতে বিলিয়ে দিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় তার পরম স্নেহময় প্রভুর কাছে প্রত্যাবর্তন করেন। এমন মহান আদর্শ, দয়া, মহানুভবতার শিক্ষা কি আর কোনো নবীর জীবনে লক্ষ করা যায়?

ক্ষমার যে দৃষ্টান্ত মহানবী (সা.) প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তা ছিল অসাধারণ। আল্লাহতায়ালা আমাদের প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা এবং শ্রেষ্ঠ নবীর আদর্শ মোতাবেক জীবন পরিচালনা এবং তার প্রতি অধিকহারে দরুদ পাঠ করার তাওফিক দান করুন, আমিন।

মাহমুদ আহমদ : ইসলামি গবেষক

masumon83@yahoo.com

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম